ঢাকা ০৮:০৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

আফগানিস্তানে মার্কিনিদের পরাজয় নাকি নয়া কৌশল

  • আপডেট সময় : ০৯:৫৩:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ জুলাই ২০২১
  • ১২২ বার পড়া হয়েছে

Helicopters carrying U.S. Army soldiers from the 1-320 Field Artillery Regiment, 101st Airborne Division, take off from Combat Outpost Terra Nova as the soldiers head home following a 10-month deployment in the Arghandab Valley north of Kandahar April 23, 2011. REUTERS/Bob Strong (AFGHANISTAN - Tags: MILITARY POLITICS IMAGES OF THE DAY)

জয়দীপ দে : ২৯ এপ্রিল ১৯৭৫। উত্তর ভিয়েতনামের পিপলস আর্মি এবং ভিয়েত কং গেরিলারা সায়গন শহরের উপকণ্ঠে হাজির। সকাল থেকে প্রায় বিনা প্রতিরোধে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে শহরে। মার্কিন বাহিনি কিংবা তাদের অনুগত দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্যদের তেমন কিছুই করার ছিল না। মার্কিন রণতরী মিডওয়ে থেকে শুরু হয় অপারেশন ‘ফ্রিক্যুয়েন্ট উইন্ড’।

বোমা হামলায় যেহেতু বিমানবন্দর অবতরণের অনুপযোগী, তাই মার্কিন দূতাবাসের ছাদে হেলিকপ্টার এনে দড়ি দিয়ে টেনে সরিয়ে নেয়া হয় মার্কিন নাগরিকদের। সায়গনের মার্কিন দূতাবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার ছবি মার্কিন মোড়লিপনার ইতিহাসে নির্লজ্জ পরাজয়ের প্রতীক হয়েছিল এতো কাল। ৫৮,২২০ জন সৈনিকের আত্মাহুতি এবং দেড় লাখ যুদ্ধাহতের মূল্য দিয়ে ১৯ বছর ৫ মাস ৪ সপ্তাহ ১ দিন পরে চোরের মতো পালিয়ে আসতে হয়েছিল মার্কিনিদের।

ঠিক ৪৬ বছর পর প্রায় একই রকমের পরিস্থিতির মুখোমুখি মার্কিনিরা আফগানিস্তানে। তবে চতুর মার্কিনিরা ‘সায়গন ইভাকুয়েশন’-এর ছবি যেন আবার তোলা না হয়, সেজন্য আফগান যুদ্ধের মাঝামাঝিতেই সচেতন হয়ে উঠেছিল। তাই এক হাতে রণতূর্য নিলেও গোপন হাতে তারা ঠিকই আলোচনার ‘বাঁশের বাঁশরী’ বাজিয়ে যাচ্ছিল। সেই সংগীত একেবারে বৃথা যায়নি।

২০২০-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনিদের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেশী পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের প্রতিনিধিবৃন্দ। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ৫ হাজার তালেবান বন্দিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেবে আফগান সরকার। বিনিময়ে তালেবানরা আইএস এবং আল কায়দা’র সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক রাখবে না।
এই চুক্তির উপর ভিত্তি করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১ মে ২০২১-র মধ্যে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সময়কাল ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বর্ধিত করেছেন। ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ন্যাটো জোটের সৈন্যদেরও প্রত্যাহার করা হবে।

আগামী ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর পূর্তি হবে। এই হামলার পরই আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয় আফগানিস্তানের শাসক তালেবান সরকার। সেই বিন লাদেনকে ধরার জন্য আফগানিস্তানে আক্রমণ শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনি। ঠিক ভিয়েতনামের মতো বিশ বছর পূর্তির আগেই তাদের চলে যেতে হচ্ছে। তবে এই চলে যাওয়া সায়গনের মতো প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যাওয়া নয়। বরং আপাত-নির্বিঘœ পরিবেশে সবকিছু ছুঁড়ে চলে যাওয়া। আর এ অভিনব চলে যাওয়াই গত এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রিটিশ টিভি চ্যানেল স্কাই নিউজের সংবাদদাতা আলেক্স ক্র্যাফোর্ড গত সপ্তাহে ওয়ার্দুক প্রদেশে একটি মার্কিন আর্মি বেস দেখতে গিয়েছিলেন। বিশাল অঞ্চলজুড়ে এ সেনাছাউনি। রাতের অন্ধকারে মার্কিন সেনারা সেই ছাউনি ছেড়ে চলে যায়। পরের দিন সকালে তালেবানরা তার দখল নেয়। তারা স্কাই নিউজকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের শক্তিমত্তা দেখে যাওয়ার জন্য। সেই সূত্রে ক্র্যাফোর্ডের যাওয়া।

সেখানে গিয়ে ক্র্যাফোর্ড দেখতে পান শত শত কন্টেইনার ভর্তি যুদ্ধের রসদ ফেলে চলে গেছে মার্কিন সৈন্যরা। এর মধ্যে আছে প্রচুর সমরাস্ত্র। হাজার বাক্স গোলা বারুদ। এমন কিছু কন্টেইনার আছে যেসব এর আগে খোলা পর্যন্ত হয়নি। তালেবানদের হিসেবে এখান থেকে তারা ৯০০ বন্দুক, ৩০টি হামভিস নামের বুলেটপ্রুফ সাঁজোয়া যান, ২০টি আর্মি পিক-আপ ট্রাক পেয়েছে। তালেবানদের সমরাস্ত্র বলতে হাতে বহনযোগ্য অস্ত্র আর পরিবহনের জন্য মোটর বাইক ও গাধা। নতুন পাওয়া এসব রসদ তাদের শক্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এখানেই সন্দেহ। একটি সেনাবাহিনী যখন তাদের কোনো স্থাপনা ফেলে চলে যায়, হয় তা বন্ধু বাহিনির কাছে বুঝিয়ে দেয়, নতুবা রসদ ও সমরাস্ত্র ধ্বংস করে দিয়ে যায়, যাতে শত্রুপক্ষ দখল করতে না পারে। কিন্তু মার্কিন সেনাবাহিনী মোটেও তা করছে না। তাহলে তারা কী চাচ্ছে না, তাদের রেখে যাওয়া অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে আফগানিস্তানের সরকার তালেবানদের প্রতিরোধ করুক। নাকি তারা চাচ্ছে এসব অস্ত্র নিয়ে তালেবানরা সরকারি বাহিনীর মুখোমুখি হোক।

তালেবানরা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের ৪২১টি জেলার মধ্যে দুইশ’টির বেশি দখল করে ফেলেছে। উত্তরাঞ্চল সবসময় তালেবানবিরোধী অঞ্চল বলে পরিচিত। বিশেষ করে তাজিক ও হাজরারা পাঠান তালেবানদের শত্রু জ্ঞান করে। সেখানেও কোনো প্রতিরোধ না গড়ে সরকারি বাহিনীর এগারোশ সদস্য পালিয়ে প্রতিবেশী তাজাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। যা একটু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে বাগদিস প্রদেশের রাজধানীতে। কাবুলের সাধারণ নাগরিকরা ভীত। নারীরা অস্ত্র হাতে তালেবান-বিরোধী মিছিল করছে। অবশ্য সরকারের মুখপাত্র তাদের বিপুল শক্তির বাগাড়ম্বর করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের দুর্বলতার দিকও প্রকাশ পাচ্ছে মাঝে মাঝে। আফগানিস্তান সেনবাহিনী আমেরিকান ঠিকাদারদের সরবরাহের উপর নির্ভরশীল। তারা চলে যাওয়ায় তাদের রসদ সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক যানবাহন অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
অবশ্য বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনী ছাড়া একটি সৈন্যদল তালেবানদের মতো একটা বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে কতটা সফল হবে সেটাও প্রশ্ন। অথচ গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র সোয়া দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে হিন্দুকুশ পর্বতমালার এই উষর ভূমিতে। তারা কি পারত না চলে যাওয়ার আগে কিছু বিমান ও গোলন্দাজ সামগ্রী আফগান সেনাবাহিনীর জন্য রেখে যেতে?

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো বিমান ঘাঁটি ছিল বাগরাম এয়ারবেইস। সেখানে একসময় দশ হাজার মার্কিন সেনা থাকত। সেটাও রাতের অন্ধকারে খালি করে চলে গেছে মার্কিনিরা। সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তাদের আচরণে স্পষ্ট যে তারা আফগান সরকারকে সাহায্য করতে অনিচ্ছুক। জো বাইডেনের ভাষায়, ‘জাতি গঠনের দায়িত্ব তাদের নয়’। তাই বলে একটা জাতিকে গভীর সংকটে ফেলে যাওয়ার অধিকারও তো তাদের কেউ দেয়নি।

গত বিশ বছরের যুদ্ধে ৬৬ থেকে ৬৯ হাজার আফগান সৈন্য নিহত হয়েছে। ৪৭,২৪৫ জন সাধারণ নাগরিক, ২,৪৪২ জন মার্কিন ও ৪৫৫ ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়েছে। লক্ষ্য একটাই ছিল তালেবানদের প্রতিরোধ করা। সেই তালেবানদেরকেই এখন যেন অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনী। তাহলে এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র কি নতুন কোনো খেলায় নেমেছে?

