ঢাকা ০৬:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আরিফুল হাসানের গল্প: ডানাভাঙা গাঙচিল

  • আপডেট সময় : ১১:৫১:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ জুন ২০২২
  • ৯৬ বার পড়া হয়েছে

গায়িকা মেরি যখন জলে ডুবে যাচ্ছে, তখন একটি পাফিন মুখভর্তি খাদ্য ফেলে ছুটে আসে এবং তার দেখাদেখি অন্যান্য পাফিনও আসে। তারা গায়িকার মুখটিকে ভাসিয়ে রাখতে চায় অন্তত। এতে তাদের সম্মিলিত চেষ্টা কিছুক্ষণ ব্যর্থও হয় ঠিক। কিন্তু তারা তা পারে। তবে কতক্ষণ এভাবে ধরে রাখা যাবে তা চিন্তার বিষয়। পাফিনরা অন্য সাগরপাখিদের ডেকে একত্রিত করে এবং সব পাখি মিলে গায়িকা মেরিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তার সোনালি চুল ভাসতে থাকে জলের ঢেউয়ে। সফেন সমুদ্র তাকে টেনে নিতে চায় গভীরতর মৃত্যুতে।
কিন্তু পাখিরা তখন হাল ছাড়তে রাজি নয়। তারা সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণীদের সহযোগিতা চায়। তখন একটি দয়ালু ডলফিন গিয়ে ডেকে নিয়ে আসে বিশালদেহী নীলতিমিকে। নীলতিমি তার পিঠের জমিনে করে মেরিকে তীরের কাছে পৌঁছে দেয়।]
আমেনা রান্না করছে। উঠানের এক কোণে অগ্রহায়নের বেলা হেলে পড়ছে সবজি বাগানটার উপর। সেখান থেকেই সে সবজিগুলো তুলেছে। কেটে বেছে ধুয়ে চুলায় চড়িয়ে সে একটি গান ধরে। গুনগুন করে সে এ গানটিই সব সময় গায়। ‘ও মাঝি নৌকা ভিরাও ঘাটে, আমি যামু চান্দের দেশে’—গানটির এতটুকুই তার মনে আছে। ছোটবেলায় না কখন কার মুখে যে শুনেছিল গানটা। এ অংশটা স্মৃতিতে লেগে আছে। যখনই কাজকর্মের ফুসরৎ পায় আর মনে একটু আনন্দ আসে, দুঃখ ভাসে তখনই সে গুনগুন করে এ দুটি লাইন গায়। কিন্তু লাইন দুটির অর্থ সে ঠিক বোঝে না। চান্দের দেশ আবার কেমন দেশ? ওখানে কি দিনরাত সমান নাকি? ভাবনাগুলোর উত্তর মেলে না। রাতের আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অ চান, তোমার আবার দেশ কই?’ বলে আর খিলখিল করে হাসে। আকাশভাঙা জ্যোৎস্নাও হাসে তার সাথে।
বাড়ির পাশে গোমতি নদী বয়। আমেনা উদাস হয়ে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। কত জল আসতো আগে। এখন মরা স্রোতে বয়। আমেনা চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে তার চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে। এ নদী দিয়ে আর এখন নৌকা চলাচল নেই। দুয়েকটা বালু তোলার ট্রলার সব সময় ভেসে থাকে জলের কাঁটা হয়ে। বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে বেইলি ব্রিজ, তার পশ্চিমে কিছু অংশ দূরে বালু উত্তোলন চলে।
