ঢাকা ০৯:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও কষ্টে পুরুষদের না কাঁদা বিপজ্জনক

  • আপডেট সময় : ০৭:৩৩:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
  • ১ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

লাইফস্টাইল ডেস্ক: আমাদের জীবনে অনেক সময়ই এমন হয় যে, ভালো না থাকলেও অন্যের প্রশ্নের জবাবে জোর করে উত্তর দিতে হয়- ‘আমি ভালো আছি’ বা ‘আমি ঠিক আছি’। এই যে ভালো না থাকলেও জোর করে ভালো থাকার অভিনয়, নিজের মানসিক দুর্বলতা প্রকাশ না করার প্রবণতা- এগুলো আসলে খুব অদ্ভুত। যখনই কেউ আমাদের খোঁজ নেয়, জানতে চায় কেমন আছি; তখনই আমরা খুব সহজভাবে কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেলি- ‘ভালো আছি’। কারণ আমরা আসলে মুখ খুলতে বা সত্য বলতে ভয় পাই।

আমরা ভালো থাকার ভান করি, সবকিছু চেপে রাখি। আর এমনভাবে এগিয়ে যাই- যেন কিছুই হয়নি; বিশেষ করে এই প্রত্যাশার চাপ পুরুষদের ওপর অনেক বেশি থাকে। নারীরা ‘আবেগপ্রবণ’ হিসেবে পরিচিত হলেও অন্তত পরিচিত নারী বা নিজের কাছের বন্ধুদের কাছে মনের সত্যিকারের ভাব প্রকাশ করতে পারেন এবং সেখানে আশ্রয়ও খুঁজে পান। কিন্তু পুরুষরা নিজের খুব কাছের মানুষের কাছেও সত্যিকার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন না। মনের কষ্টে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলাকে এখানে তুলনা করা হয় নিজের গোটা পুরুষত্ব খুইয়ে দেওয়ার সঙ্গে। এটাকে দেখা হয় লজ্জা এবং দুর্বলতার বিষয় হিসেবে। আমাদের সমাজে পুরুষকে সব সময় শান্ত, সুসংহত ও শক্তিশালী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে বাধ্য করা হয়; এমনকি তারা যখন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছেন, তখনো বাইরে থেকে শক্তপোক্ত দেখাতে হয়। আর এই সংকটের মূলে রয়েছে ওই পুরোনো পুরুষতন্ত্র; যা পুরুষকে পরিবারের প্রধান হতে বাধ্য করে। পুরুষকে হতে বলে এমন এক স্তম্ভ; যা কোনো ঝড়ে ভেঙে পড়ে না।

ছোটবেলা থেকেই আমরা ছেলেদের বলি, ‘সত্যিকারের পুরুষ হয়ে ওঠো।’ তাদের বলি- ‘ছেলেরা কখনো কাঁদে না।’ হয়তো খুব পরিকল্পনা করে বা ছেলেদের কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসব কথা বলা হয় না। এরপরও ছোটবেলা থেকে এসব শুনতে শুনতে এক সময় পুরুষদের খুব গভীরে এগুলো প্রোথিত হয়ে যায়। ছেলেরা শেখে দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। সময়ের সঙ্গে পরে এটি পুরুষের জন্য নিয়মে পরিণত হয়। আর এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছেলেরা শিখে যায়, পুরুষ কখনো কাঁদে না। এক পর্যায়ে গিয়ে পুরুষ তার নিজের মানসিক চাহিদাগুলোকেই অস্বীকার করতে শুরু করে। ফলে এসবের জন্য থেরাপি নেওয়া বা ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপ করারও প্রসঙ্গ ওঠে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, নারীর তুলনায় পুরুষরে আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আত্মহত্যায় মৃত্যুর ৮০ শতাংশই পুরুষ। অন্যদিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০২২ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩০ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, তারা হতাশা বোধ করলে কারো সঙ্গে তা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করেন। অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৬০ শতাংশেরও বেশি। এটা কেবল পরিসংখ্যান নয়। আদতে এটি হলো পুরুষতন্ত্রের ব্যর্থতার দায়; যা যুগ যুগ ধরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরুষদের ওপর।

পৌরুষ মানেই আবেগ নিয়ন্ত্রণের যে ধারণা তা কেবল পুরোনোই নয়, বরং বিপজ্জনকও। যে পুরুষরা তাদের আবেগ চেপে রাখেন; তাদের মধ্যে রাগ, হতাশা ও অ্যালকোহলের ওপর নির্ভরতা বেশি দেখা যায়। ফলে বেশির ভাগ সময়ই তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। সবচেয়ে খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়- যখন এই চেপে রাখা আবেগ অন্যকে নির্যাতনের কারণ হয়, সৃষ্টি করে সহিংসতা বা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তৈরি করে মানসিক বিচ্ছিন্নতা। এসবই একটি শিশুর লালন-পালনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শিশুকালে পাওয়া এসব আঘাত সে বড় হওয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলে।

প্রথমেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, এটি পুরুষতান্ত্রিকতার একটি সমস্যা। আর এটাই হলো এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। আমাদের ছেলে সন্তান বড় করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে- তাকে যেন এটা শেখানো না হয় যে, আবেগের প্রকাশ মানে দুর্বলতা। ছেলেদের তাদের আবেগ লুকিয়ে রাখতে শেখানো বন্ধ করতে হবে; বরং তাদের শেখাতে হবে কীভাবে নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে হয়, সবার সামনে আবেগকে কীভাবে স্বীকার করে নিতে হয়। আর এ কারণেই বিশ্বজুড়ে সব সংস্কৃতিতে পৌরুষের নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করা দরকার। আমাদের ছেলে সন্তানদের শেখাতে হবে যে, শক্তি হলো সেটিই- যা আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করে। তাদের বলতে হবে, কান্না কারো চরিত্রের ব্যর্থতা নয়, এটি আঘাত বা বিষণ্নতা প্রকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পুরুষরাও অন্য সবার মতোই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায়; যা খুবই স্বাভাবিক। তাই এরপর যখন আপনার বা আপনার আশপাশের কোনো পুরুষের মানসিক যন্ত্রণা হবে, তখন তাকে ‘আসল পুরুষ’ হতে বলবেন না। কারণ ছেলেরাও কাঁদে এবং প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই তাদের কাঁদা উচিত।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও কষ্টে পুরুষদের না কাঁদা বিপজ্জনক

আপডেট সময় : ০৭:৩৩:২৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

লাইফস্টাইল ডেস্ক: আমাদের জীবনে অনেক সময়ই এমন হয় যে, ভালো না থাকলেও অন্যের প্রশ্নের জবাবে জোর করে উত্তর দিতে হয়- ‘আমি ভালো আছি’ বা ‘আমি ঠিক আছি’। এই যে ভালো না থাকলেও জোর করে ভালো থাকার অভিনয়, নিজের মানসিক দুর্বলতা প্রকাশ না করার প্রবণতা- এগুলো আসলে খুব অদ্ভুত। যখনই কেউ আমাদের খোঁজ নেয়, জানতে চায় কেমন আছি; তখনই আমরা খুব সহজভাবে কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেলি- ‘ভালো আছি’। কারণ আমরা আসলে মুখ খুলতে বা সত্য বলতে ভয় পাই।

আমরা ভালো থাকার ভান করি, সবকিছু চেপে রাখি। আর এমনভাবে এগিয়ে যাই- যেন কিছুই হয়নি; বিশেষ করে এই প্রত্যাশার চাপ পুরুষদের ওপর অনেক বেশি থাকে। নারীরা ‘আবেগপ্রবণ’ হিসেবে পরিচিত হলেও অন্তত পরিচিত নারী বা নিজের কাছের বন্ধুদের কাছে মনের সত্যিকারের ভাব প্রকাশ করতে পারেন এবং সেখানে আশ্রয়ও খুঁজে পান। কিন্তু পুরুষরা নিজের খুব কাছের মানুষের কাছেও সত্যিকার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন না। মনের কষ্টে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলাকে এখানে তুলনা করা হয় নিজের গোটা পুরুষত্ব খুইয়ে দেওয়ার সঙ্গে। এটাকে দেখা হয় লজ্জা এবং দুর্বলতার বিষয় হিসেবে। আমাদের সমাজে পুরুষকে সব সময় শান্ত, সুসংহত ও শক্তিশালী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে বাধ্য করা হয়; এমনকি তারা যখন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছেন, তখনো বাইরে থেকে শক্তপোক্ত দেখাতে হয়। আর এই সংকটের মূলে রয়েছে ওই পুরোনো পুরুষতন্ত্র; যা পুরুষকে পরিবারের প্রধান হতে বাধ্য করে। পুরুষকে হতে বলে এমন এক স্তম্ভ; যা কোনো ঝড়ে ভেঙে পড়ে না।

