কৃষি ও কৃষক ডেস্ক: নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নের উত্তর দুরাকুটি গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক আবুল কালামের এবার তিন বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছেন। আলু উত্তোলনের দিনে শ্বশুরকে সহযোগিতা করতে মেয়ে-জামাই তার বাড়িতে এসেছেন। কৃষক কালাম জানালেন, মেয়ে-জামাই ও নাতি-পুতি বাড়িতে আসায় দুই কেজি গরুর মাংস কিনতে হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। তিনি জানান, ৫০ কেজি আলু বিক্রি করে দুই কেজি মাংস কেনার টাকা মেটানোও সম্ভব হয়নি।
জমিতে প্রতি কেজি আলু ৬ টাকা দরে বিক্রি করলে ৫০ কেজির দুই বস্তার মূল্য দাঁড়ায় ৬০০ টাকা। অথচ উৎপাদনে প্রতি বস্তা আলুর খরচ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। ফলে কৃষকের লাভের আশা অনেক কমে গেছে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে দেখা যায়, এ বছর আবহাওয়ার অনুকূলে আলুর ফলন ভালো হলেও কৃষকের মুখে হাসি নেই।
কৃষকরা জানান, এই সময়ে প্রতি বছর আলু কমপক্ষে ২০-২৫ টাকায় বিক্রি হতো। কিন্তু এবছর আলু বিক্রি শুরু হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দাম প্রতি কেজিতে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। বর্তমানে জমিতে ৫-৬ টাকায় আলু বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি বিঘায় আলুর উৎপাদন ব্যয় ৪০-৪৫ হাজার টাকা হলেও বিক্রি থেকে বিঘা প্রতি আয় মাত্র ১০-১২ হাজার টাকা। ফলে কৃষকরা প্রতি বিঘায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা লোকসান করছেন।
উপজেলা কৃষি দপ্তর জানিয়েছে, চলতি রবি মৌসুমে কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ৬ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্য ছাড়িয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। রোগবালাইমুক্ত থাকার কারণে প্রতি হেক্টরে ২২–৩০ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। দাম কমে যাওয়ায় অনেক কৃষক আলু উত্তোলন না করে জমিতেই ফেলে রেখেছেন।
গত বছর আগাম আলু চাষে এই উপজেলার কৃষকরা প্রায় ২০০ কোটি টাকা আয় করেছিলেন। কিন্তু লেট আলুর রেকর্ড ফলনের কারণে দাম কমে গেলে এবার আগাম আলু চাষ করেও কৃষকরা সর্বশান্ত হয়েছেন।
বাহাগিলি ইউনিয়নের আলু চাষী আব্দুল আজিজ জানান, তিনি এবার ৬০ বিঘা জমিতে আগাম আলু চাষ করেছেন। ৬০ বিঘার খরচ ২৫ লাখ টাকা হলেও দাম এত কম যে এক বিঘা আলু এখনও উত্তোলন করেননি। গত দুই বছরে তার আলু চাষে লোকসান প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
কেশবা গ্রামের আলু চাষী লুৎফর রহমান লুতু বলেন, দুই বছর আলু চাষ করে আমার শুধু আলুতেই লোকসান ৭০ লাখ টাকা। আমি একা নই, হাজার হাজার কৃষক সর্বশান্ত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কৃষকের লোকসান একশো থেকে দেড়শো কোটি টাকার মধ্যে হতে পারে।
উত্তর দুরাকুটি পশ্চিমপাড়া গ্রামের আলু চাষী শামীম হোসেন বাবু জানান, গত বছর আলু হিমাগারে রাখার কারণে আলুর ওপর অতিরিক্ত খরচ হয়েছিল। হিমাগারের ভাড়া প্রতি কেজিতে ৬ টাকা ৭৫ পয়সা। অন্যান্য খরচ যোগ করলে কৃষকের ওপর বড় চাপ পড়ে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লোকমান হাকিম জানান, এ বছর আবহাওয়া ভালো থাকায় এবং সময়োপযোগী সঠিক পরামর্শ পাওয়ায় মাঠে আলুর জমির অবস্থা অত্যন্ত ভালো। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কম হওয়ার পাশাপাশি ফলন গত বছরের তুলনায় হেক্টর প্রতি কমপক্ষে তিন থেকে চার টন বেশি হচ্ছে। এতে বাজারে আলুর সরবরাহ স্বাভাবিকের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দাম কিছুটা গত বছরের তুলনায় কমেছে। তবে খুব শীঘ্রই আলুর দাম আবার বৃদ্ধি পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
কৃষকের কী পরিমাণ লোকসান হয়েছে প্রশ্নে করলে লোকমান হাকিম বলেন, এ বছরের আগের বছর আগাম আলু বিক্রি করে এ উপজেলার কৃষকরা প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা আয় করেছিল। এবার কোন কৃষক লাভ করতে পারেনি। প্রতিজন কৃষক বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত লোকসান গুনেছে। সে হিসাবে এ উপজেলার হাজার হাজার কৃষক আনুমানিক একশো থেকে দেড়শো কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। তা শুধু কুষকের ক্ষতি নয়, এ উপজেলার অর্থনীতিতে বড় আঘাত।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ




