রান্না করতে করতে আমেনা গুনগুন করে গানটি গায় এবং তরকারিতে লবণ কম হওয়ায় পুনরায় লবণ দেয়। হঠাৎ তার মনটি উদাস হয়ে যায়। বিকেলে যে বাগান থেকে সবজি তুলেছিল, তা ছিল তার মেয়ে মেরির। ছোট্ট মেয়ে মেরি। তাকেও সে গানটি শিখিয়েছিল। আধো আধো বোলে গাইতো মেয়েটি। আজ তার স্মৃতিধুলো পরে আছে, পরে আছে। শুধু সে নেই।
হঠাৎ ভাতের পানি উতরে পড়লে আমেনার সম্ভিত আসে। সে চুলার লাকড়িটা টেনে নেয়। আগুনের আঁচ কমলে ভাতেরও বুদ্বুদ কমতে থাকে। আমেনা কাঠি দিয়ে ভাত তুলে দেখে। না, সন্ধ্যা নামার আগে আগেই সে সব কাজ করতে পারবে।
তখন তেইশ আর মেরির ছিল চার। ছোট ছোট হাত দিয়ে সে মায়ের সাথে গাছে জল দিতো। আজ তা পরিপূর্ণ, শুধু মেরি নেই।
গতবছর এমন দিনে মেরির জন্মদিন ছিল। ঠিক সেদিনই ঘটলো অঘটনটা। একটা ফুটফুটে মেয়ে বাড়ির কাছে নদীর হদিস পেল। তার অচেনায় অলৌকিক হতে ভয় পায় না। নদীর কাছাকাছি নেমে আসে। তারপর জলের কাছাকাছি। সেবারও দুয়েকটা মাছ ধরার স্থানীয় জেলেদের নৌকা দেখা যেত। মেরি তাদের দিকে হাত তুলে ডাকে, ‘যামু চান্দের দেশ…।’ মাঝিরা খিলখিলিয়ে হেসে চলে যায়। হয়তো চোখেও পড়ে না তাদের ছোট হাতের আহ্বান। মেরি হারায়। জলতলার নিচে, আরও আরও গভীরে, অন্ধকারে সে তলিয়ে যায়। বাড়িজুড়ে হাহাকার, তাবিজ কবজ এনে কেউ বাঁধে হাতে। কেউ পাশে উপজেলা সদরের হাসপাতালে নিতে চায়। বাবা মা ভয়ে ছুঁয় না, হাসপাতালে নিতে নিতে দেরি হয়ে যায়। তারপর থেকে আমেনা অপ্রকৃতস্ত। শৈশবের শেখা সেই গানটি তার মনে ভাসে। সে সবসময় গানটি গায় গুনগুন করে। তবে সংসারে সময় দিতে তার কোনো কার্পন্য নেই। সবকাজই করে নিষ্ঠার সাথে। সবকিছু যতœময় হাতে গুঁছিয়ে রাখে। কেউ কিছু বুঝার উপায় নেই। সে একটু ফুসরৎ পেলে, একটু আনন্দ পেলে, একটু বেদনা কিংবা বিষাদে, একাকীত্বে গেয়ে উঠে গুনগুনিয়ে.. “ও মাঝি নৌকা ভিরাও ঘাটে, আমি যামু চান্দের দেশে।”
[গায়িকা মেরিকে পাফিনেরা সাগরপ্রাণীদের নিয়ে তীরে পৌঁছে দেয় ঠিক, তবে তীরে তার মন বসে না। সে আবার জলের বুকে ঝাঁপাতে চায়। তার যে এলোচুল ঢেউয়ের ফণায় দুলছিল, তা ছিল উল্লাসকর তার কাছে। সে এমন মধুর মোহন স্মৃতিতে আবার হারাতে চায় এবং পাফিনদের কথা অমান্য করে, সাগরের অন্যান্য প্রাণীর কথা অগ্রাহ্য করে সাগরের ঢেউয়ে ঝাঁপাতে চায়। শেষে সাগরপ্রাণীর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তাকে বেরিকেড প্রদান করা হয় এবং মাছেরা একেকটা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে, একেকটা পাখি ডানার সাথে ডানা লাগিয়ে প্রাচীর তৈরি করে। প্রাচীরের ওপাশে গায়িকা মেরি খুব অস্থির হয়ে পড়ে। এবং তার দমবন্ধ হতে থাকে তেমনই; যেমন সে সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার ফলে হয়েছিল। তার আরও বেশি মনে হতে থাকে তীরের হাওয়ায়। তার মনে হয়, সে এক আজন্ম জলচর, এই তীরে তার ফুল্কারোহন বাতাসের স্বাদে অমৃত ছড়ায় না দেহে। ফলে সে মাছের মতো বালির উপরে ঝাঁপটাতে থাকে এবং কিছুক্ষণ তড়পাতে তড়পাতে তার দেহ থেকে প্রাণমীন উড়ে গিয়ে সাগরে মিশে যায়।]
