ঢাকা ১০:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৩ অগাস্ট ২০২৫

আমার পোশাক আমার রুচি

  • আপডেট সময় : ০৯:৪০:৪৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ১০২ বার পড়া হয়েছে

মোস্তফা হোসেইন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের সামনে কিছু শিক্ষার্থীর শোডাউন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষের বক্তব্যগুলো আঁতকে ওঠার মতো। মানুষের পোশাক নিয়ে এমন সময় কিছু শিক্ষার্থী প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ভাবনায় আসে-বড় ধরনের কোনও সামাজিক পরিবর্তন কি আসন্ন?
আমার নিজস্ব রুচি ও চিন্তার ভিত্তিতে আমার পোশাক নির্ধারিত হবে, দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান আমাকে সেই অধিকার দিয়েছে। এখন যদি আমাকে কেউ বলে– তুমি এটা পরতে পারবে না, ওটা পরতে হবে, তাকে আর যাই হোক স্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই। এর প্রতিক্রিয়া যে কী হতে পারে, তার স্পষ্ট উদাহরণ আমরা সম্প্রতি নরসিংদী রেল স্টেশনে একটি মেয়ের হেনস্থা হওয়া থেকে বুঝতে পেরেছি। এর কিছুদিন আগে টিপপরা এক মহিলাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাকেও এ ধরনের উসকানিমূলক প্রচারণারই ফল বলে আখ্যায়িত করা যায়।
আবার ভিন্নদিকও আমাদের চোখে পড়ে। হিজাব পরা মহিলার ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জঘন্য ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে। সমালোচনার এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। অশ্লীল ভাষা যেমন টিপ পরা নারীর ছবিতে হয়, অনুরূপ তিরস্কার-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এখানেও। তার মানে হচ্ছে, সংস্কৃতির প্রকাশ নয়, এখানে স্পষ্টত ধর্মীয় বিধান ও সংস্কৃতির অপপ্রয়োগ আমাদের দেখতে হচ্ছে। ধর্ম ও বাঙালি সংস্কৃতির মুখোমুখি অবস্থান এই দেশে নতুন কিছু নয়। ধর্মকে কখনও মনে করা হয়, বাঙালির মননশীলতার প্রতিপক্ষ হিসেবে। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সংস্কৃতিকে মনে করা হয় ইসলামি সংস্কৃতি হিসেবে। ইসলামি সংস্কৃতি হিসেবে যে আচরণকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলোর সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের ফারাক আছে। ধর্মীয় নির্দেশনা হিসেবে এমন কিছু নেই যা নিজ নিজ সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ হতে পারে। যদি পর্দার কথা বলি, প্রশ্ন আসে হিজাব পরার কথা কি আমাদের ধর্মীয় বিধানে আছে?
যতটা জানি ইসলামি বিধান হচ্ছে পর্দা করতে হবে। এটা নারীর জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনই পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য। কিন্তু যত বাড়াবাড়ি আছে সবই নারীকে নিয়ে হয়। মাত্র ১৫-২০ বছর আগে থেকে এই দেশে হিজাব পরা শুরু হয়েছে। সেটা হয়েছে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অনুকরণে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দাদি, নানী, মা, চাচীরা হিজাব পরতেন না। এমনকি তাদের অনেকেই শুধু শাড়ি পরেই দিনযাপন করতেন। তাদের কি পর্দাহীন বলা হবে? শাড়ি যদি সতর্কভাবে পরা হয় তাতেই মোটামুটি পর্দা মেনে চলা হয়। সেখানে সম্প্রতি আমদানিকৃত হিজাব জোর করে পরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কেন? আবার কেউ যদি সেটা পরেও, তাকে নাজেহাল করা হবে কেন? আবারও বলছি কেউ হিজাব পরলো কিংবা নিজ পছন্দ মতো অন্য কোনও পোশাক পরলো সেই জন্য তাকে নাজেহাল করার কোনও অধিকার কারো নেই। অবাক হয়ে যেতে হয়, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি চর্চাকেন্দ্র হিসেবে সবসময় মান্য হয়ে আসছে। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মেয়েদের পোশাক নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছে। আর তাদের বক্তব্য প্রচারের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় একটি শৈল্পিক ভাস্কর্যের সামনে। যে ভাস্কর্যকেও তারা ইসলামের পরিপন্থী হিসেবে মনে করে। তারা মেয়েদের পোশাক প্রস্থে দৈর্ঘ্যে কত ইঞ্চি হবে তাও কি ঠিক করে দেবে? ছোট নাকি বড় হবে এমন চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজু ভাস্কর্যে যারা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছে তারা এমন কাজের কোনও অনুমতি গ্রহণ করেনি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, যারা ধর্মের বিধানকে মানার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, তারা নিজেরা কি বিধান মানছে? অনুমতি ছাড়া যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ কিংবা এধরনের কর্মসূচি পালন করা যায় না, সেখানে অনুমতি না নিয়ে প্রতিবাদ কিংবা আহ্বান জানানোর কর্মসূচি কি অবৈধ নয়? স্পষ্টত বলতে হবে এই মুহূর্তে দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ উসকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে কিছু প্রশ্নও আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৫১ বছরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির ঢুকতে পারেনি। সেই ছাত্র শিবিরের কিছু ব্যক্তিকেও নাকি এসব কাজে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। যেমন আরও কিছু ছাত্র সংগঠনের নামও শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, সাধারণ মানুষ এই প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। এই পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল নাগরিকদের ভূমিকা আলোচনায় আসতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। বিশেষ করে প্রগতিশীল দাবিদার কিছু ছাত্র সংগঠনের কথা বলা যায়। তারা এ ধরনের কাজের প্রতিবাদ কিন্তু ওই অর্থে করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা বুদ্ধিজীবীদের কথাও আমাদের বলতে হবে। তারা এখনও চুপ কেন তেমন বিষয়টিও আমাদের ভাবনায় আসে।

