ফারজানা কাশেমী : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী অবন্তিকা। আতœহননের কিংবা আতœহত্যা ছিল অবন্তিকার শেষ পরিনতি। আইনের ছাত্রী অবন্তিকা আইনের আশ্রয় হয়তো পেতে চেয়েছিল কিংবা আইনের আশ্রয় নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
আইন হলো-মাকড়সার জাল, যে জাল ভেদ করে বড় পাখি বের হয়ে যায় আর ছোট পাখি সেই জালে আটকে যায়। অবন্তিকা সেই ছোট পাখি হতে ব্যর্থ হয়েছে পুনঃ পুনঃ। ব্যর্থ হয়ে কিংবা বাধ্য হয়ে অবন্তিকা স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছিল।
অবন্তিকা কিশোরী কিংবা অবন্তিকার বয়স একুশ। এই বয়সে দুরন্ত, চাঞ্চল্যে ভরা জীবন হবার কথা ছিল মেয়েটির। জীবনের আয়োজন অনুভূতি ঘেরা দেয়ালে অবন্তিকার পদচারণা ছিল। অবন্তিকার শিক্ষক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভীষণ আক্ষেপের সুরে অবন্তিকার গুণের কথা বর্ণনা করেছেন। মেয়েটা ভীষণ সুন্দর ইংরেজি বলতো, অনিন্দ্যসুন্দর শব্দ চয়নে ইংরেজি লিখতো। ভিন ভাষার অসাধারণ পান্ডিত্য অবন্তিকার। অনন্যা যেন অবন্তিকা। অবন্তিকা পড়াশুনায়ও তুখোড় ছিল। ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রী ছিল। গতানুগতিক ধারার পড়াশুনায়ও অবন্তিকার ফলাফল ছিল অসাধারণ।
তবুও বাস্তবতায় আর দীর্ঘশ্বাসে আক্ষেপে অবন্তিকার মা মেয়ের মৃত্যুর পর বলেছিলেন-‘আমার মেয়ে ক্লাসের টপার ছিল এটাই কি আমার মেয়ের অপরাধ?’
দিনান্তে অবন্তিকার অর্জন শূন্য। মন্ত্রমুগ্ধ গুণের অবন্তিকা বেঁচে থাকার ন্যূনতম আয়োজন অনুভূতি প্রকাশ করে অক্সিজেন নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অবন্তিকা হেরে গেছে প্রকৃতির ভয়াল দস্যুতায়। অবন্তিকা প্রাণ হারিয়েছে নিজ বিভাগের মানুষরুপি হায়েনার ছোবলে। অবন্তিকা প্রাণ হারিয়েছে সমষ্টিগত অপশক্তির কাছে।
অবন্তিকা হেরে গেছে বেঁচে থাকার নিদারুণ নিষ্ঠুরতায়। ব্যক্তিগত যুদ্ধ কখনো সমষ্টিগত পর্যায়ে উপনীত হয়। সমষ্টির কাছে ব্যক্তি তুচ্ছ হয়। ব্যক্তি হেরে যায় আর সমষ্টি জিতে যায়। হেরে যাওয়া ব্যক্তি বিশেষকে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্রসম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নিয়তির করাল গ্রাসে যদি সেই ব্যক্তি প্রাণ হারায়, তখন তাকে আমরা অপরাধের শিকার হিসেবে সমাদর করি। এ যেন -‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’।
সভ্যতা সংস্কৃতির অংশ যেন স্বেচ্ছায় অপমৃত্যুর কুপ। অপমৃত্যুর ডায়েরি হয় এই দেশে। কিন্তু শারীরিক, মানসিক আঘাতের জন্য এদেশের বিচার ব্যবস্থায় বিচার চাওয়ার যেন সুযোগ নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বাস্তবতায় মৃত্যুর উপত্যকায় এদেশে নিগৃহীত মানুষগুলো প্রমাণ করে তারা নিগৃহীত হয়েছিল। একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য এদেশে যুদ্ধ হলেও প্রতিদিন এই দেশে বহু ফুল ঝরে যায়। ঝরে যাওয়া প্রাণগুলো অবেলায় হারিয়ে যায় ছকে বাঁধা জীবন আচারে। শাস্তি, আইনের আশ্রয়, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে পারতো যেই মেয়েটা, সেই মেয়েটাই মৃত লাশ হয়ে এদেশের আদালত ও বিচারের স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেলো।
অবন্তিকার গল্পগুলো অন্তহীন। সময়ে নিয়মে অবন্তিকার গল্প শুনার সময় হয় না কারো। একটা শ্রেণিকক্ষে একটা মেয়ে একগুঁয়ে আর বন্ধুবিহীন জীবন অতিবাহিত করছে, তা চোখ এড়িয়ে যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের। অবন্তিকার মৃত্যুর পর সে স্বীকৃতি পায় অবন্তিকা কারো সন্তান, কারো বোন, কারো সহপাঠী হয়। অথচ সবাই যেন নিরব ছিল অবন্তিকার জীবদ্দশায়!
উত্তাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অবন্তিকা বিষয়ে কিছুটা আগে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তো মূল্যবান প্রাণশক্তির অপচয় হতো না। অবন্তিকা বেঁচে থাকলে হয়তো আলোর দিশারী হতো জ্ঞানে-মানে। অবন্তিকার অকালপ্রয়াণে তার পরিবারই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তার মৃত্যুতে দেশও একজন মেধাবী শিক্ষার্থী হারালো। অবন্তিকা এই ঘুনে ধরা সমাজে সংখ্যালঘু মানুষদের একজন। তবে জীবিত অবন্তিকা হতে পারতো রাষ্ট্রের সম্পদ। সম্পদের সুষম বন্টনের অযোগ্যতায় এই নগররাষ্ট্র সর্বদা পিছিয়ে আছে। নির্দিষ্ট করে বলা হয়তো অসম্ভব, কার বা কাদের অযোগ্যতায় শ্রেণিকক্ষে ব্যক্তি বিশেষের আধিপত্য তৈরি হয় বা তা বিরাজমান। কে বা কারা শ্রেণিকক্ষে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে উস্কে দেয়, কিংবা কাদের মদদে শ্রেণিকক্ষে নৈরাজ্য বিরাজমান?
এদেশে কেন জীবদ্দশায় বিচার পাওয়া অলীক ঘটনা? মৃত্যু কেন বেছে নিতে হলো অবন্তিকাকে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেন অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে অনীহা? মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নিদের্শনা অনুযায়ী নারীর প্রতি যৌন হয়রানি নিরসনে গঠিত কমিটির কার্যকারিতা কোথায়?
আজ অবন্তিকা প্রাণ হারিয়েছে। অবন্তিকার সহপাঠীদের কেউ হয়তো বিচারে দোষী সাব্যস্ত হবে। কতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে যাবে জীবনের স্বাভাবিক পরিক্রমায়। সহপাঠীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, কোন্দলকে এড়িয়ে গিয়ে কিংবা নিরবতা পালনে প্রশাসন বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। এসব ঘটনার পর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে এই ধরনের অপরাধের বিচার কোনভাবেই কাম্য নয়। সময়মতো অপরাধ প্রবণতা রুখে দিতে পারাটাই সকলের কাম্য।
ঝরে যাওয়া অবন্তিকাদের গল্প যেন স্তব্ধ হয় চিরকালের মতো-বিশ^বিদ্যালয়ে প্রশাসন তেমন পদক্ষেপ নিক। মময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের পলিন নামের এক শিক্ষার্থী আতœহত্যা করেছিল স্বীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবাঞ্ছিত ঘটনার পর।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এদেশের মা-বাবা তার সন্তানকে শিক্ষিত হবার জন্য পাঠান। জ্ঞানের জন্য পাঠান। লাশ হবার জন্য নয়; কিংবা খুনি হবার জন্য নয়। শিক্ষাঙ্গনে লাশ হবার পুনরাবৃত্তি যেন বন্ধ হয়। শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে কোনো মাকে যেন আর বিলাপ করতে না হয়-‘আমায় অনেক বড় ডিগ্রি দিছে মা, এই ডিগ্রি বড় ভারী! মাগো সইতে নাহি পারি! লোকজনে আনবে বয়ে সাঁঝের গাড়িতে….
লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ
‘আমায় অনেক বড় ডিগ্রি দিছে মা’
ট্যাগস :
‘আমায় অনেক বড় ডিগ্রি দিছে মা’
জনপ্রিয় সংবাদ