ঢাকা ০৩:২০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

  • আপডেট সময় : ০৯:২৫:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩
  • ৮৫ বার পড়া হয়েছে

রেজাউল করিম : দঞযরহশ চড়ংরঃরাব, ইব চড়ংরঃরাব’. এমনটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ। অথচ সারাজীবন নিজের চেহারার ধুলো না মুছে কেবল আয়না মুছে যাচ্ছি। একটু ইতিবাচক মন্তব্যের অভাবে একজন পরিশ্রমী মানুষের সফলতা আটকে যেতে পারে। আবার একটু ইতিবাচক মন্তব্যে কেউ কেউ সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যায়। এমন ইতিবাচক ভাবনার বড় অভাব। বলতে চাচ্ছি হিরো আলমের কথা। যাকে নিয়ে সমাজ প্রতিনিয়ত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে যাচ্ছে। আধুনিক ট্রোলের শিকার হচ্ছেন গ্রাম থেকে উঠে আসা হিরো আলম। বিষয়টি তিনিও জানেন। না চেহারা, না শারীরিক গঠন। না শিক্ষা, না বচনভঙ্গি। এসব নিয়ে সমাজ তাকে ট্রোল করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রোলের কারণেই তিনি এখন অন্যতম পরিচিত মুখ।
আমি এর উল্টোটা ভাবছি। এতো ট্রোলের পরেও তিনি লড়ে যাচ্ছেন। বলা যায় লড়ে যাওয়া হিরো। হিরো হতে এটাই বা কম কিসের। নানা সময়ে নানা কারণে হিরো আলম হয়েছেন আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। কেউ ইতিবাচক ভাবছেন, আবার কেউ নেতিবাচক ভাবছেন। শেষ কর্ম থেকেই আসা যাক। সর্বশেষ বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৬ আসনের উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনায় এসেছেন তিনি। কোন কোন গণমাধ্যম অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল এবার এমপি হচ্ছেন হিরো আলম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এলো, বগুড়া-৪ আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন তিনি। আলমের অভিযোগ, বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ফলাফলে গ-গোল করেছে। নির্বাচন কমিশন আমার বিজয় ছিনতাই করে প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। এরপর হিরো আলমের পক্ষ থেকে এলো আরও জোরালো বক্তব্য। তিনি বললেন, আমাকে স্যার ডাকতে হবে বলে শিক্ষিত মানুষ আমাকে ভোটে হারিয়ে দিয়েছে। বক্তব্যটির সত্য মিথ্যা-যাচাই করতে যাব না। তবে কথাটা বিদারক। যেহেতু নির্বাচনি আইনে শিক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা আগেও এমপি প্রার্থীদের নির্বাচনি হলফনামায় দেখেছি কেউ কেউ স্বশিক্ষিত। সেক্ষেত্রে হিরো আলমের যোগ্যতা নিয়ে সমালোচনার সুযোগ নেই। এছাড়া গায়ক-গায়িকা-নায়িকা, নাট্যকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমন কি খেলোয়াড় বিগত দিনে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তখন কিন্তু কারও যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা উঠেনি।
তবে আলমের যোগ্যতা নিয়ে এতো আলোচনা কেন? দেশীয় পরিস্থিতির কথা তুলে রাজনীতিকে বিতর্কে ফেলব না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা অতি সাধারণ থেকে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসেছেন। আমেরিকার এক রাষ্ট্রপতি প্রথম জীবনে বাদাম বিক্রি করতেন, তা নিয়ে গর্বের শেষ নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চা বিক্রি করতেন, তাও তাদের কাছে গর্বের। নায়ক রাজ্জাকের ঢাকা শহরে থাকার জায়গা ছিল না, সেটাও চলচ্চিত্র শিল্পীদের প্রেরণা। সমস্যা সিডি বা ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলমের ক্ষেত্রে। তিনি কেন মিউজিক ভিডিও বানাবেন, নিজেকে কেন হিরো দাবি করবেন? তিনি কেন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন? এসব দাবি কতোটা যৌক্তিক?

মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা হন বিশ্বরাজা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তাদের শুরুটাও ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতার। তাদের কাছে সেই অভিজ্ঞতাগুলো ছিল প্রেরণার। দেখা যাক জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, বারাক ওবামাসহ মার্কিন প্রেসিডেন্টের জীবনের প্রথমে কি কাজ করতেন। আমেরিকান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, কৃষক পরিবারের জর্জ ওয়াশিংটন ভূমি জরিপের কাজ করতেন। মিলার সেন্টারের তথ্যমতে, আব্রাহাম লিংকন এক জেনারেল স্টোরে কেরানির কাজ করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এখান থেকেই শহরের প্রায় সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। অ্যান্ড্রু জনসন একজন শিক্ষানবিশ দর্জি ছিলেন। আততায়ীর হাতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের হত্যার সময় অ্যান্ড্র জনসন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরবর্তীতে তিনিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
রাফ আন্ড্রিস্ট-এর বই ‘এরি ক্যানাল’র তথ্যানুসারে জেমস গারফিল্ড চালাতেন খচ্চরে টানা নৌকা। বেনজামিন হ্যারিসনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, উকিল হিসেবে নিজের জীবন শুরু করার আগে তিনি আদালতের পক্ষ থেকে দিনে আড়াই ডলার পারিশ্রমিকে আদালত-চত্বরে পেশাদার হকারের কাজ করতেন। চিৎকার করে লোকজন ডাকাই ছিল তার কাজ।
দ্য উইক সাময়িকীর তথ্যমতে, ৩৬তম প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন মুচির কাজ করতেন। পরে তিনি তার এক চাচার খামারে রাখালের কাজ করেন। দ্য উইক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম এই প্রেসিডেন্ট কসাইয়ের দোকানে মুরগির চামড়া ছাড়ানোর কাজ করতেন। দ্য উইকের তথ্যমতে, ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সার্কাসের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। সংবাদ মাধ্যম পিবিএসের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আরকানসায় এক মুদি দোকানে কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাস্কিন-রবিন্সের হনুলুলু শাখায় একজন আইসক্রিম বিক্রেতা ছিলেন। বিশ্ব রাজাদের এমন অতীত হলে আলমকে নিয়ে এতো সমালোচনা কেন? আশরাফুল আলম বগুড়ার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আশরাফুল আলম সাঈদ সিডি ব্যবসা, ডিশ ব্যবসার এক পর্যায়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে হয়ে উঠেছেন হিরো আলম। নিজের বানানো মিউজিক ভিডিওতে নিজেই হিরো। নিজেকে হিরো ভাবাটাই কি হিরো আলমের দোষ?
‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, আমরা সমাজকে বদলে দেবো’ নামে হিরো আলম একটি বই লিখেছেন। বইটিতে স্বশিক্ষিত একজন হিরো আলম সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন-আমরা কোন পথে আছি। বইটির আলোচিত দশটি লাইন এরকম-
১. আপনারা শিক্ষিত কাগজে-কলমে, মনুষ্যত্বের শিক্ষা শিক্ষিত লোকের মাঝে তেমন একটা নাই।
২. আমি অশিক্ষিত হয়ে লাত্থি উস্টা খেয়েও বেঁচে আছি, আপনারা শিক্ষিতরা কেন আত্মহত্যা করেন?
