চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি এলাকায় ছয় দুর্বৃত্তের খপ্পর থেকে এক যুবতীকে বাঁচাতে পুলিশকে ফোন করেছিলেন রিকশাচালক আবদুল হান্নান। এরপর পুলিশ গিয়ে ওই যুবতীকে উদ্ধার ও তিনজনকে গ্রেফতার করে। পরে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় রিকশাচালক আবদুল হান্নানকে পুরস্কৃত করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার।
কুমিল্লার চান্দিনা এলাকার বাসিন্দা আবদুল হান্নান চট্টগ্রাম মহানগরীতে নয় বছর ধরে রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। তার দুই সন্তানের একজন সদ্য ভূমিষ্ঠ। অন্যজন মাদরাসায় পড়ছে। ঘটনার রাতে নিজের মা-বোনের কথা মনে করেই ধর্ষকদের হাত থেকে ভিকটিম যুবতীকে রক্ষা করতে পুলিশে ফোন দিয়েছিলেন হান্নান।
গতকাল বুধবার বিকেলে নগরীর বায়েজিদ শেরশাহ বাংলাবাজার এলাকায় কথা হলে জাগো নিউজকে ঘটনার বিবরণ দেন হান্নান। তিনি বলেন, নাগরিক দায়িত্ব হিসেবেই আমি ওই নারীকে উদ্ধারে এগিয়ে আসি। আমার মতো অন্যরা এগিয়ে এলে দেশ আরও সুন্দর হবে। এর আগে রোববার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে জিইসি মোড় এলাকায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ৩০ বছর বয়সী এক যুবতী। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। জিইসি মোড় এলাকায় কয়েকজন মাদকাশক্ত যুবক রিকশার গতিরোধ করে ওই যুবতীকে জোর করে নামিয়ে পাশের গলিতে নিয়ে যান। সেখানে ছয় যুবক তাকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ করেছেন ওই যুবতী।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে রিকশাচালক আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমি রাতে ষোলশহর দুই নম্বর গেট থেকে খালি রিকশা নিয়ে জিইসি মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন আরেক রিকশাচালক। বাটা গলির দিকে যেতেই তিন যুবক রিকশাটির সামনে এসে দাঁড়ান। এসময় যুবতীর সঙ্গে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে জোর করে পাশের গলির ভেতরে নিয়ে যান। দৃশ্যটি দেখে আমি সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯-এ কল দেই। প্রায় ১৫ মিনিট পরে পুলিশ সদস্যরা এসে জিইসি মোড় এলাকায় আমাকে কল দেন। আমি ওই গলিটি দেখিয়ে দেই, যেখানে ওই নারীকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পুলিশ গিয়ে হাতেনাতে তিনজনকে ধরে ফেলে। এসময় ওই যুবতীর সঙ্গে কথা বলে ওই তিনজনকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।’
হান্নান বলেন, মোবাইল ফোনে কল করলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসে আমি সেটি জানতাম না। কোন নম্বরে কল দিতে হয় সেটিও জানতাম না। ৫-৬ বছর আগে আমার এক বন্ধু দুর্ঘটনায় পড়ে। তখন সে পুলিশকে কল দেয়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। পরে আমি ওই বন্ধুর কাছে জেনেছিলাম সে ট্রিপল নাইন-এ (৯৯৯) কল দিয়েছিল। সে আমাকে জানিয়েছিল, ৯৯৯-এ কল দিতে কোনো খরচ হয় না। কোনো দুর্ঘটনা, হামলায় পড়লে ৯৯৯-এ কল দিলে স্থানীয় থানায় সহজে যোগাযোগ করা যায়। এতে দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। এ রিকশাচালক আরও বলেন, নাগরিক হিসেবে আমার যে দায়িত্ব আছে, আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি। ওই জায়গায় ওই মেয়েটি না হয়ে যদি আমার মা হতো, আমার বোন হতো, যদি আমার স্ত্রী হতো, তখন আমি কি ফেলে আসতে পারতাম? এজন্য আমি ওই যুবতীর সম্মান বাঁচাতে তাকে উদ্ধারে এগিয়ে যাই। পুলিশকে ফোন করি। দেশের সব মানুষ এভাবে যদি এগিয়ে আসে তাহলে দেশে কোনো অন্যায় থাকবে না। সবাই যদি একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি, তাহলে দেশে খুন, রাহাজানি, চুরি, ছিনতাইও হবে না।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, রিকশাচালক আবদুল হান্নানের মতো সবাই সচেতন হলে, একে অপরের বিপদে এগিয়ে এলে দেশ অনেক সুন্দর হবে। অপরাধও কমে যাবে। কেউ বিপদে পড়লে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দিলে সুফল পাওয়া যায়। আমরা রিকশাচালকের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে টিম পাঠাই। তখন ভিকটিম নারীকে উদ্ধারের পাশাপাশি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে পালিয়ে যাওয়া অন্য তিনজনকেও গ্রেফতার করা হয়। এরপর সোমবার তিনজনকে ও অন্য তিনজনকে মঙ্গলবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ওসি জানান, রিকশাচালক আবদুল হান্নানের সাহসী কাজের জন্য তাকে সিএমপি কমিশনার পুরস্কৃত করেছেন। বুধবার সকালে তাকে সিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে ডেকে এনে পুরস্কারের অর্থ প্রদান করা হয়।
এদিকে, এ ঘটনায় গ্রেফতার ছয়জন হলেন- মো. আরিফ, আবদুর রহমান, ফারুক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, আবদুল খালেক ও মোহাম্মদ হোসেন। তাদের মধ্যে ফারুক একটি বেসরকারি হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, আরিফ হকার ও রহমান রিকশাচালক। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার ওই যুবতী বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বাদী হয়ে খুলশী থানায় ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা করেছেন।
আমারও মা-বোন আছে, একজন নারীর সম্ভ্রম বাঁচাতে পুলিশকে ফোন দিয়েছি
ট্যাগস :
আমারও মা-বোন আছে
জনপ্রিয় সংবাদ