মাকসুদুল হক : লেখার শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার যে, ১৯৬০-এর দশক থেকে আজ অব্দি দেশের যত রকম পট পরিবর্তন, ঘটনা বা অঘটন ঘটেছে – তার সবকিছুরই আমি চাক্ষুষ সাক্ষী ও ক্ষেত্রবিশেষে অংশগ্রণকারীও বটে। আমি জানি, এই লেখা পড়ে অনেকেই হতাশ হবেন, দ্বিমত পোষণ করবেন, বিরুদ্ধাচারণ করবেন, বা গালিগালাজও করবেন। এ সবই সম্ভব, কারণ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে পরিমাণ নৈরাজ্য, অস্থিরতা, বিভীষিকাময় তাণ্ডব ও সংঘাত চলছে, সেখানে মিথ্যারই জয়জয়কার, এটাই ‘নিউ নরমাল’! তবুও দু-একজন যদি আমার সাথে সহমত পোষণ করেন, আমি মনে করবো এই আমার অনেক বড় প্রাপ্তি।
সমগ্র দেশ ও জাতির ভেতরে চলছে চাপা ক্ষোভ ও ট্রমা, যেটা এই বেসামাল অবস্থায় প্রকৃতপক্ষে একেবারেই স্বাভাবিক। সবাইকে সন্তুষ্ট বা খুশি করা কারও পক্ষে সম্ভব না- এটাই এখনকার নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
অশ্রুসিক্ত ২০২৪-কে যদি আমরা মনে করি একটা ‘বেঞ্চমার্ক’ বা দিক-রূপান্তরকারী বছর এবং আমাদের সকল অর্জন যখন চোখের সামনে ধূলিসাৎ হতে দেখছি আর তার প্রতিকারে কিছুই করতে পারছি না- তাহলে এখন সময় এসেছে ইতিহাস নিয়ে ‘আমরা ভালো, ওরা কত খারাপ’ বা তার উল্টো- এই ভ্রান্ত, সংকীর্ণ এবং অত্যন্ত ঘুনেধরা ন্যারেটিভ বাদ দিয়ে বুকে হাত রেখে সত্যনিষ্ট কিছু উচ্চারণ করা। আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই ‘সাদাকালো’ আখ্যানে যে, আমরা ধরেই নিয়েছি বাংলাদেশ একই নিয়মে, একই স্টাইলে এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ- ওই একই অতি পরিচিত ও বোরিং মুখগুলোর দ্বারা পরিচালিত হবে নির্লজ্জভাবে, যুগ যুগ ধরে। এটাই যেন আমাদের ভাগ্য।
এর বাইরে অন্য কোনো চিন্তা বরদাস্ত করা হবে না– এ যেন এক অলিখিত আদেশ বা নির্দেশ, যা দেশের আপামর ‘জনগণ’ মৃত্যুর হুমকি বা ঝুঁকির মুখে মানতে বাধ্য! উপরোক্ত এই রূঢ় সত্যগুলো আমরা মানিনি, বিশ্বাস করিনি বিধায় আজকে মুষ্টিমেয় এক স্বার্থান্বেষী মহল কি অবলীলায় দেশ দখল করলো এবং ‘নতুনত্বের’ নামে যা শুরু করলো! আর তথাকথিত এই ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ২.০’ যখন সৃষ্টি হলো, আমরা কী করলাম বা এখনও কী করছি? আনন্দে আরাম-আয়েশ সব দেখছি- তাই তো? আর ‘নতুন মুখ’? ‘বিপ্লবী অভ্যুত্থানকারী সমন্বয়ক’ যেগুলোর নমুনা দেখছি, কতটা ভয়ানক– তাদের কথাবার্তা এবং সময়-অসময়ে সবাইকে মূর্খ ভেবে কী অদ্ভুত সব তালিম দিচ্ছে- তার সব কিছুই আমরা হজম করতে বাধ্য হচ্ছি। এই সবকিছুর একমাত্র কারণ– আমরা কাকে ক্ষমতায় বসাবো, কাকে ‘নেতা’ মানবো- সেই ম্যানডেট কখনই আমাদের ভুল ছিল না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- আমাদের জেনেশুনেও ভুল হয়েছে। ভুল এটাই যে, যাদেরকেই আমরা আমাদের ‘নেতা’ মনে করেছি ও ক্ষমতার মসনদ পাইয়ে দিয়েছি, তারা ঐতিহাসিকভাবে আমাদের সাথে প্রতারণাই শুধু নয়- বিস্বাসঘাতকতা করেছে, গাদ্দারি করেছে– এটাই বাস্তব, এটাই ‘আনফিল্টার্ড’ সত্য। উল্টোদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে তো সবই হলো, কিন্তু প্রকৃত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী (গরিব) দেশের প্রতিটি সংগ্রাম, আন্দোলনসহ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মতো ভয়াল সময়ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও ত্যাগ স্বীকার করলেও, ৫৪ বছরেও তারা ক্ষমতার মসনদে আসীন হতে পারেনি। সেই সুযোগ আমরা করে দিইনি – বা আমরা দেবো না– তাতে ‘আমরা’ একরকম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আদৌ ‘গরিব’ বা তাদের সন্তান দেশ পরিচালনা