৩. আমার চেহারাটা নিয়ে আর কী বলবেন? আল্লাহই তো আমারে বানাইছে। আমি তো বানাই নাই। আমি কী করব? এই চেহারা চেঞ্জ তো করতে পারব না।
৪. জীবনের সব ব্যবসা আমি টাকা দিয়ে করেছি, শুধু নির্বাচন ছাড়া।
৫. শিক্ষিতরা যে আমারে নিয়ে মজা করেন, আমার জায়গায় থাকলে তো রিকশা চালায়ে খাইতেন। আমি তো তাও চেহারা খারাপ বলে মিডিয়ায় আইছি, আপনার তো চেহারা মোটামুটি। আপনি তো তাও পারতেন না।
৬. আমি আমার ভক্ত গো একবার ধন্যবাদ দিলে সমালোচক গো দুইবার ধন্যবাদ দিই। তারা আমার ভিডিও খিয়াল করে দেখে। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও দেখে, উইঠেও দেখে।
৭. সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোক হইলো ভীতু। নিজেরা তো কিছু করবেই না, কেউ করতে দেখলেও গা জ্বলে। এরা যে কি চায় নিজেরাই জানে না।
৮. আমি পরিত্যক্ত সন্তান হয়ে চানাচুর বেচে, সিডি, ডিশ লাইন, মিউজিক ভিডিও করে ১০-১৫টা মানুষের দায়িত্ব নিতে পারি, আপনি শিক্ষিত হয়ে কিছু পারেন না কেন?
৯. আমি হিরো আলম আমার ভিডিও দেখে খালি মানুষ হাসবে এই জন্যে কাজ করি। আমার মাইনসের হাসিমুখ দেখতেই ভালো লাগে। এই সব ভাইরাল, সমালোচনা এসবের জন্যে কাজ করি না।
১০. আমি সকল বিধবা মা, পরিত্যক্ত নারী ও শিশুদের জন্যে একটা সংস্থা করে যেতে চাই। যাতে, আমার মায়ের মতো কারো মার যেন মাইর খেয়ে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে রাত কাটানো না লাগে।
আমরা অনেকেই যা পারছি না, হিরো আলম সেটা করার চেষ্টা করছেন। তার চেষ্টাটাই বা কম কিসের? আলমের চেহারাটাই কি সমস্যা? আসলে এগুলো কোনো সমস্যাই না। সমস্যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। অতএব সবক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

আপডেট সময় : ০৯:২৫:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

রেজাউল করিম : দঞযরহশ চড়ংরঃরাব, ইব চড়ংরঃরাব’. এমনটাই আমাদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ। অথচ সারাজীবন নিজের চেহারার ধুলো না মুছে কেবল আয়না মুছে যাচ্ছি। একটু ইতিবাচক মন্তব্যের অভাবে একজন পরিশ্রমী মানুষের সফলতা আটকে যেতে পারে। আবার একটু ইতিবাচক মন্তব্যে কেউ কেউ সফলতার চূড়ায় পৌঁছে যায়। এমন ইতিবাচক ভাবনার বড় অভাব। বলতে চাচ্ছি হিরো আলমের কথা। যাকে নিয়ে সমাজ প্রতিনিয়ত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে যাচ্ছে। আধুনিক ট্রোলের শিকার হচ্ছেন গ্রাম থেকে উঠে আসা হিরো আলম। বিষয়টি তিনিও জানেন। না চেহারা, না শারীরিক গঠন। না শিক্ষা, না বচনভঙ্গি। এসব নিয়ে সমাজ তাকে ট্রোল করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রোলের কারণেই তিনি এখন অন্যতম পরিচিত মুখ।
আমি এর উল্টোটা ভাবছি। এতো ট্রোলের পরেও তিনি লড়ে যাচ্ছেন। বলা যায় লড়ে যাওয়া হিরো। হিরো হতে এটাই বা কম কিসের। নানা সময়ে নানা কারণে হিরো আলম হয়েছেন আলোচনা-সমালোচনার বিষয়। কেউ ইতিবাচক ভাবছেন, আবার কেউ নেতিবাচক ভাবছেন। শেষ কর্ম থেকেই আসা যাক। সর্বশেষ বগুড়া-৪ ও বগুড়া-৬ আসনের উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়ে আলোচনায় এসেছেন তিনি। কোন কোন গণমাধ্যম অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল এবার এমপি হচ্ছেন হিরো আলম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এলো, বগুড়া-৪ আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন তিনি। আলমের অভিযোগ, বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ফলাফলে গ-গোল করেছে। নির্বাচন কমিশন আমার বিজয় ছিনতাই করে প্রতিপক্ষকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। এরপর হিরো আলমের পক্ষ থেকে এলো আরও জোরালো বক্তব্য। তিনি বললেন, আমাকে স্যার ডাকতে হবে বলে শিক্ষিত মানুষ আমাকে ভোটে হারিয়ে দিয়েছে। বক্তব্যটির সত্য মিথ্যা-যাচাই করতে যাব না। তবে কথাটা বিদারক। যেহেতু নির্বাচনি আইনে শিক্ষার বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা আগেও এমপি প্রার্থীদের নির্বাচনি হলফনামায় দেখেছি কেউ কেউ স্বশিক্ষিত। সেক্ষেত্রে হিরো আলমের যোগ্যতা নিয়ে সমালোচনার সুযোগ নেই। এছাড়া গায়ক-গায়িকা-নায়িকা, নাট্যকার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এমন কি খেলোয়াড় বিগত দিনে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তখন কিন্তু কারও যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা উঠেনি।
