ঢাকা ০৩:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫
ট্রাইব্যুনালে উপদেষ্টা আসিফের জবানবন্দি

‘আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দিতে রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়’

  • আপডেট সময় : ০৭:৪৭:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক আমার মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। ঐ রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়।

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি জবানবন্দি দেন। বৈষম‍্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই-আগস্টে রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার জবানবন্দি পেশ করেন।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের ১৯তম সাক্ষী হিসেবে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ২৭ বছর। আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ছিলাম। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। ২০১৮ সালে এই কোটা প্রথা সংস্কারের আন্দোলন ব্যাপক মাত্রায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার চাপে পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা প্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালের আন্দোলনেও আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি।

‘কোটা বাতিলের ঐ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়। ২০২৪ সালে ৫ জুন হাইকোর্ট বিভাগ কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে। এই রায়ের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিক্ষোভ মিছিল করি। এরপর কোরবানির ঈদের ছুটি হয়ে যায়। আমরা কোরবানির ঈদের পর ১ জুলাই থেকে পুনরায় আন্দোলন শুরু করি। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ও জেলা শহর পর্যায়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৪ জুলাই আমরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি পেশ করি। সেদিন সন্ধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এর প্রতিবাদে ঐদিন রাতে ঢাবি মেয়েদের হলসহ বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীরা হলের গেটের তালা ভেঙ্গে রাজু ভাস্কর্যের সামনে একত্রিত হয়। সেখানে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা ‘‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে-স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে এবং তখন থেকে আন্দোলনে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়।’

তিনি বলেন, পরদিন ১৫ জুলাই ২০২৪ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট মর্মে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্যের পর পরই ঢাবি শাখা ছাত্রলীগসহ বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হামলায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী গুরুতর আহত হয়। তাদের মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ছিল। আহত ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেও ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে।

আসিফ বলেন, এই হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই ২০২৪ সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। সেদিন শহীদ মিনারে আন্দোলনরত অবস্থায় আমরা জানতে পারি যে, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পরে জানতে পারি সেদিন চট্টগ্রামের ওয়াসিমসহ সারা দেশে সর্বমোট ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে।

‘১৭ জুলাই ২০২৪ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করি। তখন আর এ আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালনের আগেই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সেখান থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেনসহ দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সংঘর্ষ এড়াতে আমরা ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজা পালন করি। জানাজা শেষে কফিন মিছিল বের করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা ঢাবির হলপাড়ার দিকে আবদ্ধ হয়ে যাই। সেদিন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদসহ শতাধিক আন্দোলনকারী পুলিশের হামলায় আহত হয়। সেদিন ঢাবিসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’

‘এরপর আমরা জাতীয়ভাবে কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেই এবং পরদিন ১৮ জুলাই ২০২৪ সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করি। সেদিন সারা দেশব্যাপী পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলি বর্ষণ করে। সেদিন সারা দেশে কমপক্ষে ২৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার খবর পাই। আন্দোলনের এ পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সঙ্গে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য যোগাযোগ শুরু করে। আমরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। সেদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।’

‘১৯ জুলাই ২০২৪ আমাদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালিত হয়। এই দিন আন্দোলনকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। তাছাড়াও আন্দোলন দমনে আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্বিচারে গুলি করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে সেদিন সারা দেশে শতাধিক নিহত হওয়ার খবর পাই। সেদিন রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোকজন আমাকে মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। ঐ রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। ২৪ জুলাই সকালে আমাকে নিকেতনস্থ সেই স্থানে রেখে যায়। আমাকে তুলে নিয়ে যে রুমে রাখা হয় তা ৫ আগস্ট পরবর্তীকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়না ঘর পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পারি যে এটি সেই জায়গা। ছাড়া পেয়ে আমি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভর্তি হই। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামও একই হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের নজরদারিতে রাখে। আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ২৬ জুলাই ২০২৪ গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমি, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। সেখানে আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনুর রশীদ (ডিবি হারুন) এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারে আমাদের ওপর চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারে জন্য চাপ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আমাদের বারবার বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদের তুলে আনা হয়েছে এবং আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। তারা আরও বলেন যে, তারা দয়া করে আমাদের এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।’