করতে পারবে, বা আসলেই পারে– সেই হিসাবনিকাশ, সেই সুযোগ একবারও দেওয়া হয়নি বা সেদিকটা আমাদের ভাবনা-চিন্তায় বা মননে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একাত্তরের রণাঙ্গনের ছবি দেখলেই খেয়াল করবেন প্রায় ৮০-৯০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা হতদরিদ্র চাষা, কৃষক-শ্রমিকের সন্তান। ক’জন শহুরে মধ্যবিত্তের সন্তান সেখানে দেখেন? অথচ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন দেশে তাদের আমরা আদৌ কি মূল্যায়ন করেছি? যুদ্ধ করেছে গরিবের সন্তান আর মজা লুটলাম ‘আমরা? ভুলে যাবেন না- দেশমাতৃকার সাথে প্রথম ক্ষমার অযোগ্য পাপ, প্রথম গাদ্দারিটা আমরাই করেছিলাম। মাঝে মধ্যে অবশ্য কিছু সুবিধাবাদী কমিউনিস্ট ও বামপন্থীগণ যে এ বিষয়ে আওয়াজ তুলেনি– তা কিন্তু নয়। কিন্তু আওয়াজগুলো যারা তোলে, তারা নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল, তথাপি অভিজাত। তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ, তাই কখনই গরিবের সন্তান নয়।
এই শ্রেণির মানুষগুলো যদিও ‘গরিবের বন্ধু’ বলে সমাজে একটা ফ্যাশনেবল বিপ্লবী ভাব নেয়– মূলত তারা রাজনৈতিক সুবিধাবাদীর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আর দশটা সুবিধাবাদী ধান্দাবাজের থেকে তাদের আলাদা করা যায় না বা আদতে কোনো পার্থক্য নেই। ‘বেচারা’ ও ‘বেকুব’ গরিবদের স্পষ্টতই দেখা যায় লাল ঝাণ্ডা হাতে শ্রেণিসংগ্রামের বুলি ও ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ মার্কা স্লোগান আওড়াতে আওড়াতে মিছিলে কুচকাওয়াজরত অবস্থায়– কখনই ‘নেতা’ বা নেতৃত্বের সারিতে নয়। কোনো অভয়ারণ্য বা অজপাড়াগাঁয়ের চাষী খেতমজুরের সন্তান ‘নতুন মুখ’-রূপে উদয় হবে- এ যেন এক ‘দিবাস্বপ্ন’; যা আমরা মনে ও মননে মানতে বা লালন করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। প্রকৃত গরিবের সন্তান কোনো দায়িত্বশীল পদে আছেন – আমরা এই অব্দি তেমনটা দেখি না বা খুঁজে পাই না– এবং করুণ বাস্তবতা হলো, সম্ভবত কখনই খুঁজে পাবো না।
আমরা ধরেই নিয়েছি দেশ চলবে ক্ষমতাসীন কিছু (জন+অপ্রিয়) ‘জনপ্রিয়’ ও অভিজাত উচ্চবিত্ত ও স্বার্থান্বেষী মধ্যবিত্তের কল্যাণে।
সবকিছু হবে ‘আমাদের ইচ্ছায়’ ও ইদানংী এই ‘আমাদের’রা আবার জোর গলায় দাবি করছেন যে, আমরাই ‘জনগণ’ ও আমরা একাই তাদের পালস ধরে রেখে বুঝি তারা কী চায়। ‘জনগণ’ আমাদের কথায় ও ইশারায় উঠবে বা বসবে ও নাচন-কুদন করবে- বাহ্ কী চমৎকার ইকুয়েশন! অনেক বড় বড় কথা বলা হলেও, পদ্মা মেঘনা যমুনার অনেক জল ইতিমধ্যে প্রবাহিত হয়ে গেলেও এতগুলো বছরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনোরকম পরিবর্তন ঘটেনি। ইতোমধ্যে অনেক আন্দোলন, অনেক নির্বাচন, অভ্যুত্থান, অনেক ‘বিপ্লব’, অনেক ‘ক্যু’ হয়ে গেছে এবং প্রতিটিতে ‘গরিব’ নির্দ্বিধায় অংশগ্রহণ করেছে ও সব চাইতে বেশি রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে যদিও-কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহল পরক্ষণেই চোখপাল্টি দিয়েছে ও তাদের কঙ্কালের উপরে দাঁড়িয়েই নির্লজ্জভাবে ক্ষমতা দখল করেছে।
কার্যত কোনো ‘কুইক ফিক্স সলিউশন’ যা অনেকেই আশা করছেন – তা একেবারেই সম্ভব নয়। সেই পুরোনো লোকগুলোর ‘নেতৃত্ব’, তাদের ‘বাণী’, তাদের বুদ্ধিসুদ্ধি বা মাথামুণ্ডু কথাবার্তার উপরে যদি এখনও ‘অকুণ্ঠ ইমান’ রেখে মনে করি ‘পরিবর্তন’ আসবে- তাহলে আমরা আবার বোকার রাজ্যে বাস করছি। আবার আমরা একই ফাঁদে যে পড়বো, একই পচা শামুকে পা দেবো– তা অবধারিত ও আমাদের এই ভাগ্যই প্রাপ্য- অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ ডেট!
