চিররঞ্জন সরকার : সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে মাঝে মাঝেই রাজনীতিবিদদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। জাতীয় সংসদের চলতি বাজেট অধিবেশনেও এ ক্ষোভের বহির্প্রকাশ লক্ষ করা গেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
সুযোগ পেলেই কিছু কিছু নেতা এ নিয়ে উস্মা প্রকাশ করেন। এবার সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে প্রথম মুখ খোলেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি আমলাদের বেশি বেশি দায়িত্ব দেওয়ার সমালোচনা করে বলেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে। এটা খেয়াল রাখতে হবে। তার কথার সূত্র ধরে জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যার সময় ওবায়দুল কাদের একদিকে পালাগান করেন, একটু পর টিভিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরেকটা পালাগান করেন।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘এখন রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা ঘরে বসে টেলিভিশনে পালাগানের রাজনীতি দেখি। এই পালাগান চলছে ১০ বছর। রাজনীতিশূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই।’
জাতীয় পার্টির এ এমপি আরও বলেছেন, ‘রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য। অথচ এ দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদেরা।’
তোফায়েল আহমেদ, কাজী ফিরোজ রশীদের কথার সত্যতা আছে নিঃসন্দেহে। দেশ ক্রমশ আমলানির্ভর হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদরা গুরুত্ব হারাচ্ছেন। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের রাজনীতি পরিচালনা করার কথা রাজনীতিবিদদের। আমলাদের কাজ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতির লাটাই ক্রমেই আমলাদের হাতে চলে যাচ্ছে।
দেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক হচ্ছেন জনগণ, আর তাদের ভোটে নির্বাচিতদেরই দেশ পরিচালনার কথা। কাজকর্মে যদি এমপিরা যদি কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করেন, সচিবরাই সব কাজ করেন, তাহলে সেটা দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের জন্য নিঃসন্দেহে একটি দুঃখজনক ঘটনা।
আমলানির্ভরতা নিয়ে কেবল রাজনীতিবিদরাই কথা বলছেন না। কোনো কোনো সাবেক আমলাও এ ব্যাপারে কথা বলছেন। যেমন সরকারের সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সম্প্রতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশের রাজনীতি এখন আমলা ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। তিনি মনে করেন রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত আর আমলাদের হাতে থাকা দরকার আমলাতন্ত্র। রাজনীতিবিদরা যদি আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলে তো আমলারা ছড়ি ঘোরাবেনই। দেশপ্রেমিক ও ন্যায়নিষ্ঠ না হলে আমলা যত পাকা হন তিনি তত বেশি শয়তান হন।
এই আমলার মতে, ‘‘দেশে আমলানির্ভরতা শুরু হয় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার আমলে। এর আগে এতটা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আমলে তো আমলানির্ভরতা ছিলই না। তখন যেসব নেতা ছিলেন আমলারা তাদের সঙ্গে আলাপ করার আগে তিনবার চিন্তাভাবনা করতেন। এখন আমলাতন্ত্র ও বাণিজ্য রাজনীতিতে চেপে বসেছে।’’
প্রশ্ন হলো, সরকার ও রাজনীতিতে আমলাদের প্রভাব কেন বেড়ে গেল? দেশে এমন পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? আমলারা কিন্তু জোর করে রাজনীতিতে ঢুকছেন না। রাজনীতিবিদরা কী এর দায় এড়াতে পারবেন? আমলারা রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছেন মাত্র। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যদি আমলাতন্ত্র নির্ভর হতে হয়, তাহলে আমলারা সুযোগ নেবেনই। স্বাভাবিক নিয়মেই রাজনীতিবিদরা তখন সাইডলাইনে চলে যাবেন। যাচ্ছেনও। ক্ষমতার প্রয়োজনে আমলা নির্ভরতার পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে রাজনীতিবিদদের দক্ষতার অভাবেও আমলারা গুরুত্ব পাচ্ছেন বেশি।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে না। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ একতরফা জয় পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও সবার জন্য সমান মাঠ নিশ্চিত না হওয়া এবং প্রশাসনের সহায়তায় বিজয় নিশ্চিত করার অভিযোগ ওঠে। রাজনৈতিক মহলে এমন আলোচনা আছে যে ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সরকারি চাকুরেদের ব্যবহার করে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, নাগরিক সংগঠনের অনেকের অভিযোগ, প্রশাসনের সহায়তায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এ কারণে প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাব এই সরকারের ওপর বেশি। আমলানির্ভরতার জন্য উল্লিখিত বিষয়গুলো একটা বড় কারণ।
তাছাড়া গত দুই দশকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অবক্ষয় ও স্থবিরতা গ্রাস করেছে। যা আমলাতন্ত্রকে আরও বেশি অপ্রতিহত করে তুলেছে। দলীয় রাজনীতির দায়িত্বশীল পদে যারা আছেন, তাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয় বা পক্ষান্তরে অনেক ক্ষেত্রেই নিজেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে অনিবার্যভাবেই বাড়ছে আমলানির্ভরতা। যা বিরাজনীতিকরণকে ত্বরান্বিত করছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতান্ত্রিক অনুশীলন ভীষণ কমে এসেছে। সংগঠনের অন্তর্গত শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হতে চলেছে। একজন কর্মীর আদর্শের যে প্রেরণা নিয়ে দেশের সংকট মুহূর্তে কথা বলা প্রয়োজন, তা দেখা যাচ্ছে না। বরং সব সংকটেই নেতাকর্মীরা নিজের দায়িত্ব পালন না করে দলনেত্রীর ওপর দায় চাপাচ্ছে কপট আনুগত্যের খোলসে।
আমলানির্ভরতার আরও কিছু কারণ রয়েছে। বর্তমান কেবিনেটের অধিকাংশ মন্ত্রী নবীন। মন্ত্রণালয়ের কাজ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। আর এই সুযোগটি নিচ্ছেন আমলারা। তারা মন্ত্রীদের বিভিন্ন কাজ এবং বিভিন্ন কাজের গতিপ্রকৃতি এবং কীভাবে বিভিন্ন কাজ করতে হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিচ্ছেন। সে অনুযায়ী কাজ করার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে মন্ত্রীদের। যে কারণে মন্ত্রীরা আমলাদের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
যে সমস্ত আমলারা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ের চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয়েই তারা বেশি পরিচিত হচ্ছেন। যার ফলে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা মন্ত্রীর চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, একটি মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী থাকলেও পুরো মন্ত্রণালয় পরিচালিত হয় আমলাদের দ্বারাই। আমলাদের মূল নেতা হলেন একজন সচিব। কাজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রীকে পাশ কাটানো বা মন্ত্রীকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া অনেক সহজ হচ্ছে। এসব কারণেই তৃতীয় মেয়াদে দেখা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্তগ্রহণের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছেন আমলারা। আমলাদের এই সিদ্ধান্তগ্রহণের কারণে সরকারের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত হচ্ছে।
রাজনীতির মাঠে আরেকটি অশনিসংকেত হলো–বিরোধী দলের অস্তিত্ব সংকট। নেতৃত্ব, আদর্শ বা লক্ষ্যের অস্থিরতা প্রধান বিরোধী দলগুলোকে ক্রমাগত দুর্বল করছে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের জন্য অবশ্যই শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। সেটা সরকারি দলকেও বুঝতে হবে। বিরোধীদেরও ভাবতে হবে তাদের উদ্দেশ্য শুধু যে কোনো পন্থায় ক্ষমতায় যাওয়া নয়। কেবল নেতিবাচক, সুযোগসন্ধানী বা সুবিধাবাদী রাজনীতি শেষ বিচারে ব্যক্তি, দল বা দেশ–কারও জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।
সরকার ও রাজনীতিতে আমলাতন্ত্র নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠলে কিন্তু ক্ষমতাসীন দলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমলারা সরকারকে গিলে খেয়ে ফেললে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের গতি শ্লথ হবে, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত কবে। এই আমলাতন্ত্রের ফলে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণও বাধাগ্রস্ত হবে। রাজনীতিবদরা হয়ে পড়বেন সাইড-লাইনের বসে থাকা অতিরিক্ত খেলোয়ার। এতে জনস্বার্থ বিঘিœত হতে বাধ্য।
সাবেক সচিব বদিউর রহমান যা বলেছেন, ‘আমলা যত পাকা হন তিনি তত বেশি শয়তান হন’-কথাটা রূপকার্থে বললেও এটা কিন্তু অনেক ভাবনার কথা। এই ‘শয়তানের’ খপ্পর থেকে সরকার ও রাজনীতিকে বের করে আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট।