সৈয়দ ইফতেখার : একদিকে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-টুয়েন্টি সিক্স চলছিল, যাতে অংশ নেন অন্য সব দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যদিকে দেশে একের পর এক মরতে থাকে হাতি। কাটা হয় গাছও। যার রেশ এখনও চলমান। নভেম্বর মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্য হাতির অপমৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু। আর গাছ কাটার সংখ্যটা অগণিত। যা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। বন, প্রকৃতি, জলবায়ু রক্ষার জন্য যখন সারা বিশ্বের নেতারা পথ খুঁজছেন তখন বাংলাদেশ ও এখানকার মানুষজন হাঁটছে উল্টো পথে! অথচ এই বাংলাদেশই কিনা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে!
আদতে এতো কিছুর পরও আমাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা আসছে না। দিন যত যাচ্ছে আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। হচ্ছি বিকৃত মানসিকতার এক একজন ব্যক্তি। কী বড়, কী ছোট। সবার মধ্যেই একই প্রবণতা! কে কাকে টেক্কা দেবে, কে কত বিত্তশালী হবে, কে ক্ষমতা নেবে, আরও কত কী! একবারও ভাবছি না- অন্যের কথা, পাশে থাকা মানুষটির কথা, অসহায়ের কথা। সেখানে পরিবেশ প্রতিবেশ তো দূরের প্রসঙ্গ ঢের। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার পেছনে লোভ কাজ করছে। ইদানীং ধর্মও ব্যাপকহারে ব্যবহার হচ্ছে লোভের অংশ হিসেবে। সব মিলিয়ে জল কিন্তু বহুদূর গড়িয়ে যাচ্ছে।
প্রাণ-পরিবেশ ধ্বংসের লীলা খেলার এ গতি অব্যাহত থাকলে তেমন দিন দেখতে আর বছর দশেকও লাগবে না। শুধু হাতি কেন সুন্দরবনে বাঘ হত্যাও থেমে নেই। সব মিলিয়ে আগামীতে শুধুই মানুষে মানুষে গিজগিজ করবে দেশ। থাকবে না কোনো প্রাণী আর! সে বন্দোবস্তই চলমান
উন্নতদেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে ঠিকই কিন্তু আমরাও কি কম যাচ্ছি? গাছ কেটে সাবাড় করছি একের পর এক অঞ্চল। গেলো এক, দুই মাসে আগারগাঁও এলাকায় যত গাছ কাটা হয়েছে তার ক্ষতি কি করে পুষিয়ে নেবো আমরা! অন্যদিকে মেট্রোরেলের জন্য গেলো কয়েক বছরে গাছ কাটা না হয় বাদই দিলাম। পুরো ঢাকা হয়ে পড়েছে দূষণের নগরী। ধুলাবালিতে ভরপুর রাজধানীর প্রতিটি অলিগলি ও সেখানকার বাতাস। কী লাভ হচ্ছে কৃত্রিম উন্নয়েনর পেছনে অর্থ ঢেলে সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে! ঢাকাই শুধু নয়, ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যাচ্ছে পুরো বাংলাদেশ। আমাদের কমছে সহ্য ক্ষমতাও, পরিবেশ তার শোধ ঠিকই কড়ায় গ-ায় মিটিয়ে নিচ্ছে, মিটিয়ে নেবে। নতুন প্রজন্মের জন্য বিষাক্ত এক মাটি, পানি, বায়ু তৈরি করছি আমরা।
আবারও ফিরি হাতির মৃত্যু প্রসঙ্গে। কক্সবাজারে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য, তাদের ক্যাম্পের কারণে হাতির আবাস নষ্ট হয়েছে। আজ হাতি বিপন্ন হয়ে উঠেছে। শুধু হাতি নয় অনান্য প্রাণীরাও। ২০১৬ সালের এক সমীক্ষা মতে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতির চলাচলের ১১টি করিডর ছিল। এর বেশির ভাগ কার্যত বন্ধ। শেরপুর, জামালপুর-ময়মনসিংহেরও একই অবস্থা, সেখানে ফসল রক্ষায় মারা পড়ছে হাতি। আবাসস্থল ধ্বংস ও মানুষের সঙ্গে সংঘাত বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে একের পর এক হাতির মৃত্যু সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে সংবাদের। এতে দেশে প্রাণীটির অস্তিত্ব নিয়েই বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের তথ্য বলছে, ২০০৪ সালের জরিপে চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতির সংখ্যা ছিল ২২৭টি। এখন গোটা দেশেই হাতি মাত্র ৩০০টি অবশিষ্ট। ভারত থেকে মাঝে মধ্যে আসা হাতিসহ দেশে হাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০’র মতো। সংস্থাটির সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, শেরপুরের বনাঞ্চলে বিচরণকারী হাতির সংখ্যা মাত্র ১২০ থেকে ১২৫টি। দেশে গত ২৫ বছরে হত্যার শিকার হয়েছে ১৫০টির বেশি হাতি। কিন্তু নেই কোনো বিচার নেই কোনো কৈফিয়ৎ।
হাতির জন্য কৃষকের ফসলের কোনো ক্ষতি হলে সরকার দ্বিগুণ মূল্য পরিশোধ করে, এটাই রয়েছে আইনে। কিন্তু মানুষ যেমন অস্থির প্রকৃতির তেমনি প্রশাসনও উদাস। এতে আইন থেকে যাচ্ছে কাগজে কলমে, মাঝখান থেকে প্রাণ হারাচ্ছে হাতি। এ প্রাণীটি হত্যায় যে কয়টি মামলা হয়েছে তা ঝুলে আছে। এটি যে গুরুত্ব দেয়ার বিষয় তাই মনে করেন না কেউ! হাতি জনপদে নেমে এলে আগে পটকা ফুটিয়ে, মশাল জ্বেলে বা টিন পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হতো, কিন্তু কয়েক বছর ধরে বৈদ্যুতিক ফাঁদের প্রবণতা বেড়েছে। না বুঝে বিদ্যুতায়িত বেড়ার সংস্পর্শে এসে মারা পড়ছে বিশাল আকারের এক একটি হাতি। এমনকি শিশুদেরও রক্ষা করা হচ্ছে না।
কদিন আগে কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার এক মাছের ঘেরের পাশে বাচ্চা হাতিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আগের রাতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তার করুণ মৃত্যু হয়েছে বলে ময়নাতদন্তকারী কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। লোহার বল্লম গরম করে হাতির শরীরে ছুড়ে মারা হচ্ছে প্রায়শই। চোরাশিকারিরা দাঁতসহ দেহাংশের লোভেও প্রাণীটিকে হত্যা করছে। হত্যাসহ অস্বাভাবিক মৃত্যু অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বনাঞ্চল থেকে এশীয় প্রজাতির হাতি বিলীন হওয়ারই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ এ প্রজাতিটি ১৯৮৬ সাল থেকেই লাল তালিকায় রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন হাতি শুধু দেখা যাবে চিড়িয়াখানায়। প্রাণ-পরিবেশ ধ্বংসের লীলা খেলার এ গতি অব্যাহত থাকলে তেমন দিন দেখতে আর বছর দশেকও লাগবে না। শুধু হাতি কেন সুন্দরবনে বাঘ হত্যাও থেমে নেই। সব মিলিয়ে আগামীতে শুধুই মানুষে মানুষে গিজগিজ করবে দেশ। থাকবে না কোনো প্রাণী আর! সে বন্দোবস্তই চলমান।