মেহেজাবিন নেছা : ঘন ঘন মুড সুইং এর বাতিক। এই মন ভালো তো এই খারাপ। খুব খুশি খুশি লাগছে। গুন গুন করে গান করছি। গানের গলা ভালোনা। সুর এদিক সেদিক হয় বারবার। কিন্তু একা থাকায় গলা খুলে গান করি তাও। অন্যের টিটকারী শোনার ভয় নেই। একা থাকার মজা এখানেই। মন ভালো অথবা খারাপ পুরোটাই নিজস্ব। সুইচ অন বা অফ্ যাই করি নিজের মর্জিতে।
এই মুহূর্তে মন ভালো। গান ধরেছি – ‘আমায় নাহি গো ভালোবেসো মোর গান।…’ মন ভালো হওয়ার জন্য বড় কোনো কারণ লাগেনা।
আজ আব্বু প্রথমবারের মতো ফোনে মিসড কল দিয়েছে। বাবারা আবার ফোনে কখনও মিসড কল দেয় নাকি! বা এ আর আহমারি কি মনে হতে পারে অনেকের কাছে। কিন্তু আমার কাছে এটা খুব স্পেশাল।
আমার বয়স চব্বিশ। আর আমি মোবাইল ব্যাবহার করি ছয় বছর ধরে। এই দীর্ঘ সময়ে আমার বাবা আমাকে কখনও মিসড কল দেয়নি। সময়টা ২০১৫। আমার হাতে প্রথম মোবাইল। আমি বাসা থেকে একশো কিলোমিটার দূরের একটা ছোট্ট রুমে একগাদা জিনিসপত্র নিয়ে হাজির। পৌঁছেই বাবার কল। ‘সবকিছু ঠিকঠাক নিয়েছিস!’ একমাত্র বাবা। যে আমাকে নিয়মিত কল করতো। কি করছি। কোথায় যাচ্ছি। সুস্থ্য আছি কিনা! খাবারে অনিয়ম হচ্ছে কিনা। টিচার আর বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে অসুবিধে হচ্ছে কিনা! এমন খুঁটিনাটি নানান প্রশ্ন। রেগুলার।
কণ্ঠস্বরে কি ভীষণ উদ্বিগ্নতা যখন হুট করেই অসুখ বাঁধিয়ে বসি। কেমন করে যেন শুধু একবার বাবা বলে ডাকলেই বুঝে নেয় আমি ভালো নাকি মন্দ আছি!
যে আমাকে আমার মা নেই এই অভাবটা কখনও সেভাবে বুঝতে দেয়নি। আগলে রেখেছে পুরোটা দিয়ে। আমার সেই আদরের বাবা যাকে কখনও সামনাসামনি বলা হয়নি নিজের চেয়েও কত্ত বেশি ভালোবাসি তাকে।
এমন করেই বছরের পর বছর কেটেছে। আগের মতো নিয়মিত কথা হয়না ফোনে। বাবার ইলেকট্রিক ডিভাইসের প্রতি আসক্তি নেই খুব একটা। সে বুঝে গেছে আমি এখন একাই চলতে পারি। এজন্য আগের মতো উদ্বিগ্ন হয় না খুব সম্ভবত। অথবা আমার কাছে প্রকাশ করতে দ্বিধা কাজ করে!
কিন্তু এখনও সামান্য অসুস্থ্য হলেই হুট করে একশো কিলোমিটার দূরে বসে আমার অসুস্থতার গন্ধ পায়। দুদিন তিনদিন কোনো কল নেই। হুট করেই সে সময়টাতে আমার কাছে কল আসে। কণ্ঠে উদ্বেগ থাকে। ধমকের মতো করে বলে – ‘ফের অনিয়ম!’ আমি হাসি তখন। আর বলি ‘বাবার মেয়ে যে! তুমি তো আর অন্যরকম কেউ না। নিয়ম মেনে কদিন চলো শুনি!’ বাবাও হয়তো মনে মনে হাসে। কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তা বজায় থাকে।
আমার বয়স তখন বারো। পড়ে যেয়ে মাথা ফাটিয়েছি। ফিনকির মতো করে রক্ত ছিটকে পড়ছে। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছেনা রক্ত। বাবা কোলে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। আমি কতখানি কেঁদেছিলাম মনে নেই। তবে আব্বুর সেই প্রথম উচ্চস্বরে কান্না আমার বুকে আজও বিধে আছে। অথচ ক্ষত শুকিয়ে আসতেই কঠিন ধমক। তোমার জন্য কত ধকল গেলো। একটু দেখে পথ চলতে পারোনা!