ভাটির দেশের কথা ছিল আমেনার। কিন্তু দেশটি এখন উন্নত। তার বাড়ির পাশেই থানা, তারপাশে সুদৃশ্য রোড ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে রোডটিকে ছুঁয়েছে। আমেনা নদী দেখে। তার রান্নাঘর থেকেও ঘাড় কাত করলে নদী দেখা যায়। বাড়ি ছুঁয়ে নদী। তার ওপরে টিনের ঘরে। ঘরে শূূন্যতা। বিয়ে হয়েছে তিন-চারে বারো বছর। ওই একটিই হয়েছিল গর্বের ধন। বিয়ের সাত বছর পরে।
গানটি যখন গায়, তখন তার শরীরের রোম শিহরিত হয়ে ওঠে। যখন সে গায়, অজানা আনন্দে, আপ্যায়নে সে বিভোর হয়ে যায়। কোথায় যায়? সে যায়, সে নিজেও জানে না। কিছুক্ষণের জন্য তার নিজেকে ভারহীন, আনন্দ কিংবা দ্বিধাহীন, ভয়ডর হীন, বেদনাহীন এক অবস্তুর মতো লাগে। তখন সে ভেতর থেকে, কোনো অপুরের অপার থেকে গেয়ে ওঠে, কোন সে হৃদয়? আমেনা দেখে, তার হাতে কড়াইয়ে মসলা মাখাচ্ছে সবজিগুলো। খুন্তির খোঁচায় তার মশলাগুলো মিশে যাচ্ছে তরকারির নরম দেহে। আমেনার চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে। বাড়ির পাশে ঝড়ে একাংশ ভাঙা শীলকড়ুইয়ের মগডালে একটি ডানাভাঙা গাঙচিল প্রতিদিনের মতো এসে রাতের বিশ্রাম নেয়। বেলা নেমে এলে আমেনা রান্নাবান্না সেরে চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরোয়।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আরিফুল হাসানের গল্প: ডানাভাঙা গাঙচিল

আপডেট সময় : ১১:৫১:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৪ জুন ২০২২

গায়িকা মেরি যখন জলে ডুবে যাচ্ছে, তখন একটি পাফিন মুখভর্তি খাদ্য ফেলে ছুটে আসে এবং তার দেখাদেখি অন্যান্য পাফিনও আসে। তারা গায়িকার মুখটিকে ভাসিয়ে রাখতে চায় অন্তত। এতে তাদের সম্মিলিত চেষ্টা কিছুক্ষণ ব্যর্থও হয় ঠিক। কিন্তু তারা তা পারে। তবে কতক্ষণ এভাবে ধরে রাখা যাবে তা চিন্তার বিষয়। পাফিনরা অন্য সাগরপাখিদের ডেকে একত্রিত করে এবং সব পাখি মিলে গায়িকা মেরিকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তার সোনালি চুল ভাসতে থাকে জলের ঢেউয়ে। সফেন সমুদ্র তাকে টেনে নিতে চায় গভীরতর মৃত্যুতে।
কিন্তু পাখিরা তখন হাল ছাড়তে রাজি নয়। তারা সমুদ্রের অন্যান্য প্রাণীদের সহযোগিতা চায়। তখন একটি দয়ালু ডলফিন গিয়ে ডেকে নিয়ে আসে বিশালদেহী নীলতিমিকে। নীলতিমি তার পিঠের জমিনে করে মেরিকে তীরের কাছে পৌঁছে দেয়।]