বলা হচ্ছে, ছোট কাপড় পরলে যৌন হয়রানি হতে পারে? বর্তমান বাস্তবতা এমন চিন্তাকে কি উড়িয়ে দেয় না? এমন হলে হিজাব-বোরকা পরা কোনও মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা নয়। আমরা কি নোয়াখালীর নুসরাতের কথা ভুলে গেছি। আমাদের চোখে পড়ে আজ এখানে তো কাল ওখানে কিছু মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছেলে কিংবা মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যদি ছোট কাপড়ই যৌন হয়রানির কারণ হয়ে থাকে তাহলে বড় কাপড়ের ছেলে-মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হবে কেন? আসলে একটি গোষ্ঠী রিলিজিয়াস রেসিজম বা ধর্মীয় সন্ত্রাস মাধ্যমে দেশে উশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সাধুবাদ জানানোর মতো বক্তব্য তার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই ঢুকছে, তাকে কি রদ করার কথা ভাবছেন তাঁরা। তিনি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তিনি উদ্যোগ নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মান্ধদের ভর্তি সঙ্কোচিত হবে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক মেসবাহ কামালের একটা বক্তব্য স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ভর্তি নীতিমালায় এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৮০ মার্কস পর্যন্ত যোগ করার বিধান থাকার সুযোগ গ্রহণ করছে একটি গোষ্ঠী। তারাই বিশ্ববিদ্যালয়কে মাদ্রাসায় রূপান্তরের চেষ্টা করছে। একজন শিক্ষাবিদের এমন পর্যবেক্ষণকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা যারা ক্ষুণ্ন করতে চায় তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

শেখ হাসিনাকে কোনোদিনই বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেবো না: মির্জা ফখরুল