আমার বাবা। আমার সেই বাবা। গত ছয় বছরে যে আমাকে মিসড কল দেয়নি। সে মিসড কল দিয়েছে। বলেছে – ফোনে ব্যালান্স শেষ হয়ে গেছে। তাই মিসড কল দিয়েছিলাম।
ঠিক বাচ্চাদের মতো স্বীকারোক্তি। অথচ আমি জানতে চাইনি। আমার বাবা এইযে দিনদিন বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে এই বাচ্চাটা আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে তার সবকিছু। বলতে ইচ্ছে করে – এইযে আজকের এই আমি। যতখানি সফল তার পুরোটা তোমার। আর যেটুকু ভুল সে একান্ত আমার।
আমার বাবা খুব সরল। আমার বান্ধবী একবার আমার বাসায় বেড়াতে গেছিল আমার সঙ্গে। সে ফিরে এসে খুব আশ্চর্য ভঙ্গিমায় বলেছিল -’ তোর বাবা কান্না করছিল আমার কাছে।’ ‘অসুস্থ্য মেয়েটা তোমাদের কাছে থাকে। দেখে রেখো সবাই মিলে।’ ‘কত ভালোবাসে রে তোকে!’
আমার স্কুল কলেজের টিচাররা আমার বাবাকে সমস্ত শিক্ষার্থীর বাবাদের ভেতরে সেরা বাবা বলে সম্বন্ধন করতো। অথচ সে আমাকে আজ পর্যন্ত কখনও পড়তে বসতে বলেনি। বরং বেশি রাত করে পড়লে কাছে এসে খুব নরম গলায় বহুবার বলেছে – ‘অনেক হয়েছে। এখন ঘুমো যেয়ে। কাল ভোরে উঠে আবার পড়তে বসিস নাহয়!’ রেজাল্ট এদিক সেদিক হলে – রাগারাগি না করে বরং রেজাল্ট যেন তার খারাপ হয়েছে এমন অপরাধীর মতো করে আমার পাশে দাঁড়াত। এরপর বলতো – ‘সামনের পরীক্ষায় নিশ্চিত ভালো করবে। মন খারাপের কিছু হয়নি।’
আমার বাবা আমার কাছে আমার সবকিছু। অথচ তাকে কখনও বলা হয়নি এইযে তুমি এখন নিয়মিত কল করোনা আমার খুব খারাপ লাগে। আগে মাঝে মাঝে অভিমান করে বলতাম – ‘ভুলেই গেছ যে তার মেজ মেয়ে বলতে কেউ আছে।’ কিন্তু এখন আর বলা হয় না। ইচ্ছে করেই বলিনা।
এখন মনে হয় যতটুকু কথা হয় মুঠোফোনে। তার চেয়ে অনেক বেশি বলা হয়ে যায় মনে মনে। হয়ত আমার মতো খাবারের প্রথম লোকমা মুখে নিয়ে ভাবে ‘মেয়েটা খেয়েছে তো!’ সারাদিন মনে মনে কতবার বাবাকে ডাকি। পরিবারবিহীন একলা একার ঘর। নিরব ঘরে একটা মেয়ে। মেয়েটার মনে আরেকটা ঘর। যেই ঘরটাতে বাস করে একটা সুখী পরিবার। মা। বোন। ভাই। আর বাবা। আর সব কাছের লোক।
নেই। অথচ পুরোটা জুড়েই আছে। এইতো বাবা বলছে – ‘ফ্লাক্সে গরম পানি আছে রে! থাকলে আমাকে এক গ্লাস দে তো। আর তুইও একটু গারগেল কর। দেখবি ভাল লাগবে। আর হ্যাঁ একটু লবণ দিয়ে নিস।’
কন্যাদায়গ্রস্ত এক কোটিপতি পিতা!
এম এল গনি
গ্রামের বাড়ি থেকে জাকির নামের একজন ফোন দিলেন গনি সাহেবকে। তিনি সপরিবারে কানাডায় বসবাস করেন আজ বহুদিন। তারপরও গ্রামের স্বজনদের সাথে তার যোগাযোগ দেশে বসবাসরত অনেকের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। কন্যার বিয়েতে সাহায্য দরকার জাকিরের। সে কারণেই গনি সাহেবকে ফোন দেওয়া।
বিয়েতে খরচ কত হবে জানতে চাইলে জাকির জানালেন, দেড়শ মেহমান খাওয়াতে হবে।
-এই করোনায় এতো মানুষ জড়ো করলে পুলিশ সমস্যা করবে না?
-না, কাউকে জড়ো করতে হবে না, দেড়শ মানুষের খাবারের জন্য দেড় লাখ টাকা দিয়ে দিলেই চলবে।
-কাকে দেবেন টাকাটা?
-বরপক্ষকে।
-কিন্তু, মেহমান তো খাওয়ানো আর হলো না। টাকা দিয়ে কাজ কী?
-তারা সুযোগমতো পরে খাইয়ে দেবে। এটা ওদের বিষয়; সেভাবেই কথা হয়েছে।
-বাহ! আর কী খরচ?
-হাফ ফার্নিচার, আর, ক্যাশ দিতে হবে কিছু। ছেলে ব্যবসা করবে।
-ছেলের যোগ্যতা?
-আইএ। গার্মেন্টসে চাকরি করে।
-কিসের ব্যবসা করবে সে?
-টাকা পেলে চাকরির পাশাপাশি ঝুটের ব্যবসা করতে চায়।
-ঝুট কাপড় কী কাজে লাগে?
-শীতের কাপড় বানায়।
-আচ্ছা, মেয়ের কী পড়াশোনা?
-বিএ পরীক্ষা দেবে।
-কবে পরীক্ষা?
-তিন-চার মাস পর।
-তাহলে তিন-চার মাস পর বিয়ে দেন না কেন? পরীক্ষার খরচ তো খুব বেশি না, দরকার হলে আমি দেব।
-না, না, অপেক্ষা করা যাবে না, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
-অপেক্ষা তো করলেনই, আর চার মাসে এত আপত্তি কেন?
-বিএ পাশ করে ফেললে মানুষ বলবে মেয়ের অনেক বয়স, তখন ভালো ছেলে পাওয়া কঠিন হবে।
-তাই নাকি? আর, ফেল করলে?
-ফেল তো এই মেয়ে করবে না, সে পড়ালেখায় মনোযোগী।
-আপনি কি করেন? আগে রিকশা চালাতাম, তিন বছর ধরে সিএনজি চালাই। অনেকদিন টাকা জমিয়ে সিএনজি কিনেছি।
-আপনার বাচ্চা-কাচ্চা কয়জন?
-তিন জন। দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেটা ছোট। এই মেয়েটাই সবার বড়ো ।
অতঃপর গনি সাহেব দেশে বসবাসরত তার এক নিকটাত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করে কয়েক হাজার টাকা নিতে বলেছেন জাকিরকে। আত্মীয়কেও টেলিফোনে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিলেন। সেই আত্মীয়ই জাকিরকে গনি সাহেবের ফোন নম্বর দিয়ে তার সাথে কথা বলতে বলেছেন।
একপর্যায়ে নিজ এলাকার এক কোটিপতি, নিজাম উদ্দিনের কথা মনে পড়লো গনি সাহেবের। ওই কোটিপতি কিছুদিন আগে কানাডা ভ্রমণের আগ্রহ প্রকাশ করে গনি সাহেবের সাথে কথা বলেছিলেন। এম এল গনি আবার কানাডার রেজিস্টার্ড ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট।
কানাডা ভিজিটের ব্যাপারে আলাপকালে গনি সাহেব কোটিপতির আর্থিক অবস্থা কেমন জানতে চেয়েছিলেন। কেননা, আর্থিক অবস্থা মজবুত না হলে ভিসা পাওয়া কঠিন। উত্তরে কোটিপতি জানিয়েছিলেন, তিনি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা করেন, একটি নিজস্ব দোতলা বাসায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন, আঠারো ফ্ল্যাটের ছয়তলা একটা ভবনের মালিক এবং বারো তলার একটা নতুন ভবন তৈরিতে হাত দেবেন দু’তিন মাসের মধ্যেই। তাছাড়া, ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র, ইত্যাদিও আছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার। বলা চলে, তিনি বেশ সচ্ছলই বটে। আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কানাডার ভিসা পাওয়ার বেশ উপযুক্তই মনে হলো তাকে।
নিজাম উদ্দিনের কথা মনে পড়ায় গনি সাহেব ভাবলেন, তার দেওয়া দশ-পনেরো হাজার টাকায় আর কি হবে, জাকিরকে বরং ওই কোটিপতির সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলে মন্দ হয় না; যদি মোটা দাগের অর্থ সহায়তা তার ভাগ্যে জুটে যায়!