আমেনা রান্না করছে। উঠানের এক কোণে অগ্রহায়নের বেলা হেলে পড়ছে সবজি বাগানটার উপর। সেখান থেকেই সে সবজিগুলো তুলেছে। কেটে বেছে ধুয়ে চুলায় চড়িয়ে সে একটি গান ধরে। গুনগুন করে সে এ গানটিই সব সময় গায়। ‘ও মাঝি নৌকা ভিরাও ঘাটে, আমি যামু চান্দের দেশে’—গানটির এতটুকুই তার মনে আছে। ছোটবেলায় না কখন কার মুখে যে শুনেছিল গানটা। এ অংশটা স্মৃতিতে লেগে আছে। যখনই কাজকর্মের ফুসরৎ পায় আর মনে একটু আনন্দ আসে, দুঃখ ভাসে তখনই সে গুনগুন করে এ দুটি লাইন গায়। কিন্তু লাইন দুটির অর্থ সে ঠিক বোঝে না। চান্দের দেশ আবার কেমন দেশ? ওখানে কি দিনরাত সমান নাকি? ভাবনাগুলোর উত্তর মেলে না। রাতের আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অ চান, তোমার আবার দেশ কই?’ বলে আর খিলখিল করে হাসে। আকাশভাঙা জ্যোৎস্নাও হাসে তার সাথে।
বাড়ির পাশে গোমতি নদী বয়। আমেনা উদাস হয়ে নদীর দিকে চেয়ে থাকে। কত জল আসতো আগে। এখন মরা স্রোতে বয়। আমেনা চেয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে তার চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে। এ নদী দিয়ে আর এখন নৌকা চলাচল নেই। দুয়েকটা বালু তোলার ট্রলার সব সময় ভেসে থাকে জলের কাঁটা হয়ে। বাড়ির উত্তর-পশ্চিম কোণে বেইলি ব্রিজ, তার পশ্চিমে কিছু অংশ দূরে বালু উত্তোলন চলে।
রান্না করতে করতে আমেনা গুনগুন করে গানটি গায় এবং তরকারিতে লবণ কম হওয়ায় পুনরায় লবণ দেয়। হঠাৎ তার মনটি উদাস হয়ে যায়। বিকেলে যে বাগান থেকে সবজি তুলেছিল, তা ছিল তার মেয়ে মেরির। ছোট্ট মেয়ে মেরি। তাকেও সে গানটি শিখিয়েছিল। আধো আধো বোলে গাইতো মেয়েটি। আজ তার স্মৃতিধুলো পরে আছে, পরে আছে। শুধু সে নেই।
হঠাৎ ভাতের পানি উতরে পড়লে আমেনার সম্ভিত আসে। সে চুলার লাকড়িটা টেনে নেয়। আগুনের আঁচ কমলে ভাতেরও বুদ্বুদ কমতে থাকে। আমেনা কাঠি দিয়ে ভাত তুলে দেখে। না, সন্ধ্যা নামার আগে আগেই সে সব কাজ করতে পারবে।
তখন তেইশ আর মেরির ছিল চার। ছোট ছোট হাত দিয়ে সে মায়ের সাথে গাছে জল দিতো। আজ তা পরিপূর্ণ, শুধু মেরি নেই।
গতবছর এমন দিনে মেরির জন্মদিন ছিল। ঠিক সেদিনই ঘটলো অঘটনটা। একটা ফুটফুটে মেয়ে বাড়ির কাছে নদীর হদিস পেল। তার অচেনায় অলৌকিক হতে ভয় পায় না। নদীর কাছাকাছি নেমে আসে। তারপর জলের কাছাকাছি। সেবারও দুয়েকটা মাছ ধরার স্থানীয় জেলেদের নৌকা দেখা যেত। মেরি তাদের দিকে হাত তুলে ডাকে, ‘যামু চান্দের দেশ…।’ মাঝিরা খিলখিলিয়ে হেসে চলে যায়। হয়তো চোখেও পড়ে না তাদের ছোট হাতের আহ্বান। মেরি হারায়। জলতলার নিচে, আরও আরও গভীরে, অন্ধকারে সে তলিয়ে যায়। বাড়িজুড়ে হাহাকার, তাবিজ কবজ এনে কেউ বাঁধে হাতে। কেউ পাশে উপজেলা সদরের হাসপাতালে নিতে চায়। বাবা মা ভয়ে ছুঁয় না, হাসপাতালে নিতে নিতে দেরি হয়ে যায়। তারপর থেকে আমেনা অপ্রকৃতস্ত। শৈশবের শেখা সেই গানটি তার মনে ভাসে। সে সবসময় গানটি গায় গুনগুন করে। তবে সংসারে সময় দিতে তার কোনো কার্পন্য নেই। সবকাজই করে নিষ্ঠার সাথে। সবকিছু যতœময় হাতে গুঁছিয়ে রাখে। কেউ কিছু বুঝার উপায় নেই। সে একটু ফুসরৎ পেলে, একটু আনন্দ পেলে, একটু বেদনা কিংবা বিষাদে, একাকীত্বে গেয়ে উঠে গুনগুনিয়ে.. “ও মাঝি নৌকা ভিরাও ঘাটে, আমি যামু চান্দের দেশে।”
[গায়িকা মেরিকে পাফিনেরা সাগরপ্রাণীদের নিয়ে তীরে পৌঁছে দেয় ঠিক, তবে তীরে তার মন বসে না। সে আবার জলের বুকে ঝাঁপাতে চায়। তার যে এলোচুল ঢেউয়ের ফণায় দুলছিল, তা ছিল উল্লাসকর তার কাছে। সে এমন মধুর মোহন স্মৃতিতে আবার হারাতে চায় এবং পাফিনদের কথা অমান্য করে, সাগরের অন্যান্য প্রাণীর কথা অগ্রাহ্য করে সাগরের ঢেউয়ে ঝাঁপাতে চায়। শেষে সাগরপ্রাণীর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তাকে বেরিকেড প্রদান করা হয় এবং মাছেরা একেকটা গায়ের সাথে গা লাগিয়ে, একেকটা পাখি ডানার সাথে ডানা লাগিয়ে প্রাচীর তৈরি করে। প্রাচীরের ওপাশে গায়িকা মেরি খুব অস্থির হয়ে পড়ে। এবং তার দমবন্ধ হতে থাকে তেমনই; যেমন সে সাগরে ঝাঁপ দেওয়ার ফলে হয়েছিল। তার আরও বেশি মনে হতে থাকে তীরের হাওয়ায়। তার মনে হয়, সে এক আজন্ম জলচর, এই তীরে তার ফুল্কারোহন বাতাসের স্বাদে অমৃত ছড়ায় না দেহে। ফলে সে মাছের মতো বালির উপরে ঝাঁপটাতে থাকে এবং কিছুক্ষণ তড়পাতে তড়পাতে তার দেহ থেকে প্রাণমীন উড়ে গিয়ে সাগরে মিশে যায়।]
ভাটির দেশের কথা ছিল আমেনার। কিন্তু দেশটি এখন উন্নত। তার বাড়ির পাশেই থানা, তারপাশে সুদৃশ্য রোড ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে রোডটিকে ছুঁয়েছে। আমেনা নদী দেখে। তার রান্নাঘর থেকেও ঘাড় কাত করলে নদী দেখা যায়। বাড়ি ছুঁয়ে নদী। তার ওপরে টিনের ঘরে। ঘরে শূূন্যতা। বিয়ে হয়েছে তিন-চারে বারো বছর। ওই একটিই হয়েছিল গর্বের ধন। বিয়ের সাত বছর পরে।
গানটি যখন গায়, তখন তার শরীরের রোম শিহরিত হয়ে ওঠে। যখন সে গায়, অজানা আনন্দে, আপ্যায়নে সে বিভোর হয়ে যায়। কোথায় যায়? সে যায়, সে নিজেও জানে না। কিছুক্ষণের জন্য তার নিজেকে ভারহীন, আনন্দ কিংবা দ্বিধাহীন, ভয়ডর হীন, বেদনাহীন এক অবস্তুর মতো লাগে। তখন সে ভেতর থেকে, কোনো অপুরের অপার থেকে গেয়ে ওঠে, কোন সে হৃদয়? আমেনা দেখে, তার হাতে কড়াইয়ে মসলা মাখাচ্ছে সবজিগুলো। খুন্তির খোঁচায় তার মশলাগুলো মিশে যাচ্ছে তরকারির নরম দেহে। আমেনার চোখ ঝাঁপসা হয়ে ওঠে। বাড়ির পাশে ঝড়ে একাংশ ভাঙা শীলকড়ুইয়ের মগডালে একটি ডানাভাঙা গাঙচিল প্রতিদিনের মতো এসে রাতের বিশ্রাম নেয়। বেলা নেমে এলে আমেনা রান্নাবান্না সেরে চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরোয়।