মো. হাফিজ আহমেদ নয়ন : বাংলা কবিতার স্বর্ণযুগ চলে গেছে বলে অনেকে মনে করেন। আসলে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের বইয়ের টেবিল দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপ। ভোগবাদী সমাজে মানুষও যেখানে পণ্য, সেখানে অবসরে কবিতা পড়ার মতো লোক মেলা ভার। সমকালের অন্যতম প্রাসঙ্গিক কবি আলীম হায়দারের ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ কাব্যগ্রন্থটি ৪০টি ঝরঝরে কবিতায় সাজানো হয়েছে। আমার মনে হয় ইচ্ছে করেই প্রতিটি কবিতার আলাদা নাম দেওয়া হয়নি, ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ শিরোনামই প্রতিটি কবিতাকে শিরোধার্য করেছে, গ্রন্থের সব কবিতায় একটি ভাবধারাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। মনে হয়েছে : আবেগের প্রকাশ প্রকৃতির স্পর্শে এক অপূর্ব নিস্তব্ধতার কাছে চলে গিয়েছে। আলীম হায়দার লিখেছেন—
দকোলাহল কমেছে হাটে, বাট্টা কমেছে ঘাটে—
সন্ধ্যার বাঁশঝাড়ে বেড়েছে বকের পাখার ঝাপটা—‘
জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে নিসঃঙ্গতা আধুনিক কবিদের অন্যতম অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। কবি আলীম হায়দারও ব্যতিক্রম নন। সমাজের বাস্তবতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে কবি অনুভূতির বেদনার রূপটিই বেছে নিয়েছেন। আধুনিক সমাজ আমাদের যে একাকিত্ব উপহার দিয়েছে, সেই একাকিত্বের মধ্যেই এক আশ্চর্য অনুভূতি খুঁজে ফেরা কবি লিখেছেন :
দশাবান মাসের ভরা পূর্ণিমা শেষ, ভাগ্যরাত্রির চন্দ্রপ্রহর কেটেছে
চৈতালি হাওয়ার ঝাপটা মেখে, তারপর আরও এক রাত গেছে
দ্বিপ্রহরের আকাশজুড়ে সন্ধানী মন খুঁজে ফেরে নিজেকে—
সওদাগরি সময় শেষে হারানো আত্মার প্রেতাত্মারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে’
একদিকে কোভিড নাইনটিন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছে মানুয়ের অসহায়ত্ব, একাকিত্বের অসহায়ত্ব। অন্যদিকে বেঁচে থাকার জন্য অনবরত সংগ্রাম মানুষকে হিংস্র করে তুলছে। এছাড়া অসংখ্য নাগরিক যন্ত্রণার বিষয়াবলি কবি আলীম হায়দারের ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ কাব্যগ্রন্থে অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে। প্রতিটি কবিতা যেন মানুষের মনে অল্প অল্প করে জমতে থাকা বেদনা ও ক্ষোভের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। সামাজিক অনাচারের নগ্নতা প্রকাশ্যে এসেছে কবির লেখায় :
‘বজ্রশিখা খুঁজে ফেরে মেম্বারের বাড়ি
ত্রাণচোর নেতারা চেতনায় গর্ভবতী
এদের অ্যাবরশন করাতে হবে
শেষ হোক টাউটের রাজনীতি
জয় বাংলা মানে প্রাণের সিম্ফনি
আমি তুমি আপনি—’
নিঃসঙ্গতার অন্যতম অনুসঙ্গ প্রকৃতি অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে আলীম হায়দারের কবিতায়। আবহমান বাংলার মতোই বাংলা সাহিত্যেও কবিতা সবসময়ই প্রকৃতিনির্ভর। প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা সমাজের বাস্তবতার সাথে মিশে একাকার হয়েছে ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’ গ্রন্থের একেকটি কবিতায়। এর সাথে যোগ হয়েছে কোভিডকালীন নিঃস্তব্ধতা। সব মিলিয়ে স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস বইটি নতুনপ্রজন্মকে শুধু আশাহতই করে না, নতুন আশার বাণীও শোনায়; কবির মন প্রকৃতির মতোই সাবলীল ও আশাবাদী। প্রতিকূলতার শৃঙ্খলে বন্দি কবি তাই বলেন :
‘চন্দ্রাহত হয় না যে, সে মানুষ নয়;
আস্ত জানোয়ার হয়ে গেছে
হিংস্রতার গ্রাস থেকে নরম মৃত্তিকা
একদিন নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে’
কবি আলিম হায়দারের জন্ম উত্তরবঙ্গের গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়িতে। তিনি শিক্ষক পরিবারের সন্তান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ শেষ করার পর রংপুর ক্যাডেট কলেজে স্কুল ও কলেজের গ-ি পেরিয়েছেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। যৌবনের গতিময় সময় পার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। লেখালেখির অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই তার প্রথম কবিতার বই ‘চিত্রপট’ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশ পায়। এরপর থেকেই একের পর এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে কবিতায় হাত পাকিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় তার ভিন্নধারার এই সিরিজ কাব্য নিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নলোকে সন্ত্রাস’। কবিতার বই পাঠের ভালো সুবিধা হলো—একরাশ মুগ্ধতায় ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যাওয়া যায়। কবি তার কবিতায় নিজের গান গেয়ে অন্যকে প্রভাবিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দীর্ঘ সময় একই হলে থাকা ব্যাচমেট এবং বন্ধু হওয়ার সুবাদে কবি আলিম হায়দারের একাকিত্বের অনিয়ন্ত্রিত জীবনকে খুব কাছে থেকে দেখেছি। ব্যক্তিজীবনের সেই একাকিত্বের আনন্দ বা বেদনাকে বারবার ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন কবি তার কবিতায়। সন্ত্রাস শব্দটিকে শিল্প বানিয়ে সেই শিল্পের শিল্পী হয়েছেন কবি। তিনি কবিতায় বলেছেন—
‘মাঘী পূর্ণিমা প্রায় ছুঁয়ে গেছে পাঙ্খা বসন্তকে
মেঘে-পলাশে মাখামাখি বাতাসের বাঁকে
কৃষ্ণচূড়া খুলেছে ডানা আকাশের জালে
চিলমারির চরে জমবে বলী এবার ফাল্গুনে।’
মহাকালের এক মহাগ্রাসের সঙ্গী হওয়ার দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই হোক না কেনো, আমরা সেই মহামারি-অতিমারির ভেতর দিয়েই গিয়েছি, হয়তো এখনো যাচ্ছি। জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে কেটে যাওয়া প্রায় দেড় বছরের বেশি সময়কে এক মলাটে তুলে ধরার এই প্রয়াসের মূল্যায়ন হয়তো মহাকাল করবে। তবে চরম ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দাঁড়িয়েও যে জীবনসংসারের ছোট ছোট আনন্দময় উপলব্দি মানসপটে নাড়া দেয়, দমবন্ধ শোকাতুর সময়ের আতঙ্কের মধ্যেও যে খলখলিয়ে হেসে উঠতে পারে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল; তা ঠিকই ধরা পড়েছে কবির চোখে। জীবনযাতনার নান্দনিকতায় রূপমুগ্ধ এই কবি বেঁচে থাকুক তার পরিমিত পঙক্তির নির্জনতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্থির ও চলমান চিত্রে এবং অনুভূতির দোলাচলে।
শেখ মুসলিমা মুন এর প্রেমের কবিতা
শেখ মুসলিমা মুন