ছোটবেলা থেকেই আমরা ছেলেদের বলি, ‘সত্যিকারের পুরুষ হয়ে ওঠো।’ তাদের বলি- ‘ছেলেরা কখনো কাঁদে না।’ হয়তো খুব পরিকল্পনা করে বা ছেলেদের কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে এসব কথা বলা হয় না। এরপরও ছোটবেলা থেকে এসব শুনতে শুনতে এক সময় পুরুষদের খুব গভীরে এগুলো প্রোথিত হয়ে যায়। ছেলেরা শেখে দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। সময়ের সঙ্গে পরে এটি পুরুষের জন্য নিয়মে পরিণত হয়। আর এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছেলেরা শিখে যায়, পুরুষ কখনো কাঁদে না। এক পর্যায়ে গিয়ে পুরুষ তার নিজের মানসিক চাহিদাগুলোকেই অস্বীকার করতে শুরু করে। ফলে এসবের জন্য থেরাপি নেওয়া বা ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে আলাপ করারও প্রসঙ্গ ওঠে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, নারীর তুলনায় পুরুষরে আত্মহত্যার হার দ্বিগুণ। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই আত্মহত্যায় মৃত্যুর ৮০ শতাংশই পুরুষ। অন্যদিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০২২ সালে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একটি জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৩০ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, তারা হতাশা বোধ করলে কারো সঙ্গে তা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করেন। অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৬০ শতাংশেরও বেশি। এটা কেবল পরিসংখ্যান নয়। আদতে এটি হলো পুরুষতন্ত্রের ব্যর্থতার দায়; যা যুগ যুগ ধরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরুষদের ওপর।

পৌরুষ মানেই আবেগ নিয়ন্ত্রণের যে ধারণা তা কেবল পুরোনোই নয়, বরং বিপজ্জনকও। যে পুরুষরা তাদের আবেগ চেপে রাখেন; তাদের মধ্যে রাগ, হতাশা ও অ্যালকোহলের ওপর নির্ভরতা বেশি দেখা যায়। ফলে বেশির ভাগ সময়ই তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। সবচেয়ে খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়- যখন এই চেপে রাখা আবেগ অন্যকে নির্যাতনের কারণ হয়, সৃষ্টি করে সহিংসতা বা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তৈরি করে মানসিক বিচ্ছিন্নতা। এসবই একটি শিশুর লালন-পালনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শিশুকালে পাওয়া এসব আঘাত সে বড় হওয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তা তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কগুলোর ওপরও প্রভাব ফেলে।

প্রথমেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, এটি পুরুষতান্ত্রিকতার একটি সমস্যা। আর এটাই হলো এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম ধাপ। আমাদের ছেলে সন্তান বড় করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে- তাকে যেন এটা শেখানো না হয় যে, আবেগের প্রকাশ মানে দুর্বলতা। ছেলেদের তাদের আবেগ লুকিয়ে রাখতে শেখানো বন্ধ করতে হবে; বরং তাদের শেখাতে হবে কীভাবে নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে হয়, সবার সামনে আবেগকে কীভাবে স্বীকার করে নিতে হয়। আর এ কারণেই বিশ্বজুড়ে সব সংস্কৃতিতে পৌরুষের নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করা দরকার। আমাদের ছেলে সন্তানদের শেখাতে হবে যে, শক্তি হলো সেটিই- যা আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করে। তাদের বলতে হবে, কান্না কারো চরিত্রের ব্যর্থতা নয়, এটি আঘাত বা বিষণ্নতা প্রকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পুরুষরাও অন্য সবার মতোই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায়; যা খুবই স্বাভাবিক। তাই এরপর যখন আপনার বা আপনার আশপাশের কোনো পুরুষের মানসিক যন্ত্রণা হবে, তখন তাকে ‘আসল পুরুষ’ হতে বলবেন না। কারণ ছেলেরাও কাঁদে এবং প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই তাদের কাঁদা উচিত।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