ঢাকা ০৮:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫

আমরা তো তিমিরবিনাশী

  • আপডেট সময় : ০৯:৫৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ এপ্রিল ২০২৪
  • ২৭৯ বার পড়া হয়েছে

আমিনুল হাসান লিটু : ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৮। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী শিল্পাচার্যের জন্মদিন উদযাপনে মোটা কাগজ দিয়ে তৈরি কয়েকটি মুখোশ, বড় বড় তুলি, পেন্সিল, রঙের প্যালেট বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুবই ছোট পরিসরে ঝটিকা আনন্দ মিছিল করে। এমন উদযাপনের অভিজ্ঞতাই নতুন একটি ঘটনার জন্ম দিতে তরুণদের অনুপ্রেরণার উৎস হলো।
বাংলাদেশ তখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কবলে আক্রান্ত, দুর্বিষহ-শ্বাসরুদ্ধকর, বন্ধ্যা সময়; তরুণ ছাত্র সমাজ অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। তখন চারুকলার সেই শিক্ষার্থীরা স্বৈরশাসককে ইঙ্গিত করে ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ প্রতিপাদ্যে পয়লা বৈশাখ ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের (১৯৮৯ সাল) সকাল ৮টায় এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে চারুকলা প্রাঙ্গণ থেকে।
অনাচারের বিরুদ্ধে জনশিল্পের প্রকাশ, সম্প্রীতি ও পরম্পরার লোকশিল্পের রং-রূপ, আকার-আকৃতি, সাজ ও কাঠামোগত আনুপাতিক বিশাল নির্মাণ এবং সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের প্রেরণায় পরবর্তী বছর ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পৌঁছেছে।
চারুকলা আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪২৩ বঙ্গাব্দে ইউনেস্কোর ইন্টার গভার্নমেন্টাল কমিটি অব আই.সি.এইচ. কর্তৃক ‘ওহঃধহমরনষব ঈঁষঃঁৎধষ ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু’ হিসেবে স্বীকৃত ও তালিকাভুক্ত হয়েছে।
বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ এই মাসের প্রথম দিন। নানা আয়োজনে বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনটি নববর্ষ নামে উদযাপিত হয় বাংলা দিনপঞ্জি প্রবর্তনের শুরু থেকেই। নববর্ষ বাঙালি জীবনে আনে নতুন স্বপ্ন, বেঁচে থাকার নতুন আশ্বাস।
বাঙালির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রাম বাংলার ঘর গৃহস্থালির কাজ, কৃষি ক্ষেত-খামারির কাজ, সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ ছাড়াও মানুষ বাংলা সন অনুযায়ী খাজনাপাতি পরিশোধ করে। বাংলা নতুন বছর ‘বরণের উৎসব’ হিসেবেও খ্যাত।
প্রত্যেক পরিবারে আগত দিনগুলোয় নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনায় নানা আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করা, ব্যবসায়ীদের হালখাতা, ঘরে ঘরে সাধ্যমতো ভালো খাবার তৈরি করে প্রতিবেশীদের সাথে নিয়ে নববর্ষ উদযাপন করা ছিল প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান।
এছাড়া গরুর দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, বয়াতিদের গান, বিন্নি কদমা খেলনা মৃৎপাত্রাদি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিকিকিনির মেলা বা থৌল ছিল অন্যতম অনুষ্ঠান।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত দেশে শুরু হয় বাঙালি জনজীবনের নতুন সংকট। ভাষা সংস্কৃতির লড়াই, রাজনীতি-অর্থনীতির ন্যায্যতা আদায়ের প্রতিপক্ষ হলো উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। ফলে রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি বপন করে তার প্রথম স্বাধীনতার বীজ।
ভাষা সংস্কৃতিই হলো বাঙালির লড়াই সংগ্রাম আর স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম হাতিয়ার। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালে ঢাকায় ছায়ানট-এর জন্ম। তখন পাকিস্তান সরকার ও তার ঝান্ডাধারি তল্পিবাহক আবদুল মোনেম খান ও খাজা শাহাবুদ্দিন চক্রদ্বারা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে পয়লা বৈশাখ সকালে রবীন্দ্রসংগীত দিয়েই ছায়ানট শুরু করলো নববর্ষ বরণ।
বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রভাত হলো উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম ও বড় ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। ছায়ানটের অভ্যুদয় ও বিকাশ মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তেমনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মঙ্গল শোভাযাত্রাও ছিল পাকিস্তানের রেখে যাওয়া রক্তবীজ স্বৈরাচার এরশাদসহ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আত্ম-অনুসন্ধানের নতুন পথের যাত্রা।
১৩৯৬ বঙ্গাব্দের প্রথম শোভাযাত্রার প্রস্তুতি- হাতির কাজ চলছে, পিঠে চট সেলাইরত লেখক নিজে ও টেবিলে দাঁড়িয়ে সাখাওয়াত হোসেন; ছবি : মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র আর্কাইভ থেকে
সময় হলো যুক্ত করার, ঢাকার সাথে গ্রাম বাংলাকে-লোকসংস্কৃতির সাথে নাগরিক মানুষের। গ্রাম এগিয়ে যাবে নগরের দিকে, আর নগর ভুলবে না তার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যে ভরা সোনালী অতীতকে। যা হওয়ার কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের পরপরই।
স্বৈরশাসনের করাল থাবায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেশন-জট, রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে রেহাই পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরাও। সারাদেশের অস্থিরতার বাতাস তখন চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভেতরেও ছিল বহমান।
ছাত্র শিক্ষকদের নানা স্তরে সংঘাত-কোন্দল চলমান ছিল। এমনই এক অস্থির সময় পার করছিল চারুকলার শিক্ষার্থীরা। ফলে পরিবর্তনের একটি ঝড়ো হাওয়ার বিকল্প আর কিছুই ছিল না। তাই সেইদিনের চারুকলার শিক্ষার্থীদের একটি উদ্যোগ সাধারণ মানুষকেও সজাগ করে তুলেছিল।
ফলে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিবেচনায় ধারাবাহিক চর্চায়ই চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি আন্দোলনের রূপ পেয়েছে। আর এজন্য সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের সমন্বিত চিন্তা, মননসহ একত্রে সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল।
মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটাতে প্রথম ও পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজক প্রাক্তনীদের প্রতিষ্ঠান ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র’ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও তার প্রসারে ‘যেখানে বাঙালি সেখানেই মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই মন্ত্রে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশসমূহে মঙ্গল শোভাযাত্রা সহযোগে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে প্রয়োজনীয় উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
বাংলা নববর্ষ আবাহনে সংস্কৃতি চর্চায় লোকজ ধারার এই নতুন মাত্রা জনজীবনে যে নাড়া দিয়ে গেছে, চারুকলায় শোভাযাত্রার সূচনাকালের সাথে যুক্ত সেইদিনের সেইসব শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ছিল বাংলার মানুষের মাঝে বাঙালি হওয়ার আনন্দ সৃষ্টি করা।
তাই মঙ্গল শোভাযাত্রার সেইসব তিমিরবিনাশীদের চিন্তা, চেতনা, ঘাম, শ্রম, একাগ্রতার চূড়ান্ত সফলতা পাবে সেইদিন, যেদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সব বাঙালির মননে ছড়িয়ে পড়বে বাঙালি-বাঙালিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার-আদর্শের বাংলাদেশ।
মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্প্রীতির বাংলাদেশ এবং বাংলার মানুষকে প্রকৃত বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত করাবে বিশ্বময়। তাই ১৪৩১ মঙ্গল শোভাযাত্রা সহযোগে নববর্ষ বরণে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘তিমিরহননের গান’ থেকে চয়নকৃত এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ মনে-প্রাণে ধারন করে সমস্বরে উচ্চারিত হোক বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতিটি প্রাণে, তিমিরবিনাশের সংগ্রামে বাঙালি জয়ী হোক।
লেখক: প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজক সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক, মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র। ধসরহঁষযধংধহ@মসধরষ.পড়স

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

আমরা তো তিমিরবিনাশী

আপডেট সময় : ০৯:৫৮:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ এপ্রিল ২০২৪

আমিনুল হাসান লিটু : ২৯ ডিসেম্বর ১৯৮৮। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের (বর্তমান চারুকলা অনুষদ) কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী শিল্পাচার্যের জন্মদিন উদযাপনে মোটা কাগজ দিয়ে তৈরি কয়েকটি মুখোশ, বড় বড় তুলি, পেন্সিল, রঙের প্যালেট বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুবই ছোট পরিসরে ঝটিকা আনন্দ মিছিল করে। এমন উদযাপনের অভিজ্ঞতাই নতুন একটি ঘটনার জন্ম দিতে তরুণদের অনুপ্রেরণার উৎস হলো।
বাংলাদেশ তখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনের কবলে আক্রান্ত, দুর্বিষহ-শ্বাসরুদ্ধকর, বন্ধ্যা সময়; তরুণ ছাত্র সমাজ অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। তখন চারুকলার সেই শিক্ষার্থীরা স্বৈরশাসককে ইঙ্গিত করে ‘বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ প্রতিপাদ্যে পয়লা বৈশাখ ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের (১৯৮৯ সাল) সকাল ৮টায় এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে চারুকলা প্রাঙ্গণ থেকে।
অনাচারের বিরুদ্ধে জনশিল্পের প্রকাশ, সম্প্রীতি ও পরম্পরার লোকশিল্পের রং-রূপ, আকার-আকৃতি, সাজ ও কাঠামোগত আনুপাতিক বিশাল নির্মাণ এবং সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের প্রেরণায় পরবর্তী বছর ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পৌঁছেছে।
চারুকলা আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা ১৪২৩ বঙ্গাব্দে ইউনেস্কোর ইন্টার গভার্নমেন্টাল কমিটি অব আই.সি.এইচ. কর্তৃক ‘ওহঃধহমরনষব ঈঁষঃঁৎধষ ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু’ হিসেবে স্বীকৃত ও তালিকাভুক্ত হয়েছে।
বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ এই মাসের প্রথম দিন। নানা আয়োজনে বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনটি নববর্ষ নামে উদযাপিত হয় বাংলা দিনপঞ্জি প্রবর্তনের শুরু থেকেই। নববর্ষ বাঙালি জীবনে আনে নতুন স্বপ্ন, বেঁচে থাকার নতুন আশ্বাস।
বাঙালির আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রাম বাংলার ঘর গৃহস্থালির কাজ, কৃষি ক্ষেত-খামারির কাজ, সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ ছাড়াও মানুষ বাংলা সন অনুযায়ী খাজনাপাতি পরিশোধ করে। বাংলা নতুন বছর ‘বরণের উৎসব’ হিসেবেও খ্যাত।
প্রত্যেক পরিবারে আগত দিনগুলোয় নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনায় নানা আচার অনুষ্ঠানের প্রচলন ছিল। চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করা, ব্যবসায়ীদের হালখাতা, ঘরে ঘরে সাধ্যমতো ভালো খাবার তৈরি করে প্রতিবেশীদের সাথে নিয়ে নববর্ষ উদযাপন করা ছিল প্রচলিত আচার অনুষ্ঠান।
এছাড়া গরুর দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, বয়াতিদের গান, বিন্নি কদমা খেলনা মৃৎপাত্রাদি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিকিকিনির মেলা বা থৌল ছিল অন্যতম অনুষ্ঠান।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত দেশে শুরু হয় বাঙালি জনজীবনের নতুন সংকট। ভাষা সংস্কৃতির লড়াই, রাজনীতি-অর্থনীতির ন্যায্যতা আদায়ের প্রতিপক্ষ হলো উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। ফলে রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি বপন করে তার প্রথম স্বাধীনতার বীজ।
ভাষা সংস্কৃতিই হলো বাঙালির লড়াই সংগ্রাম আর স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম হাতিয়ার। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালে ঢাকায় ছায়ানট-এর জন্ম। তখন পাকিস্তান সরকার ও তার ঝান্ডাধারি তল্পিবাহক আবদুল মোনেম খান ও খাজা শাহাবুদ্দিন চক্রদ্বারা রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে পয়লা বৈশাখ সকালে রবীন্দ্রসংগীত দিয়েই ছায়ানট শুরু করলো নববর্ষ বরণ।
বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রভাত হলো উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম ও বড় ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। ছায়ানটের অভ্যুদয় ও বিকাশ মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তেমনি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মঙ্গল শোভাযাত্রাও ছিল পাকিস্তানের রেখে যাওয়া রক্তবীজ স্বৈরাচার এরশাদসহ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আত্ম-অনুসন্ধানের নতুন পথের যাত্রা।
১৩৯৬ বঙ্গাব্দের প্রথম শোভাযাত্রার প্রস্তুতি- হাতির কাজ চলছে, পিঠে চট সেলাইরত লেখক নিজে ও টেবিলে দাঁড়িয়ে সাখাওয়াত হোসেন; ছবি : মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র আর্কাইভ থেকে
সময় হলো যুক্ত করার, ঢাকার সাথে গ্রাম বাংলাকে-লোকসংস্কৃতির সাথে নাগরিক মানুষের। গ্রাম এগিয়ে যাবে নগরের দিকে, আর নগর ভুলবে না তার হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্যে ভরা সোনালী অতীতকে। যা হওয়ার কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের পরপরই।
স্বৈরশাসনের করাল থাবায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেশন-জট, রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে রেহাই পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরাও। সারাদেশের অস্থিরতার বাতাস তখন চারুকলা ইন্সটিটিউটের ভেতরেও ছিল বহমান।
ছাত্র শিক্ষকদের নানা স্তরে সংঘাত-কোন্দল চলমান ছিল। এমনই এক অস্থির সময় পার করছিল চারুকলার শিক্ষার্থীরা। ফলে পরিবর্তনের একটি ঝড়ো হাওয়ার বিকল্প আর কিছুই ছিল না। তাই সেইদিনের চারুকলার শিক্ষার্থীদের একটি উদ্যোগ সাধারণ মানুষকেও সজাগ করে তুলেছিল।
ফলে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিবেচনায় ধারাবাহিক চর্চায়ই চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি আন্দোলনের রূপ পেয়েছে। আর এজন্য সংঘবদ্ধ কিছু মানুষের সমন্বিত চিন্তা, মননসহ একত্রে সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল।
মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি আন্দোলন। এই আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটাতে প্রথম ও পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজক প্রাক্তনীদের প্রতিষ্ঠান ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র’ ১৪১৯ বঙ্গাব্দ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও তার প্রসারে ‘যেখানে বাঙালি সেখানেই মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই মন্ত্রে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশসমূহে মঙ্গল শোভাযাত্রা সহযোগে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে প্রয়োজনীয় উৎসাহ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছে।
বাংলা নববর্ষ আবাহনে সংস্কৃতি চর্চায় লোকজ ধারার এই নতুন মাত্রা জনজীবনে যে নাড়া দিয়ে গেছে, চারুকলায় শোভাযাত্রার সূচনাকালের সাথে যুক্ত সেইদিনের সেইসব শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ছিল বাংলার মানুষের মাঝে বাঙালি হওয়ার আনন্দ সৃষ্টি করা।
তাই মঙ্গল শোভাযাত্রার সেইসব তিমিরবিনাশীদের চিন্তা, চেতনা, ঘাম, শ্রম, একাগ্রতার চূড়ান্ত সফলতা পাবে সেইদিন, যেদিন মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ সব বাঙালির মননে ছড়িয়ে পড়বে বাঙালি-বাঙালিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার-আদর্শের বাংলাদেশ।
মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্প্রীতির বাংলাদেশ এবং বাংলার মানুষকে প্রকৃত বাঙালি পরিচয়ে পরিচিত করাবে বিশ্বময়। তাই ১৪৩১ মঙ্গল শোভাযাত্রা সহযোগে নববর্ষ বরণে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘তিমিরহননের গান’ থেকে চয়নকৃত এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’ মনে-প্রাণে ধারন করে সমস্বরে উচ্চারিত হোক বাঙালির ঘরে ঘরে প্রতিটি প্রাণে, তিমিরবিনাশের সংগ্রামে বাঙালি জয়ী হোক।
লেখক: প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজক সদস্য এবং প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক, মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র। ধসরহঁষযধংধহ@মসধরষ.পড়স