‘ডিবি তাদের লিখিত একটি বক্তব্য জোরপূর্বক আমাদের দিয়ে সই করিয়ে পাঠ করায় এবং সেটি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ডিবি অফিসে বন্দি অবস্থায় আমরা আমরণ অনশন শুরু করি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকার পর আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা জোরপূর্বক গ্রহণ করা হয়েছিল মর্মে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেই এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই।’

‘৩ আগস্ট ২০২৪ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে ১ দফা কর্মসূচি ও অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করি। উক্ত কর্মসূচিতে দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেন। ৪ আগস্ট ২০২৪ সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে শাহবাগে আমাদের সমাবেশ ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় শাহবাগে আমাদের সমাবেশস্থলে পুলিশ গুলি চালায় এবং সেখানে কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা আহত হয় মর্মে খবর পাই। সেদিন বিকালে ৫ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ ও ৬ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন কর্তৃক ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় মর্মে আমরা জানতে পারি। এ কারণে আমি সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ২ ঘণ্টার মধ্যে পরবর্তী কর্মসূচি পরিবর্তন করে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ তারিখের পরিবর্তে ৫ তারিখে পালনের আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করি।’

আসিফ ভূঁইয়া আরও বলেন, ৫ আগস্ট ২০২৪ ভোর থেকে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশ থেকে সাধারণ জনগণ ঢাকা অভিমুখে আসতে শুরু করে। আমি, সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও সমন্বয়ক মোয়াজ্জেম হোসেন চানখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে আসার চেষ্টা করি। তখন আমরা দেখতে পাই যে, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা নাজিম উদ্দিন রোডসহ চানখারপুল এলাকায় অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তখন বেলা আনুমানিক ১১টা বাজে। চানখারপুল এলাকায় সেদিন আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ আন্দোলনকারী অবস্থান করছিলাম। পুলিশের গুলিতে একের পর এক আন্দোলনকারীদের আহত হতে দেখতে পাই। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং শর্টগান ও চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করে। আমার সামনে পুলিশের গুলিতে দুজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। পরবর্তী সময়ে জানতে পারি যে, ঐ দিন চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, ইসমামুল ও ইয়াকুবসহ ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়। যাত্রাবাড়ী থেকে একটি বড় মিছিল আসে। আনুমানিক ২টার দিকে সেখান থেকে পুলিশ চলে যায়। আনুমানিক দেড়টার দিকে আমরা জানতে পারি যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরা মিছিল নিয়ে গণভবনের উদ্দেশে রওনা হই। যাওয়ার পথে আমরা চারদিকে গণভবনগামী জনস্রোত দেখতে পাই। আনুমানিক ৪টার দিকে আমরা সংসদ ভবন এলাকায় যাই।

‘পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারি যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ও গুলিতে প্রায় দেড় সহস্রাধিক ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং ত্রিশ সহস্রাধিক ছাত্রজনতাকে আহত করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকেই তাদের চোখ, হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন। আমি এই হত্যাযজ্ঞের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ যারা কমান্ডিং অথরিটি ছিল তারা এবং যারা সরাসরি গুলি করেছে তাদের দায়ী করছি। আমাদের গুম করে রাখা অবস্থায় বার বার ডিবি কর্মকর্তারা বলছিল যে, তারা শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের গুম করেছে, আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং আমাদের এ ভিডিও বার্তা তাদের দেখানো হবে ও তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বার বার চাপ দেওয়া হয়। সে কারণে আমি মনে করি, আন্দোলন দমনের এ সব কার্যক্রমের জন্য তারা দুজন প্রধানত দায়ী। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনা কর্তৃক আন্দোলনকারীদের ওপর লেথাল উইপন ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যার নির্দেশনার বিষয়ে জানতে পারি। পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও জানতে পারি যে, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ওয়‍্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর জন্য তার অধীনস্থদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’

এ মামলার গ্রেফতার চার আসামি হলেন—শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।

পলাতক আসামিরা হলেন—ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।

গত ১৪ জুলাই চানখারপুলের মামলাটির পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বহু হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।

ওআ/আপ্র/০৯/১০/২০২৫

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

অনেক বছর পর সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ভোট হবে: প্রধান উপদেষ্টা

ট্রাইব্যুনালে উপদেষ্টা আসিফের জবানবন্দি

‘আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দিতে রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়’

আপডেট সময় : ০৭:৪৭:২৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক: অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোক আমার মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। ঐ রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়।

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি জবানবন্দি দেন। বৈষম‍্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাই-আগস্টে রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার জবানবন্দি পেশ করেন।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের ১৯তম সাক্ষী হিসেবে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ২৭ বছর। আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ছিলাম। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। ২০১৮ সালে এই কোটা প্রথা সংস্কারের আন্দোলন ব্যাপক মাত্রায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার চাপে পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটা প্রথা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালের আন্দোলনেও আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি।

‘কোটা বাতিলের ঐ আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়। ২০২৪ সালে ৫ জুন হাইকোর্ট বিভাগ কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করে কোটা প্রথা পুনর্বহাল করে। এই রায়ের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিক্ষোভ মিছিল করি। এরপর কোরবানির ঈদের ছুটি হয়ে যায়। আমরা কোরবানির ঈদের পর ১ জুলাই থেকে পুনরায় আন্দোলন শুরু করি। ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ও জেলা শহর পর্যায়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৪ জুলাই আমরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি পেশ করি। সেদিন সন্ধ্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এর প্রতিবাদে ঐদিন রাতে ঢাবি মেয়েদের হলসহ বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীরা হলের গেটের তালা ভেঙ্গে রাজু ভাস্কর্যের সামনে একত্রিত হয়। সেখানে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরা ‘‘তুমি কে আমি কে-রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে-স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে এবং তখন থেকে আন্দোলনে একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়।’

তিনি বলেন, পরদিন ১৫ জুলাই ২০২৪ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট মর্মে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্যের পর পরই ঢাবি শাখা ছাত্রলীগসহ বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হামলায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী গুরুতর আহত হয়। তাদের মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ছিল। আহত ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেও ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে।

আসিফ বলেন, এই হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই ২০২৪ সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। সেদিন শহীদ মিনারে আন্দোলনরত অবস্থায় আমরা জানতে পারি যে, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পরে জানতে পারি সেদিন চট্টগ্রামের ওয়াসিমসহ সারা দেশে সর্বমোট ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে।

‘১৭ জুলাই ২০২৪ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করি। তখন আর এ আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালনের আগেই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সেখান থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেনসহ দুজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সংঘর্ষ এড়াতে আমরা ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজা পালন করি। জানাজা শেষে কফিন মিছিল বের করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা ঢাবির হলপাড়ার দিকে আবদ্ধ হয়ে যাই। সেদিন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদসহ শতাধিক আন্দোলনকারী পুলিশের হামলায় আহত হয়। সেদিন ঢাবিসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’

‘এরপর আমরা জাতীয়ভাবে কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেই এবং পরদিন ১৮ জুলাই ২০২৪ সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করি। সেদিন সারা দেশব্যাপী পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলি বর্ষণ করে। সেদিন সারা দেশে কমপক্ষে ২৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার খবর পাই। আন্দোলনের এ পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সঙ্গে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য যোগাযোগ শুরু করে। আমরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। সেদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।’

‘১৯ জুলাই ২০২৪ আমাদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালিত হয়। এই দিন আন্দোলনকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। তাছাড়াও আন্দোলন দমনে আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্বিচারে গুলি করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে সেদিন সারা দেশে শতাধিক নিহত হওয়ার খবর পাই। সেদিন রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোকজন আমাকে মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। ঐ রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। ২৪ জুলাই সকালে আমাকে নিকেতনস্থ সেই স্থানে রেখে যায়। আমাকে তুলে নিয়ে যে রুমে রাখা হয় তা ৫ আগস্ট পরবর্তীকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়না ঘর পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পারি যে এটি সেই জায়গা। ছাড়া পেয়ে আমি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভর্তি হই। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামও একই হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের নজরদারিতে রাখে। আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ২৬ জুলাই ২০২৪ গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমি, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। সেখানে আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনুর রশীদ (ডিবি হারুন) এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারে আমাদের ওপর চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারে জন্য চাপ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আমাদের বারবার বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদের তুলে আনা হয়েছে এবং আন্দোলন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। তারা আরও বলেন যে, তারা দয়া করে আমাদের এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে।’

‘ডিবি তাদের লিখিত একটি বক্তব্য জোরপূর্বক আমাদের দিয়ে সই করিয়ে পাঠ করায় এবং সেটি মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়। ডিবি অফিসে বন্দি অবস্থায় আমরা আমরণ অনশন শুরু করি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকার পর আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা জোরপূর্বক গ্রহণ করা হয়েছিল মর্মে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেই এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই।’

‘৩ আগস্ট ২০২৪ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে ১ দফা কর্মসূচি ও অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করি। উক্ত কর্মসূচিতে দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করেন। ৪ আগস্ট ২০২৪ সারা দেশে অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি পালিত হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে শাহবাগে আমাদের সমাবেশ ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় শাহবাগে আমাদের সমাবেশস্থলে পুলিশ গুলি চালায় এবং সেখানে কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয় এবং অসংখ্য আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা আহত হয় মর্মে খবর পাই। সেদিন বিকালে ৫ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ ও ৬ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ কর্মসূচি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠন কর্তৃক ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় মর্মে আমরা জানতে পারি। এ কারণে আমি সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ২ ঘণ্টার মধ্যে পরবর্তী কর্মসূচি পরিবর্তন করে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ তারিখের পরিবর্তে ৫ তারিখে পালনের আহ্বান জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করি।’

আসিফ ভূঁইয়া আরও বলেন, ৫ আগস্ট ২০২৪ ভোর থেকে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশ থেকে সাধারণ জনগণ ঢাকা অভিমুখে আসতে শুরু করে। আমি, সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও সমন্বয়ক মোয়াজ্জেম হোসেন চানখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে আসার চেষ্টা করি। তখন আমরা দেখতে পাই যে, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা নাজিম উদ্দিন রোডসহ চানখারপুল এলাকায় অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তখন বেলা আনুমানিক ১১টা বাজে। চানখারপুল এলাকায় সেদিন আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ আন্দোলনকারী অবস্থান করছিলাম। পুলিশের গুলিতে একের পর এক আন্দোলনকারীদের আহত হতে দেখতে পাই। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং শর্টগান ও চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করে। আমার সামনে পুলিশের গুলিতে দুজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। পরবর্তী সময়ে জানতে পারি যে, ঐ দিন চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, ইসমামুল ও ইয়াকুবসহ ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়। যাত্রাবাড়ী থেকে একটি বড় মিছিল আসে। আনুমানিক ২টার দিকে সেখান থেকে পুলিশ চলে যায়। আনুমানিক দেড়টার দিকে আমরা জানতে পারি যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরা মিছিল নিয়ে গণভবনের উদ্দেশে রওনা হই। যাওয়ার পথে আমরা চারদিকে গণভবনগামী জনস্রোত দেখতে পাই। আনুমানিক ৪টার দিকে আমরা সংসদ ভবন এলাকায় যাই।

‘পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারি যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলায় ও গুলিতে প্রায় দেড় সহস্রাধিক ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং ত্রিশ সহস্রাধিক ছাত্রজনতাকে আহত করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকেই তাদের চোখ, হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন। আমি এই হত্যাযজ্ঞের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ যারা কমান্ডিং অথরিটি ছিল তারা এবং যারা সরাসরি গুলি করেছে তাদের দায়ী করছি। আমাদের গুম করে রাখা অবস্থায় বার বার ডিবি কর্মকর্তারা বলছিল যে, তারা শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমাদের গুম করেছে, আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং আমাদের এ ভিডিও বার্তা তাদের দেখানো হবে ও তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বার বার চাপ দেওয়া হয়। সে কারণে আমি মনে করি, আন্দোলন দমনের এ সব কার্যক্রমের জন্য তারা দুজন প্রধানত দায়ী। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনা কর্তৃক আন্দোলনকারীদের ওপর লেথাল উইপন ও হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যার নির্দেশনার বিষয়ে জানতে পারি। পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও জানতে পারি যে, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ওয়‍্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর জন্য তার অধীনস্থদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’

এ মামলার গ্রেফতার চার আসামি হলেন—শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।

পলাতক আসামিরা হলেন—ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।

গত ১৪ জুলাই চানখারপুলের মামলাটির পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখারপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে বহু হতাহতের ঘটনার পাশাপাশি শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।

ওআ/আপ্র/০৯/১০/২০২৫