তালেবানকে অনেকেই আল কায়দা এবং আইএস-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে তালেবানরা আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা শক্তি। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার আগে তাদের অনুগত নাজিবুল্লাহ’র হাতে তারা ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে যায়। সেই নাজিবুল্লাহ বাহিনীর পতন ঘটে ১৯৯২ সালে। এরপর থেকেই আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এর আগেও যে খুব একটা ছিল, তা বলা যাবে না। পথে-ঘাটে চুরি ডাকাতি রাহাজানি লেগেই ছিল। ১৯৯৪ সালে কান্দাহারের সিঙ্গেসর অঞ্চলে একটি বরযাত্রীর গাড়ি পণবন্দি করে ডাকাতরা। সেখানেই একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন মোল্লা ওমর। তিনি তার তালেবান বা শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেই ডাকাতদের প্রতিহত করতে যান এবং বরযাত্রীদের মুক্ত করেন। পরে তার এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যান্য মাদ্রাসাগুলো অরাজকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। মাদ্রাসাভিত্তিক শক্তিকে সংগঠিত করে মোল্লা ওমর এই ‘তালেবান’ গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। তবে এর পেছনে ছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা কাবুল দখল করে। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের হয়ে যুদ্ধে নামে। তালেবানদের আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়। সে বছরই তারা সাবেক প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলায়। প্রকাশ্য স্থানে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে দেয়। নারীর শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারা কট্টর শরীয়া আইন চালু করে। ৫ বছরের মাথায় মার্কিন আক্রমণের মুখে সেই শাসনেরও অবসান ঘটে।

এ প্রসঙ্গ তোলার একটাই কারণ, প্রকাশ্যে যে যাই বলুক, তালেবানের উত্থান ও সাফল্য পাকিস্তানের হাত ধরে। তাদের নিয়ন্ত্রণের রাশ এখনো পাকিস্তানের হাতে। তালেবান এখন আগের চেয়ে অনেক কৌশলী। তারা মুখে যতই বলুক না কেন দুর্নীতিবাজ সরকারের সঙ্গে তারা সমঝোতা করবে না, এতোদিন কিন্তু তারা সমঝোতা করেই চলেছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে সরকার কিংবা মার্কিন বাহিনী তেমন উপদ্রব করেনি। উপরন্তু সেসব অঞ্চলে সরকার স্কুল ও হাসপাতাল পরিচালনা করেছে। রাস্তাঘাট করে দিয়েছে। বিনিময়ে তালেবানরা নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও চাকরি করার সুযোগ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও তালেবানরা অনেক পরিপক্ব ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হয়েছে। তালেবানদের দুই মুখপাত্র সুহালি শাহীন ও শের মোহাম্মদ আব্বাস স্টানিকজাই নিয়মিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে হাজির হচ্ছেন। অত্যন্ত ঠা-া মাথায় তারা তালেবানদের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। তারা বলেছেন, নারীদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মের ব্যবস্থা করবেন তারা। সকল দেশের জন্য আফগানিস্তান উন্মুক্ত থাকবে। এমনকি দেশ পুনর্গঠনের জন্য তিনি আমেরিকার বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাবেন।

ইরান, চীন ও রাশিয়ার মতো বৃহৎ প্রতিবেশীরা তালেবানদের প্রতি অনেক নমনীয়। রাশিয়া তালেবানদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা হয়েছে। সে চায় হাজরা ও তাজিকদের নিরাপত্তা। চীন তালেবানদের জয় নিজের জয় হিসেবে দেখছে। কারণ এর রাশ তার বশংবদ পাকিস্তানের হাতে। ইতোমধ্যে তালেবানের পক্ষ থেকে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। ফলে চীন বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ পাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান পুনর্গঠনে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে আফগানিস্তানকে যুক্ত করলে তিনটি দেশই লাভবান হবে। বিস্তৃত হবে বাণিজ্যের ক্ষেত্র।