নিজাম সাহেবের কথা জাকিরকে বলতেই জানা গেল, তিনি ইতিমধ্যেই তার সাথে কথা বলেছেন। কৌতূহলী হয়ে গনি সাহেব কোটিপতির সাথে জাকিরের কী কথা হয়েছে জানতে চাইলেন।
-নিজাম সাহেবের সাথে আপনার কী কথা হলো?
-তাকে মেয়ের বিয়ের কথা জানালাম। শুনে খুশি হলেন মেয়ের জন্য ভালো পাত্র পেয়েছি দেখে।
-তারপর?
-তারপর বললেন, করোনার কারণে তার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। ঠিকমতো অর্ডার শিপিং করতে না পারায় মাত্র কিছুদিন আগেও নাকি দুই কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার। ব্যাংক লোনের সুদও নাকি করোনাভাইরাসের গতিতে হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, তার নাকি তিন মেয়েই অবিবাহিত। এইসব আর কি!
-তার মেয়ের কথা কেন আপনাকে বলতে গেলেন?
-তিনি বললেন, আমি নাকি তার চেয়ে অনেক ভালো অবস্থায় আছি। কারণ, এই মেয়ের বিয়ে হলে আর মাত্র একটি মেয়ে থাকে, যেখানে উনার তিনটি মেয়েই এখনো অবিবাহিত।
-তো, আপনি বললেন না, তার তো অনেক টাকাপয়সা, মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা কী?
-না, না, অত্তোবড়ো কোটিপতির সাথে তর্ক করা আমার মানায় না, উনি কি আজকের বড়লোক? তবে বুঝলাম, টাকাপয়সা মনে হয় আগের মতো নাই। তিন মেয়ের বিয়ে নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন মনে হলো তাকে। তিনি নিজেই তো বললেন, আমি নাকি তার চেয়ে অনেক ভাগ্যবান। কথাটা কিন্তু একেবারে ভুলও না। তিনটা মেয়ের বিয়ে দিতে মেলা টাকা লাগে এ জমানায়।
-যাক, তার কাছ থেকে শেষমেশ কিছু পেলেন?
-না না; তবে, উনি বলেছেন, বছরখানেক অপেক্ষা করলে উনি কিছু দিতে পারবেন; তাও আবার করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা দেখে।
-আর কী বললেন?
-তিনি আমাকে এও বলেছেন, আমি নাকি তার কাছে সাহায্য চাইতে পেরেছি, কিন্তু, তিনি কার কাছে সাহায্য চাইবেন? তাকে যে বড়লোক বলে সবাই জানে! সত্যি বলতে কি, নিজাম সাহেবের আমার চেয়েও বেশি বেকায়দায়।
-তাহলে কী ঠিক করলেন, বছরখানেক অপেক্ষা করবেন?
-আরে না, কথাবার্তা ফাইনাল, তারিখ ফাইনাল, সবই ফাইনাল, অপেক্ষার কোনো সুযোগ আর নাই। বেশি ঠেকায় পড়লে সিএনজি বেঁচে দিয়ে আবার রিকশায় নামবো। তিনি চাইলে সিএনজি কেনার তৌফিক আবারও দিতে পারেন আমাকে। আগে মেয়েটার বিয়ে দেই। দোয়া করবেন।
গনি সাহেব নিজাম উদ্দিনের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা নিয়ে জাকিরের কাছে মুখ খুললেন না। তাছাড়া, মুখ খুলেও কাজ কী?