আমার পোশাক আমার রুচি

আপডেট সময় : ০৯:৪০:৪৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

মোস্তফা হোসেইন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের সামনে কিছু শিক্ষার্থীর শোডাউন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষের বক্তব্যগুলো আঁতকে ওঠার মতো। মানুষের পোশাক নিয়ে এমন সময় কিছু শিক্ষার্থী প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছে যখন সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ভাবনায় আসে-বড় ধরনের কোনও সামাজিক পরিবর্তন কি আসন্ন?
আমার নিজস্ব রুচি ও চিন্তার ভিত্তিতে আমার পোশাক নির্ধারিত হবে, দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান আমাকে সেই অধিকার দিয়েছে। এখন যদি আমাকে কেউ বলে– তুমি এটা পরতে পারবে না, ওটা পরতে হবে, তাকে আর যাই হোক স্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই। এর প্রতিক্রিয়া যে কী হতে পারে, তার স্পষ্ট উদাহরণ আমরা সম্প্রতি নরসিংদী রেল স্টেশনে একটি মেয়ের হেনস্থা হওয়া থেকে বুঝতে পেরেছি। এর কিছুদিন আগে টিপপরা এক মহিলাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাকেও এ ধরনের উসকানিমূলক প্রচারণারই ফল বলে আখ্যায়িত করা যায়।
আবার ভিন্নদিকও আমাদের চোখে পড়ে। হিজাব পরা মহিলার ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জঘন্য ভাষা প্রয়োগ করা হচ্ছে। সমালোচনার এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। অশ্লীল ভাষা যেমন টিপ পরা নারীর ছবিতে হয়, অনুরূপ তিরস্কার-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এখানেও। তার মানে হচ্ছে, সংস্কৃতির প্রকাশ নয়, এখানে স্পষ্টত ধর্মীয় বিধান ও সংস্কৃতির অপপ্রয়োগ আমাদের দেখতে হচ্ছে। ধর্ম ও বাঙালি সংস্কৃতির মুখোমুখি অবস্থান এই দেশে নতুন কিছু নয়। ধর্মকে কখনও মনে করা হয়, বাঙালির মননশীলতার প্রতিপক্ষ হিসেবে। পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সংস্কৃতিকে মনে করা হয় ইসলামি সংস্কৃতি হিসেবে। ইসলামি সংস্কৃতি হিসেবে যে আচরণকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এগুলোর সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের ফারাক আছে। ধর্মীয় নির্দেশনা হিসেবে এমন কিছু নেই যা নিজ নিজ সংস্কৃতির প্রতিপক্ষ হতে পারে। যদি পর্দার কথা বলি, প্রশ্ন আসে হিজাব পরার কথা কি আমাদের ধর্মীয় বিধানে আছে?
যতটা জানি ইসলামি বিধান হচ্ছে পর্দা করতে হবে। এটা নারীর জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনই পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য। কিন্তু যত বাড়াবাড়ি আছে সবই নারীকে নিয়ে হয়। মাত্র ১৫-২০ বছর আগে থেকে এই দেশে হিজাব পরা শুরু হয়েছে। সেটা হয়েছে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অনুকরণে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দাদি, নানী, মা, চাচীরা হিজাব পরতেন না। এমনকি তাদের অনেকেই শুধু শাড়ি পরেই দিনযাপন করতেন। তাদের কি পর্দাহীন বলা হবে? শাড়ি যদি সতর্কভাবে পরা হয় তাতেই মোটামুটি পর্দা মেনে চলা হয়। সেখানে সম্প্রতি আমদানিকৃত হিজাব জোর করে পরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কেন? আবার কেউ যদি সেটা পরেও, তাকে নাজেহাল করা হবে কেন? আবারও বলছি কেউ হিজাব পরলো কিংবা নিজ পছন্দ মতো অন্য কোনও পোশাক পরলো সেই জন্য তাকে নাজেহাল করার কোনও অধিকার কারো নেই। অবাক হয়ে যেতে হয়, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি চর্চাকেন্দ্র হিসেবে সবসময় মান্য হয়ে আসছে। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মেয়েদের পোশাক নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছে। আর তাদের বক্তব্য প্রচারের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় একটি শৈল্পিক ভাস্কর্যের সামনে। যে ভাস্কর্যকেও তারা ইসলামের পরিপন্থী হিসেবে মনে করে। তারা মেয়েদের পোশাক প্রস্থে দৈর্ঘ্যে কত ইঞ্চি হবে তাও কি ঠিক করে দেবে? ছোট নাকি বড় হবে এমন চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য কী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজু ভাস্কর্যে যারা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেছে তারা এমন কাজের কোনও অনুমতি গ্রহণ করেনি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, যারা ধর্মের বিধানকে মানার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, তারা নিজেরা কি বিধান মানছে? অনুমতি ছাড়া যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ কিংবা এধরনের কর্মসূচি পালন করা যায় না, সেখানে অনুমতি না নিয়ে প্রতিবাদ কিংবা আহ্বান জানানোর কর্মসূচি কি অবৈধ নয়? স্পষ্টত বলতে হবে এই মুহূর্তে দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ উসকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে কিছু প্রশ্নও আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৫১ বছরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির ঢুকতে পারেনি। সেই ছাত্র শিবিরের কিছু ব্যক্তিকেও নাকি এসব কাজে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। যেমন আরও কিছু ছাত্র সংগঠনের নামও শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, সাধারণ মানুষ এই প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। এই পরিস্থিতিতে প্রগতিশীল নাগরিকদের ভূমিকা আলোচনায় আসতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও প্রগতিশীল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। বিশেষ করে প্রগতিশীল দাবিদার কিছু ছাত্র সংগঠনের কথা বলা যায়। তারা এ ধরনের কাজের প্রতিবাদ কিন্তু ওই অর্থে করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা বুদ্ধিজীবীদের কথাও আমাদের বলতে হবে। তারা এখনও চুপ কেন তেমন বিষয়টিও আমাদের ভাবনায় আসে।

বলা হচ্ছে, ছোট কাপড় পরলে যৌন হয়রানি হতে পারে? বর্তমান বাস্তবতা এমন চিন্তাকে কি উড়িয়ে দেয় না? এমন হলে হিজাব-বোরকা পরা কোনও মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা নয়। আমরা কি নোয়াখালীর নুসরাতের কথা ভুলে গেছি। আমাদের চোখে পড়ে আজ এখানে তো কাল ওখানে কিছু মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছেলে কিংবা মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যদি ছোট কাপড়ই যৌন হয়রানির কারণ হয়ে থাকে তাহলে বড় কাপড়ের ছেলে-মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হবে কেন? আসলে একটি গোষ্ঠী রিলিজিয়াস রেসিজম বা ধর্মীয় সন্ত্রাস মাধ্যমে দেশে উশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সাধুবাদ জানানোর মতো বক্তব্য তার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা আইনানুগ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই ঢুকছে, তাকে কি রদ করার কথা ভাবছেন তাঁরা। তিনি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তিনি উদ্যোগ নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মান্ধদের ভর্তি সঙ্কোচিত হবে। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক মেসবাহ কামালের একটা বক্তব্য স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ভর্তি নীতিমালায় এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর থেকে ৮০ মার্কস পর্যন্ত যোগ করার বিধান থাকার সুযোগ গ্রহণ করছে একটি গোষ্ঠী। তারাই বিশ্ববিদ্যালয়কে মাদ্রাসায় রূপান্তরের চেষ্টা করছে। একজন শিক্ষাবিদের এমন পর্যবেক্ষণকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা যারা ক্ষুণ্ন করতে চায় তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।