তবে আলমের যোগ্যতা নিয়ে এতো আলোচনা কেন? দেশীয় পরিস্থিতির কথা তুলে রাজনীতিকে বিতর্কে ফেলব না। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধানের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা অতি সাধারণ থেকে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারে বসেছেন। আমেরিকার এক রাষ্ট্রপতি প্রথম জীবনে বাদাম বিক্রি করতেন, তা নিয়ে গর্বের শেষ নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চা বিক্রি করতেন, তাও তাদের কাছে গর্বের। নায়ক রাজ্জাকের ঢাকা শহরে থাকার জায়গা ছিল না, সেটাও চলচ্চিত্র শিল্পীদের প্রেরণা। সমস্যা সিডি বা ডিশ ব্যবসায়ী হিরো আলমের ক্ষেত্রে। তিনি কেন মিউজিক ভিডিও বানাবেন, নিজেকে কেন হিরো দাবি করবেন? তিনি কেন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন? এসব দাবি কতোটা যৌক্তিক?

মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা হন বিশ্বরাজা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তাদের শুরুটাও ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতার। তাদের কাছে সেই অভিজ্ঞতাগুলো ছিল প্রেরণার। দেখা যাক জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, বারাক ওবামাসহ মার্কিন প্রেসিডেন্টের জীবনের প্রথমে কি কাজ করতেন। আমেরিকান স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, কৃষক পরিবারের জর্জ ওয়াশিংটন ভূমি জরিপের কাজ করতেন। মিলার সেন্টারের তথ্যমতে, আব্রাহাম লিংকন এক জেনারেল স্টোরে কেরানির কাজ করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন এখান থেকেই শহরের প্রায় সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। অ্যান্ড্রু জনসন একজন শিক্ষানবিশ দর্জি ছিলেন। আততায়ীর হাতে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের হত্যার সময় অ্যান্ড্র জনসন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। পরবর্তীতে তিনিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
রাফ আন্ড্রিস্ট-এর বই ‘এরি ক্যানাল’র তথ্যানুসারে জেমস গারফিল্ড চালাতেন খচ্চরে টানা নৌকা। বেনজামিন হ্যারিসনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, উকিল হিসেবে নিজের জীবন শুরু করার আগে তিনি আদালতের পক্ষ থেকে দিনে আড়াই ডলার পারিশ্রমিকে আদালত-চত্বরে পেশাদার হকারের কাজ করতেন। চিৎকার করে লোকজন ডাকাই ছিল তার কাজ।
দ্য উইক সাময়িকীর তথ্যমতে, ৩৬তম প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন মুচির কাজ করতেন। পরে তিনি তার এক চাচার খামারে রাখালের কাজ করেন। দ্য উইক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম এই প্রেসিডেন্ট কসাইয়ের দোকানে মুরগির চামড়া ছাড়ানোর কাজ করতেন। দ্য উইকের তথ্যমতে, ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সার্কাসের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। সংবাদ মাধ্যম পিবিএসের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আরকানসায় এক মুদি দোকানে কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাস্কিন-রবিন্সের হনুলুলু শাখায় একজন আইসক্রিম বিক্রেতা ছিলেন। বিশ্ব রাজাদের এমন অতীত হলে আলমকে নিয়ে এতো সমালোচনা কেন? আশরাফুল আলম বগুড়ার এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আশরাফুল আলম সাঈদ সিডি ব্যবসা, ডিশ ব্যবসার এক পর্যায়ে মিউজিক ভিডিও বানিয়ে হয়ে উঠেছেন হিরো আলম। নিজের বানানো মিউজিক ভিডিওতে নিজেই হিরো। নিজেকে হিরো ভাবাটাই কি হিরো আলমের দোষ?
‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, আমরা সমাজকে বদলে দেবো’ নামে হিরো আলম একটি বই লিখেছেন। বইটিতে স্বশিক্ষিত একজন হিরো আলম সমাজের উচ্চশিক্ষিত মানুষদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন-আমরা কোন পথে আছি। বইটির আলোচিত দশটি লাইন এরকম-
১. আপনারা শিক্ষিত কাগজে-কলমে, মনুষ্যত্বের শিক্ষা শিক্ষিত লোকের মাঝে তেমন একটা নাই।
২. আমি অশিক্ষিত হয়ে লাত্থি উস্টা খেয়েও বেঁচে আছি, আপনারা শিক্ষিতরা কেন আত্মহত্যা করেন?
৩. আমার চেহারাটা নিয়ে আর কী বলবেন? আল্লাহই তো আমারে বানাইছে। আমি তো বানাই নাই। আমি কী করব? এই চেহারা চেঞ্জ তো করতে পারব না।
৪. জীবনের সব ব্যবসা আমি টাকা দিয়ে করেছি, শুধু নির্বাচন ছাড়া।
৫. শিক্ষিতরা যে আমারে নিয়ে মজা করেন, আমার জায়গায় থাকলে তো রিকশা চালায়ে খাইতেন। আমি তো তাও চেহারা খারাপ বলে মিডিয়ায় আইছি, আপনার তো চেহারা মোটামুটি। আপনি তো তাও পারতেন না।
৬. আমি আমার ভক্ত গো একবার ধন্যবাদ দিলে সমালোচক গো দুইবার ধন্যবাদ দিই। তারা আমার ভিডিও খিয়াল করে দেখে। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও দেখে, উইঠেও দেখে।
৭. সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত লোক হইলো ভীতু। নিজেরা তো কিছু করবেই না, কেউ করতে দেখলেও গা জ্বলে। এরা যে কি চায় নিজেরাই জানে না।
৮. আমি পরিত্যক্ত সন্তান হয়ে চানাচুর বেচে, সিডি, ডিশ লাইন, মিউজিক ভিডিও করে ১০-১৫টা মানুষের দায়িত্ব নিতে পারি, আপনি শিক্ষিত হয়ে কিছু পারেন না কেন?
৯. আমি হিরো আলম আমার ভিডিও দেখে খালি মানুষ হাসবে এই জন্যে কাজ করি। আমার মাইনসের হাসিমুখ দেখতেই ভালো লাগে। এই সব ভাইরাল, সমালোচনা এসবের জন্যে কাজ করি না।
১০. আমি সকল বিধবা মা, পরিত্যক্ত নারী ও শিশুদের জন্যে একটা সংস্থা করে যেতে চাই। যাতে, আমার মায়ের মতো কারো মার যেন মাইর খেয়ে রাস্তায় বাচ্চা নিয়ে রাত কাটানো না লাগে।
আমরা অনেকেই যা পারছি না, হিরো আলম সেটা করার চেষ্টা করছেন। তার চেষ্টাটাই বা কম কিসের? আলমের চেহারাটাই কি সমস্যা? আসলে এগুলো কোনো সমস্যাই না। সমস্যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। অতএব সবক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট