অর্থনৈতিক ডেস্ক: দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের উপরে। তবে মূল্যস্ফীতি আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। কারণ গত কয়েক মাসে শাকসবজি ও কিছু মসলাজাতীয় পণ্যের দাম কম ছিল। তবে আমদানিনির্ভর খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা খাতে আগের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি কমেনি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতিতে সেবা ও আমদানি খাতের প্রভাব বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির কার্যকারণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে দেশে মূল্যস্ফীতি ও মজুরির পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কীভাবে ও কেন বাড়ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত জানুয়ারি থেকে মার্চে দেশে যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি হয়েছে প্রধান কিছু পণ্যের দাম বাড়ার কারণে। যদিও এ সময় সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের দাম কিছতা সহনীয় ছিল, তবে ভুগিয়েছে জ্বালানির দাম।
গত বছরের ডিসেম্বরের সঙ্গে চলতি বছরের মার্চ মাসের দামের পার্থক্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময়ে দেশে শাকসবজি, মাছ, কাঁচা মাংস ও ডিমের মতো পচনশীল পণ্যের দামে তেমন পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি অপরিবর্তিত বা স্থিতিশীল ছিল। অন্যদিকে ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে তেল, আটা, ডাল, চিনি প্রভৃতি অপচনশীল পণ্যের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছতা কমেছিল। এ ছাড়া আমদানিনির্ভর বেশকিছু খাদ্যপণ্যের দামও এ সময় কম ছিল। তবে এ সময়ে মূল্যস্ফীতিতে আমদানিনির্ভর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের অবদান বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস, ডিজেলসহ বিভিন্ন জ্বালানি পণ্য; মোবাইল, ল্যাপটপের মতো ইলেকট্রনিক পণ্য, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য প্রভৃতি। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতিতে বেড়েছে সেবা খাতের অবদানও। বাসাভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় প্রভৃতি হলো সেবা খাতের খরচ। অর্থাৎ এ ধরনের ব্যয় ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলেন, সেবা খাতের খরচ বাড়লে তা দীর্ঘমেয়াদে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। কারণ সেবা খাতে দাম একবার বাড়লে সহজে আর কমে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসের দিকে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছায়। এর পেছনে মূল কারণ ছিল খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এরপর গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি কমে সাড়ে ৯ শতাংশ হয়েছে। এ সময় দেশে শীত মৌসুম থাকায় শাকসবজির সরবরাহ ভালো ছিল। এ ছাড়া রমজানের কারণে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, মসলাসহ বেশ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে সরকার শুল্ক ছাড় দেয়। মূলত এসব কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে গত রমজানের পরে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে তিন ধরনের পণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে মাছ, মাংস ও ডিমের মতো প্রোটিনজাত খাবার। এরপর চাল, আটার মতো খাদ্যশস্য এবং তৃতীয়ত শাকসবজির দাম। গত মার্চে শাকসবজির দাম কিছুটা কম ছিল; তবে বেশি ছিল মাছ-মাংসের দাম। খাদ্য মূল্যস্ফীতির সূচকেও এর প্রভাব দেখা গেছে। ২০২৪ সালে দেশে ভোজ্যতেলের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ভোজ্য তেলের দাম আবার বাড়তে থাকায় তা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির প্রধান চলক ছিল জ্বালানির দাম। তবে গত বছরের জুলাই মাস থেকে এটি কমতে শুরু করেছে। গত বছরের মার্চে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে জ্বালানির অবদান ছিল ২৬ শতাংশ, যা চলতি বছরের মার্চে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশে।
সামনের দিনগুলোয় দেশে মূল্যস্ফীতি কেমন হবে, সেটি নিয়ে গত এপ্রিলে সর্বশেষ পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের পূর্বাভাসও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এডিবি তাদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি কিছতা কমতে পারে। আর আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরো কমবে। অনুকূল আবহাওয়া, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমা ও কঠোর আর্থিক নীতিকে এর পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে জানায়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ থাকতে পারে। তবে পরবর্তী সময়ে সেটি ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলেও সাধারণ মানুষের মজুরি সে তুলনায় বাড়েনি। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশে মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি থাকছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় কমেছে। এতে পরিবারের খরচ চালাতে চাপে থাকছে মানুষ।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