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আফগানিস্তানে অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইমাক, বেলুচ, হাজরা, নুরিস্তানি, পাস্তুন, সাদাত, তাজিক, উজবেক ও তুর্কি। সংখ্যায় পাস্তুনরা বেশি হলেও এরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকও নয়। তালেবানরা প্রধানত পাস্তুন। এদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তাজিক, উজবেক ও হাজরারা। এদের একত্রিত করে আহমদ শাহ মাসউদ নর্দান এলায়েন্স গঠন করেছিলেন। তালেবানদের স্বর্ণযুগেও শস্যসমৃদ্ধ পঞ্চশির ভ্যালিসহ আফগানিস্তানের ৩০ শতাংশ ভূমি তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইতোমধ্যে তার ৩২ বছরের পুত্র লন্ডন থেকে ফিরে তালেবানদের প্রতিরোধে মাঠে নেমেছেন। সরকারি বাহিনী গত বিশ বছর ন্যাটো সৈন্যদের সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত হয়েছে। আধুনিক অস্ত্র পেয়েছে। প্রায় দুই লক্ষ প্রশিক্ষিত সদস্য আছে সেখানে। তাই তাদের খাটোভাবে দেখার সুযোগ নেই।

শেষমেশ হিসেব দাঁড়াচ্ছে এই- তালেবান, নর্দান এলায়েন্স ও সরকারি বাহিনী তিনটি দৃশ্যমান শক্তি আফগানিস্তানে ক্রিয়াশীল। তালেবান যদি নির্বাচনের পথে না গিয়ে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় আরোহণ করে তাহলে অন্যান্য শক্তিগুলোও বিচ্ছিন্নতার সুযোগ পাবে। বিশেষ করে সরকারি বাহিনী যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়েছিল তাই তারা এ নিয়ে বিশ্ব জনমত তৈরিতে চেষ্টা করবে। তাছাড়া উপজাতিগোষ্ঠীরাও ছোট ছোট দল গড়ে তুলতে পারে। তাই তালেবানের বিজয়ে আফগানিস্তানকে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। হতে পারে ব্যর্থ মনস্কামে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের জন্য একটা বিষফোঁড়া রেখে দিয়ে গেল। যেমনটা ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিল।

ইতোমধ্যে পাকিস্তান তালেবানদের কোনো রকম সাহায্য করবে না বলে জানিয়েছে। দেশটি সীমান্ত সিল করে দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। মানে ইমরান খান সম্ভাব্য ঝুঁকিকে সামনে রেখে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রায় অরক্ষিত। এর অনেক অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবেশগম্যতা পর্যন্ত নেই। এমন অবস্থায় সীমান্ত বন্ধ কতটা কার্যকর হবে তাই দেখার বিষয়।

পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর থেকে চীনের শিনচিয়াং প্রদেশের কাশগর পর্যন্ত দুই হাজার কিলোমিটার যে পথ করা হয়েছে, তার কিছু অংশ কিন্তু আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া। এই রাস্তাকে কেন্দ্র করে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে চীন। পাকিস্তান ও চীনের গাঁটছড়া এবং চীনের আফ্রিকা যাওয়ার সহজ রাস্তা নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। গোয়াদারে চীনের অবস্থান মানেই সুয়েজ খালের প্রবেশদ্বারে চীন বসে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শত্রু ইরান গদর-নবাবশাহ গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ উপেক্ষা করে সহজে চীন ও পাকিস্তানে জ্বালানি বিক্রির সুযোগ পাবে। পরে তা সে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারে। তাহলে ভবিষ্যতে কোনো অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানকে আর কাবু করতে পারবে না। তার জ্বালানি বিক্রির জন্য অন্য কোনো ক্রেতার প্রয়োজন পড়বে না। চির দুই শত্রুর এমন ঈর্ষণীয় বাণিজ্যিক সাফল্য নিশ্চয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে মেনে নিতে পারে না।

তাই ১ সেপ্টেম্বরের পর আফগানিস্তানে কী হতে যাচ্ছে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়, ভূরাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য অশিক্ষিত আবেগী ও বাস্তববুদ্ধিবর্জিত আফগানদের নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর আরো খেলা বাকি আছে।

আবার ভিয়েতনামে ফিরে যাই। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট দিয়েমের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ম্যাডাম নুহ রোমে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই। আমেরিকার উসকানি ও সহযোগিতা ছাড়া কোনো অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে পারে না।’
তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে খেলায় জড়িয়ে সে খেলার শেষ বলে দেয়া কঠিন।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

আফগানিস্তানে মার্কিনিদের পরাজয় নাকি নয়া কৌশল

আপডেট সময় : ০৯:৫৩:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ জুলাই ২০২১