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৫৪ বছরের মধ্যে কোন ‘আমলে’ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়নি, বা দুর্নীতি হয়নি, বা পুলিশ-র্যাব জুলুম করেনি, অকারণে জেলবন্দি করেনি, অমানবিক অত্যাচার করেনি, গুম করেনি… ইত্যাদি? আমরা বেমালুম পরিবারতন্ত্র ভুলে বসেছি ও পরিবারকেই ত্রাতা ও ভাগ্যবিধাতা মনে করেছি- বা এখনও করি? একেবারে নিউট্রাল একটা প্রশ্ন করা যাক। এরা কি আসলেই এতো ‘মাসুম’ বা নিষ্পাপ যে তাদের মধ্যে একজন ক্ষমতাচ্যুত হলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি তাদের থেকেই আবার আরেকজনকে ক্ষমতায় বসানোর কৌশিষে?
আমাদের অন্য কোনো অপশনই কি নেই? এতগুলো বছরে আমরা বিকল্প রাজনীতি বা নেতৃত্ব তৈরি করতে কেন ব্যর্থ হলাম- এবং কেনই বা এদের আমরা বুঝে বা না-বুঝে সব সময় ক্ষমা করি? সবচেয়ে বেশি অবাক হই, যখন দেখি এদের কোনো অনুশোচনা নেই! ভুলেও শুনবেন না, এরা নিজেদের ভুল স্বীকার করছে। ভাবখানা এমন যে– আমরা যা করেছি, ভালো করেছি; তোরা কী বুঝিস? এত অহংকার, এত অহমিকা… আবার আমরা শিক্ষিত মূর্খগুলো ‘জি জাহাঁপনা’ বলে বলেই ঢোক গিলছি!
২০২৪ কি আমাদের কোনো শিক্ষাই দিচ্ছে না? ৫৩ বছরে কয়েক প্রজন্মই আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত। তাদের সবাইকে বোকা মনে করার অর্থ হলো, নিজের সাথেই প্রতারণা করা। এস্কিমোদের কাছে আইসক্রিম একবার বেচা গেলেও আমরা কয়েক প্রজন্মকে বহুবার তা বিক্রি করেছি ও ভাবছি এখনও পারবো? আর কত স্টুপিড হওয়া যায়? ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বা ‘জাতীয়তাবাদী জজবা’ যে জনগণ আর ‘খাচ্ছে না’ সেদিকে আমাদের বিন্দুমাত্র মনোযোগ আছে কি? যারাই ফের ক্ষমতায় অতি-সহজে আসার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের বলা হোক- আপনাদের কেবল ‘ভুল’ নয়, পাপের প্রায়শ্চিত্ব করে– সম্পূর্ণ ফ্রেশ গোসল দিয়ে এসে দেশের দায়িত্ব নেওয়ার চিন্তা করুন। আর তা বলতে না পারলে ‘জালিম বাদশাহ’ আমাদের ভাগ্যলেখায় অবধারিত।
কোনো গণতান্ত্রিক ‘খেলোয়াড়’-এর আবির্ভাব ঘটবে না। এরপর কোনো ‘সিপাহি’, ‘হাবিলদার’ বা ‘সুবেদার’ শ্রেণির গরিবের সন্তান দেশের ক্ষমতা ঠিকই দখল করবে। এবং বিশ্বাস করুন- দেশটাকে অনেক ভালো চালাবে। … কিন্তু আমরা কি চাষার সন্তান, গরিবের সন্তানকে নেতা বলে মেনে নেবো?
লেখক: সংগীতশিল্পী, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট