নিজস্ব প্রতিবেদক : একাদশ জাতীয় সংসদের চলতি বছরের বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে গত শনিবার। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পেশ, পাস, গত বছরের সম্পূরক বাজেট পাস হয়েছে এই অধিবেশনে। বাজেটের পর কোনো জিনিসের দাম বাড়বে বা কমবে, সরকারের কোন খাতে কত টাকা পেল, এমন বিষয়গুলোই মূলত আলোচনায় থাকে। তবে চলতি বাজেটে এসব ছাপিয়ে দুটি রাজনৈতিক বিষয় সামনে এসেছে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, দুর্নীতির কথা বারবার সামনে এসেছে। বেশ জোরালোভাবেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের কথাও উঠেছে এই সংসদে।
রাজনীতিবিদ ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এই সংসদে দুটি রাজনৈতিক বিষয় সামনে এসেছে এবং দুটি বিষয়ে সরকারের অবস্থানও সংসদেই সুস্পষ্ট করা হয়েছে। একটি হলো সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে রাজনীতিকে উদ্বেগ এবং চিকিৎসার জন্য বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার বিষয়ে সরকারের মনোভাব। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদকে সব ধরনের আলোচনার মূল কেন্দ্র বলা হয়। এবারের সংসদে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এসেছে। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার হয়েছে। ফলে যে পক্ষ এই দুটি প্রসঙ্গ সংসদে তুলেছিল, তারা বুঝেছে সরকারের মনোভাব কী? এর ফলে তারা এ সিদ্ধান্তও নিতে পারবে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?
বাজেট অধিবেশনে সাংসদেরা মোট সাড়ে ১৫ ঘণ্টা আলোচনা করেছেন। ৮৫ জন সাংসদ বক্তব্য দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ মনে করেন, সংসদে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। সাংসদেরা সেই অধিকার প্রয়োগ করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় আলোচনায় কোনো বাধা সৃষ্টির নজির নেই। বিভিন্ন বিষয় যেমন সংসদে উত্থাপিত হয়, তেমনি দাবিদাওয়া আসে। সরকার বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় কোনটা রাখা যাবে, কোনটা নয়।
অন্যদিকে বিএনপির সাংসদ হারুন অর রশিদ বলেন, সংসদে আলোচনা হচ্ছে। সরকারি দল বা বিরোধী দল অনেক কিছু বলছে। এর অনেক কিছুই জনগুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকার এই দাবি, চাওয়া বা উত্থাপিত বিষয় নিয়ে কোনো কর্ণপাত করে না। এই সরকার নামে গণতান্ত্রিক। কাজ করে একেবারেই নিজের মতো। কারও চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেয় না। জনদাবি সব সময়ই উপেক্ষা করে।
সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে উত্তাপ : গত ২৮ জুন সরকারের ‘আমলানির্ভরতা’ নিয়ে সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকারদলীয় সাংসদ ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যে সরকারের ‘আমলানির্ভরতা’ ক্ষোভ প্রকাশ চায়। এরপর বিরোধীদলীয় সাংসদেরা এ নিয়ে বক্তব্য দেন। সরকারকে সতর্ক করেন। আওয়ামী লীগ অনেকাংশে আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা আছে অনেক দিন ধরেই। দলটি জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। রাজনৈতিক মহল ছাপিয়ে আওয়ামী লীগও কি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে—এই প্রশ্ন দলের ভেতরেই আলোচিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে নেওয়া ‘মুজিব বর্ষের’ অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় আমলাদের প্রাধান্য নিয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা ঘনিষ্ঠজনদের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও দলীয় নেতারা আমলানির্ভরতা হিসেবেই দেখছেন। এমনকি বিভিন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া নিয়েও আলোচনা আছে। ২৮ জুন সংসদ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর সহচর ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সাংসদেরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে।
সাংসদ তোফায়েল বলেন, ‘আমরা যারা এই জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নেই যিনি এই করোনাকালে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক, গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন। আমি আমার নিজের এলাকায় ৪০ হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়েছি। এখন আমাদের মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটা যুক্তিসংগত জানি না। এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে, আমরা যা দিই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। অথচ প্রশাসনিক যাঁরা কর্মকর্তা, তাঁরা কিন্তু যানইনি। যাঁকে দেওয়া হয়েছে, তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক নয়। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ফেরাউনের সময়ও আমলা ছিল। এসব কথাবার্তা মানুষ পছন্দ করে না। সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘যাঁরা রাজনীতিবিদ, যাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাঁদের জন্য নির্ধারিত স্থান যে আছে, সেখানে তাঁদের থাকা উচিত। কারণ, আমাদের জেলায় একজন সচিব যাবেন। আমরা তাঁকে বরণ করে নেব, ঠিক আছে। কিন্তু তাঁরা যান না। এক দিনের জন্য তাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত।’
আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসতেন। মন্ত্রীরা গ্রামগঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।
রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনা আছে যে ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সরকারি চাকুরেদের ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, নাগরিক সংগঠনের অনেকের অভিযোগ, প্রশাসনের সহায়তায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এ কারণে প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাব এই সরকারের ওপর বেশি। আমলানির্ভরতা নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির সাংসদ ফিরোজ রশীদ, বিএনপি ও গণফোরামের সাংসদ। এই ঘটনার পরদিন সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জেলা পর্যায়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়াকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে জাতীয় সংসদে আলোচনার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি যা সত্য মনে করেছেন, তা-ই বলেছেন। এটা তো সত্য যে আমলাতন্ত্র কাজ করছে। জেলা পর্যায়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে একটি ‘চেইন’ তৈরি হয়েছে।
খালিদ মাহমুদের বক্তব্যই সরকারের মনোভাব বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এ নিয়ে দলের আর কোনো সাংসদ কোনো মন্তব্য করেননি। কথাও ওঠেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আমলা ও আমলাতন্ত্র অপরিহার্য। কিন্তু ‘আমলায়ন’ নয়। এই ‘আমলায়ন’ শব্দটিকে অধ্যাপক শান্তনু ‘আমলাসর্বস্বতার’ সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করতে চান। তাঁর মতে, সাম্প্রতিক সময়ে আমলায়ন একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর। আর এই আমলায়ন নিয়ে সাম্প্রতিক কালে জাতীয় সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক নেতার উচ্চকণ্ঠ হওয়া আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন অধ্যাপক শান্তনু। তাঁর কথা, ‘আমাদের রাজনীতিবিদদের নিজেদের সম্মানের বিষয়ে সরব হওয়ার এই চিত্র আশাব্যঞ্জক এবং শুভ দিকের ইঙ্গিত দেয়। জাতীয় সংসদে একাধিক নেতার এই সরব আমলাবিরোধিতার পর শাসকদলীয় একাধিক নেতা এ প্রসঙ্গে অবশ্য আমলাদের পক্ষই নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমার ধারণা, এসব নেতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন বা সুদৃষ্টিতে থাকতে চেয়েছেন।’
খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গ : চলতি সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্যের মাধ্যমে অনেকটাই পরিষ্কার যে সরকার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে মানবিক বা অন্য কোনো কারণে সিদ্ধান্ত দেবে না।
চলতি সংসদে বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সাংসদ হারুন অর রশিদ, রুমিন ফারহানা, মোশাররফ হোসেন, জি এম সিরাজ এই দাবি তোলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন কথা আলোচনা হচ্ছিল যে খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার পরিবারের ভেতরে-ভেতরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সরকার যে আলাদাভাবে খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেওয়া নিয়ে কোনো কিছু ভাবছে না, তা সংসদে জানিয়ে দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে। আইন অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই।’
খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ওনার (খালেদা জিয়া) পরিবারের সদস্যরা দরখাস্ত করলেন। ওনারা দরখাস্তে বলেছিলেন, ওনাকে বিদেশে নিয়ে যেতে হবে। তাঁদের আবেদনে আইনের ধারার কথা উল্লেখ ছিল না। ওই আবেদন বিবেচনায় নিয়ে দুটো শর্ত দিয়ে তাঁর দ-াদেশ স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। শর্ত দুটো হচ্ছে, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন ও দেশে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। তারা (খালেদা জিয়ার পরিবার) এটা গ্রহণ করেছিল। তাঁকে কারাগার থেকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল।’
আনিসুল হক আরও বলেন, ‘বিএনপির নেতারা কথায় কথায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলেন। একটি আবেদন যখন নিষ্পত্তি হয়ে যায়, তখন সেটা কি আবার পুনর্বিবেচনা করা যায়? ওনারা তো দরখাস্ত করে শর্ত মেনে মুক্ত করে এনেছেন। তারপর এখন বলছেন বিদেশে যেতে দিতে হবে। এটা কী রকম কথা! ওই দরখাস্ত তো নিষ্পত্তি হয়েই গেছে। সেটার ওপর তো আর কেউ কিছু করতে পারবে না।’
খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত বিধিবিধান উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে মুক্তি দিতে হলে সেটা আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটা উপায় আছে, তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন বা ৪০১ ধারায় সরকারের কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন। ক্ষমার আবেদন বিবেচনা করা হলে তবেই সেই আসামি বিদেশে যেতে পারবেন। আর ক্ষমা চাইতে গেলে অবশ্যই দোষ স্বীকার করে চাইতে হবে। এ ছাড়া সংসদে বক্তৃতা দিয়ে বা অন্য উপায় থাকলে আপনারা আইনটা দেখান। আইনে থাকার পরও যদি আমরা বিবেচনা না করি, তখন বলতে পারবেন।’
আলোচিত দুটি বিষয়ের ‘মীমাংসা’ জাতীয় সংসদে
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