জয়দীপ দে : ২৯ এপ্রিল ১৯৭৫। উত্তর ভিয়েতনামের পিপলস আর্মি এবং ভিয়েত কং গেরিলারা সায়গন শহরের উপকণ্ঠে হাজির। সকাল থেকে প্রায় বিনা প্রতিরোধে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে শহরে। মার্কিন বাহিনি কিংবা তাদের অনুগত দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্যদের তেমন কিছুই করার ছিল না। মার্কিন রণতরী মিডওয়ে থেকে শুরু হয় অপারেশন ‘ফ্রিক্যুয়েন্ট উইন্ড’।

বোমা হামলায় যেহেতু বিমানবন্দর অবতরণের অনুপযোগী, তাই মার্কিন দূতাবাসের ছাদে হেলিকপ্টার এনে দড়ি দিয়ে টেনে সরিয়ে নেয়া হয় মার্কিন নাগরিকদের। সায়গনের মার্কিন দূতাবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার ছবি মার্কিন মোড়লিপনার ইতিহাসে নির্লজ্জ পরাজয়ের প্রতীক হয়েছিল এতো কাল। ৫৮,২২০ জন সৈনিকের আত্মাহুতি এবং দেড় লাখ যুদ্ধাহতের মূল্য দিয়ে ১৯ বছর ৫ মাস ৪ সপ্তাহ ১ দিন পরে চোরের মতো পালিয়ে আসতে হয়েছিল মার্কিনিদের।

ঠিক ৪৬ বছর পর প্রায় একই রকমের পরিস্থিতির মুখোমুখি মার্কিনিরা আফগানিস্তানে। তবে চতুর মার্কিনিরা ‘সায়গন ইভাকুয়েশন’-এর ছবি যেন আবার তোলা না হয়, সেজন্য আফগান যুদ্ধের মাঝামাঝিতেই সচেতন হয়ে উঠেছিল। তাই এক হাতে রণতূর্য নিলেও গোপন হাতে তারা ঠিকই আলোচনার ‘বাঁশের বাঁশরী’ বাজিয়ে যাচ্ছিল। সেই সংগীত একেবারে বৃথা যায়নি।

২০২০-এর ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনিদের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেশী পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানের প্রতিনিধিবৃন্দ। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ৫ হাজার তালেবান বন্দিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেবে আফগান সরকার। বিনিময়ে তালেবানরা আইএস এবং আল কায়দা’র সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক রাখবে না।
এই চুক্তির উপর ভিত্তি করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১ মে ২০২১-র মধ্যে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই সময়কাল ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বর্ধিত করেছেন। ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ন্যাটো জোটের সৈন্যদেরও প্রত্যাহার করা হবে।

আগামী ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর পূর্তি হবে। এই হামলার পরই আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেয় আফগানিস্তানের শাসক তালেবান সরকার। সেই বিন লাদেনকে ধরার জন্য আফগানিস্তানে আক্রমণ শুরু করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনি। ঠিক ভিয়েতনামের মতো বিশ বছর পূর্তির আগেই তাদের চলে যেতে হচ্ছে। তবে এই চলে যাওয়া সায়গনের মতো প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে যাওয়া নয়। বরং আপাত-নির্বিঘœ পরিবেশে সবকিছু ছুঁড়ে চলে যাওয়া। আর এ অভিনব চলে যাওয়াই গত এক সপ্তাহ ধরে বিশ্ব মিডিয়ার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রিটিশ টিভি চ্যানেল স্কাই নিউজের সংবাদদাতা আলেক্স ক্র্যাফোর্ড গত সপ্তাহে ওয়ার্দুক প্রদেশে একটি মার্কিন আর্মি বেস দেখতে গিয়েছিলেন। বিশাল অঞ্চলজুড়ে এ সেনাছাউনি। রাতের অন্ধকারে মার্কিন সেনারা সেই ছাউনি ছেড়ে চলে যায়। পরের দিন সকালে তালেবানরা তার দখল নেয়। তারা স্কাই নিউজকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের শক্তিমত্তা দেখে যাওয়ার জন্য। সেই সূত্রে ক্র্যাফোর্ডের যাওয়া।

সেখানে গিয়ে ক্র্যাফোর্ড দেখতে পান শত শত কন্টেইনার ভর্তি যুদ্ধের রসদ ফেলে চলে গেছে মার্কিন সৈন্যরা। এর মধ্যে আছে প্রচুর সমরাস্ত্র। হাজার বাক্স গোলা বারুদ। এমন কিছু কন্টেইনার আছে যেসব এর আগে খোলা পর্যন্ত হয়নি। তালেবানদের হিসেবে এখান থেকে তারা ৯০০ বন্দুক, ৩০টি হামভিস নামের বুলেটপ্রুফ সাঁজোয়া যান, ২০টি আর্মি পিক-আপ ট্রাক পেয়েছে। তালেবানদের সমরাস্ত্র বলতে হাতে বহনযোগ্য অস্ত্র আর পরিবহনের জন্য মোটর বাইক ও গাধা। নতুন পাওয়া এসব রসদ তাদের শক্তি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এখানেই সন্দেহ। একটি সেনাবাহিনী যখন তাদের কোনো স্থাপনা ফেলে চলে যায়, হয় তা বন্ধু বাহিনির কাছে বুঝিয়ে দেয়, নতুবা রসদ ও সমরাস্ত্র ধ্বংস করে দিয়ে যায়, যাতে শত্রুপক্ষ দখল করতে না পারে। কিন্তু মার্কিন সেনাবাহিনী মোটেও তা করছে না। তাহলে তারা কী চাচ্ছে না, তাদের রেখে যাওয়া অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে আফগানিস্তানের সরকার তালেবানদের প্রতিরোধ করুক। নাকি তারা চাচ্ছে এসব অস্ত্র নিয়ে তালেবানরা সরকারি বাহিনীর মুখোমুখি হোক।

তালেবানরা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের ৪২১টি জেলার মধ্যে দুইশ’টির বেশি দখল করে ফেলেছে। উত্তরাঞ্চল সবসময় তালেবানবিরোধী অঞ্চল বলে পরিচিত। বিশেষ করে তাজিক ও হাজরারা পাঠান তালেবানদের শত্রু জ্ঞান করে। সেখানেও কোনো প্রতিরোধ না গড়ে সরকারি বাহিনীর এগারোশ সদস্য পালিয়ে প্রতিবেশী তাজাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। যা একটু প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে বাগদিস প্রদেশের রাজধানীতে। কাবুলের সাধারণ নাগরিকরা ভীত। নারীরা অস্ত্র হাতে তালেবান-বিরোধী মিছিল করছে। অবশ্য সরকারের মুখপাত্র তাদের বিপুল শক্তির বাগাড়ম্বর করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের দুর্বলতার দিকও প্রকাশ পাচ্ছে মাঝে মাঝে। আফগানিস্তান সেনবাহিনী আমেরিকান ঠিকাদারদের সরবরাহের উপর নির্ভরশীল। তারা চলে যাওয়ায় তাদের রসদ সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক যানবাহন অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
অবশ্য বিমান ও গোলন্দাজ বাহিনী ছাড়া একটি সৈন্যদল তালেবানদের মতো একটা বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে কতটা সফল হবে সেটাও প্রশ্ন। অথচ গত বিশ বছরে যুক্তরাষ্ট্র সোয়া দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে হিন্দুকুশ পর্বতমালার এই উষর ভূমিতে। তারা কি পারত না চলে যাওয়ার আগে কিছু বিমান ও গোলন্দাজ সামগ্রী আফগান সেনাবাহিনীর জন্য রেখে যেতে?

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো বিমান ঘাঁটি ছিল বাগরাম এয়ারবেইস। সেখানে একসময় দশ হাজার মার্কিন সেনা থাকত। সেটাও রাতের অন্ধকারে খালি করে চলে গেছে মার্কিনিরা। সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তাদের আচরণে স্পষ্ট যে তারা আফগান সরকারকে সাহায্য করতে অনিচ্ছুক। জো বাইডেনের ভাষায়, ‘জাতি গঠনের দায়িত্ব তাদের নয়’। তাই বলে একটা জাতিকে গভীর সংকটে ফেলে যাওয়ার অধিকারও তো তাদের কেউ দেয়নি।

গত বিশ বছরের যুদ্ধে ৬৬ থেকে ৬৯ হাজার আফগান সৈন্য নিহত হয়েছে। ৪৭,২৪৫ জন সাধারণ নাগরিক, ২,৪৪২ জন মার্কিন ও ৪৫৫ ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়েছে। লক্ষ্য একটাই ছিল তালেবানদের প্রতিরোধ করা। সেই তালেবানদেরকেই এখন যেন অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে মার্কিন সেনাবাহিনী। তাহলে এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্র কি নতুন কোনো খেলায় নেমেছে?

তালেবানকে অনেকেই আল কায়দা এবং আইএস-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে তালেবানরা আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা শক্তি। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার আগে তাদের অনুগত নাজিবুল্লাহ’র হাতে তারা ক্ষমতা বুঝিয়ে দিয়ে যায়। সেই নাজিবুল্লাহ বাহিনীর পতন ঘটে ১৯৯২ সালে। এরপর থেকেই আফগানিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। এর আগেও যে খুব একটা ছিল, তা বলা যাবে না। পথে-ঘাটে চুরি ডাকাতি রাহাজানি লেগেই ছিল। ১৯৯৪ সালে কান্দাহারের সিঙ্গেসর অঞ্চলে একটি বরযাত্রীর গাড়ি পণবন্দি করে ডাকাতরা। সেখানেই একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন মোল্লা ওমর। তিনি তার তালেবান বা শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেই ডাকাতদের প্রতিহত করতে যান এবং বরযাত্রীদের মুক্ত করেন। পরে তার এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অন্যান্য মাদ্রাসাগুলো অরাজকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। মাদ্রাসাভিত্তিক শক্তিকে সংগঠিত করে মোল্লা ওমর এই ‘তালেবান’ গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। তবে এর পেছনে ছিল পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ১৯৯৬ সালে তালেবানরা কাবুল দখল করে। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের হয়ে যুদ্ধে নামে। তালেবানদের আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়। সে বছরই তারা সাবেক প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলায়। প্রকাশ্য স্থানে নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে দেয়। নারীর শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তারা কট্টর শরীয়া আইন চালু করে। ৫ বছরের মাথায় মার্কিন আক্রমণের মুখে সেই শাসনেরও অবসান ঘটে।

এ প্রসঙ্গ তোলার একটাই কারণ, প্রকাশ্যে যে যাই বলুক, তালেবানের উত্থান ও সাফল্য পাকিস্তানের হাত ধরে। তাদের নিয়ন্ত্রণের রাশ এখনো পাকিস্তানের হাতে। তালেবান এখন আগের চেয়ে অনেক কৌশলী। তারা মুখে যতই বলুক না কেন দুর্নীতিবাজ সরকারের সঙ্গে তারা সমঝোতা করবে না, এতোদিন কিন্তু তারা সমঝোতা করেই চলেছে। তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে সরকার কিংবা মার্কিন বাহিনী তেমন উপদ্রব করেনি। উপরন্তু সেসব অঞ্চলে সরকার স্কুল ও হাসপাতাল পরিচালনা করেছে। রাস্তাঘাট করে দিয়েছে। বিনিময়ে তালেবানরা নারীদের শিক্ষাগ্রহণ ও চাকরি করার সুযোগ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লেও তালেবানরা অনেক পরিপক্ব ভাবমূর্তি নিয়ে হাজির হয়েছে। তালেবানদের দুই মুখপাত্র সুহালি শাহীন ও শের মোহাম্মদ আব্বাস স্টানিকজাই নিয়মিত বিভিন্ন গণমাধ্যমে হাজির হচ্ছেন। অত্যন্ত ঠা-া মাথায় তারা তালেবানদের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। তারা বলেছেন, নারীদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মের ব্যবস্থা করবেন তারা। সকল দেশের জন্য আফগানিস্তান উন্মুক্ত থাকবে। এমনকি দেশ পুনর্গঠনের জন্য তিনি আমেরিকার বিনিয়োগকেও স্বাগত জানাবেন।

ইরান, চীন ও রাশিয়ার মতো বৃহৎ প্রতিবেশীরা তালেবানদের প্রতি অনেক নমনীয়। রাশিয়া তালেবানদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনা হয়েছে। সে চায় হাজরা ও তাজিকদের নিরাপত্তা। চীন তালেবানদের জয় নিজের জয় হিসেবে দেখছে। কারণ এর রাশ তার বশংবদ পাকিস্তানের হাতে। ইতোমধ্যে তালেবানের পক্ষ থেকে তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। ফলে চীন বিপুল বিনিয়োগের সুযোগ পাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান পুনর্গঠনে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে আফগানিস্তানকে যুক্ত করলে তিনটি দেশই লাভবান হবে। বিস্তৃত হবে বাণিজ্যের ক্ষেত্র।

কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। আফগানিস্তানে অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আইমাক, বেলুচ, হাজরা, নুরিস্তানি, পাস্তুন, সাদাত, তাজিক, উজবেক ও তুর্কি। সংখ্যায় পাস্তুনরা বেশি হলেও এরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকও নয়। তালেবানরা প্রধানত পাস্তুন। এদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তাজিক, উজবেক ও হাজরারা। এদের একত্রিত করে আহমদ শাহ মাসউদ নর্দান এলায়েন্স গঠন করেছিলেন। তালেবানদের স্বর্ণযুগেও শস্যসমৃদ্ধ পঞ্চশির ভ্যালিসহ আফগানিস্তানের ৩০ শতাংশ ভূমি তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইতোমধ্যে তার ৩২ বছরের পুত্র লন্ডন থেকে ফিরে তালেবানদের প্রতিরোধে মাঠে নেমেছেন। সরকারি বাহিনী গত বিশ বছর ন্যাটো সৈন্যদের সহযোগিতায় প্রশিক্ষিত হয়েছে। আধুনিক অস্ত্র পেয়েছে। প্রায় দুই লক্ষ প্রশিক্ষিত সদস্য আছে সেখানে। তাই তাদের খাটোভাবে দেখার সুযোগ নেই।

শেষমেশ হিসেব দাঁড়াচ্ছে এই- তালেবান, নর্দান এলায়েন্স ও সরকারি বাহিনী তিনটি দৃশ্যমান শক্তি আফগানিস্তানে ক্রিয়াশীল। তালেবান যদি নির্বাচনের পথে না গিয়ে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতায় আরোহণ করে তাহলে অন্যান্য শক্তিগুলোও বিচ্ছিন্নতার সুযোগ পাবে। বিশেষ করে সরকারি বাহিনী যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়েছিল তাই তারা এ নিয়ে বিশ্ব জনমত তৈরিতে চেষ্টা করবে। তাছাড়া উপজাতিগোষ্ঠীরাও ছোট ছোট দল গড়ে তুলতে পারে। তাই তালেবানের বিজয়ে আফগানিস্তানকে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কিনা তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। হতে পারে ব্যর্থ মনস্কামে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের জন্য একটা বিষফোঁড়া রেখে দিয়ে গেল। যেমনটা ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিল।

ইতোমধ্যে পাকিস্তান তালেবানদের কোনো রকম সাহায্য করবে না বলে জানিয়েছে। দেশটি সীমান্ত সিল করে দেয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। মানে ইমরান খান সম্ভাব্য ঝুঁকিকে সামনে রেখে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রায় অরক্ষিত। এর অনেক অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রবেশগম্যতা পর্যন্ত নেই। এমন অবস্থায় সীমান্ত বন্ধ কতটা কার্যকর হবে তাই দেখার বিষয়।

পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর থেকে চীনের শিনচিয়াং প্রদেশের কাশগর পর্যন্ত দুই হাজার কিলোমিটার যে পথ করা হয়েছে, তার কিছু অংশ কিন্তু আফগানিস্তান সীমান্ত লাগোয়া। এই রাস্তাকে কেন্দ্র করে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে চীন। পাকিস্তান ও চীনের গাঁটছড়া এবং চীনের আফ্রিকা যাওয়ার সহজ রাস্তা নিশ্চয়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। গোয়াদারে চীনের অবস্থান মানেই সুয়েজ খালের প্রবেশদ্বারে চীন বসে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শত্রু ইরান গদর-নবাবশাহ গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ উপেক্ষা করে সহজে চীন ও পাকিস্তানে জ্বালানি বিক্রির সুযোগ পাবে। পরে তা সে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারে। তাহলে ভবিষ্যতে কোনো অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানকে আর কাবু করতে পারবে না। তার জ্বালানি বিক্রির জন্য অন্য কোনো ক্রেতার প্রয়োজন পড়বে না। চির দুই শত্রুর এমন ঈর্ষণীয় বাণিজ্যিক সাফল্য নিশ্চয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহজভাবে মেনে নিতে পারে না।

তাই ১ সেপ্টেম্বরের পর আফগানিস্তানে কী হতে যাচ্ছে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায়, ভূরাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য অশিক্ষিত আবেগী ও বাস্তববুদ্ধিবর্জিত আফগানদের নিয়ে বৃহৎ শক্তিগুলোর আরো খেলা বাকি আছে।

আবার ভিয়েতনামে ফিরে যাই। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট দিয়েমের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ম্যাডাম নুহ রোমে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার কোনো শত্রুর প্রয়োজন নেই। আমেরিকার উসকানি ও সহযোগিতা ছাড়া কোনো অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে পারে না।’
তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে খেলায় জড়িয়ে সে খেলার শেষ বলে দেয়া কঠিন।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক