নারী ও শিশু ডেস্ক: মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় কামরুন্নাহার লিপির। পরে শিকার হন পারিবারিক নির্যাতনের। একপর্যায়ে দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী সেই লিপি এখন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা।
বিচ্ছেদ হওয়ার পর ধার করা একটি সেলাই মেশিন দিয়ে দর্জির কাজ শুরু করেন লিপি। দর্জির কাজ করতে করতেই তিনি এখন দু-দুটি ছোট পোশাক কারখানার মালিক।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামে বসবাস কামরুন্নাহার লিপির। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘নারীনেত্র কারুপণ্য’। তার কারখানা দুটির অবস্থান নেত্রকোনা সদরের অনন্তপুর ও ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায়। যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ভারত, দুবাই, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরবরাহ হচ্ছে তার কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য।
অনন্তপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক আলী উসমানের মেয়ে কামরুন্নাহার লিপি। যখন উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষে পড়েন, তখন তার বয়স মাত্র সাড়ে ১৬ বছর। ওই বয়সেই মা-বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু তখন সংসার পরিচালনার মতো অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুই ছিল না তার। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হয় তার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এক সময় সংসার ছাড়তে বাধ্য হন। তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে। এ কারণে আর দশটা নারীর মতো তাকেও শিকার হতে হয় নানা রকম অবজ্ঞা-অবহেলার। শুনতে হয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের কটূ কথা। আর এমন পরিস্থিতির মধ্যেই খুঁজতে থাকেন ঘুরে দাঁড়ানোর পথ।
জীবনযুদ্ধ: মা-বাবার বোঝা না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে কামরুন্নাহার লিপিকে। ২০০২ সালে তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু পুঁজি না থাকায় কোনো কাজ করতে পারছিলেন না। এরপর একদিন মা-বাবার বাধা উপেক্ষা করেই ঢাকায় গিয়ে পোশাক কারখানায় কাজ নেন। কিন্তু থাকতে দেননি ভাইয়রা। ১৭ দিন কাজ করার পর লোকলজ্জার কথা বলে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তখন শুরু করেন টিউশনি করা। পরে চাকরি নেন স্থানীয় একটি এনজিওতে। তাতে প্রথম চার-পাঁচ মাস কাজ করার পর বেতন পান মাত্র ৬০০ টাকা। এক সময় তিন হাজার টাকা বেতন হয় তার। ওই টাকায় কিছু চুমকি ও পুঁতি কিনে আনেন। এরপর শাড়ি ও থ্রিপিসে চুমকি-পুঁতি লাগাতে শুরু করেন। কাজ করা কাপড়গুলো ঢাকায় নিয়ে বেচতে হতো। এত কিছু করেও একটি সেলাই মেশিন কেনার মতো টাকা জোগাড় করতে পারছিলেন না লিপি।
দর্জির কাজ: একদিন লিপির সহকর্মী (বর্তমানে তার স্বামী) সোহেল একজনের কাছ থেকে ধার করে এনে একটি সেলাই মেশিন দেন। দর্জির দোকান থেকে পরিত্যক্ত টুকরো কাপড় কিনে এনে বানাতে শুরু করেন শিশুদের পোশাক। সেগুলো ফুটপাতের দোকানিদের কাছে পাইকারি দামে বেচতেন। ওই কাজ করতে গিয়ে চকপাড়া এলাকার মোল্লা মিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিও শিশুদের পোশাক বানাতেন। তিনি প্রতিদিন ১০০ পিস ইজার প্যান্ট সেলাইয়ের কাজ দেন। প্রতিটি প্যান্ট সেলাইয়ের মজুরি হিসেবে লিপি পেতেন মাত্র দুই টাকা। তা সঞ্চয় করে কিনে আনেন দুটি সেলাই মেশিন। পরে রেজিয়া, মুনমুন ও রুবি কে যুক্ত করেন সেলাইয়ের কাজে। লিপি নিজেই তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ২৯টি আইটেম বানানো শেখান। এরপর মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে ঢাকার কেরানিগঞ্জ থেকে কিনে আনেন ১০ কেজি টুকরো কাপড়। নিজেই শিশুদের ইজার প্যান্ট বানিয়ে পাইকারি বেচতে শুরু করেন। প্রথম দফায় বিক্রি হয় ২ হাজার ৫০০ টাকার পোশাক। ওই টাকার কাপড় কিনে এনে পাঁচ হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করেন। এভাবে দিনদিন পুঁজি বাড়াতে থাকেন তিনি।
ভাগ্যের চাকা ঘোরা: ২০০৯ সালে সরকার পলিথিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে বাজারে হঠাৎ করেই টিস্যুব্যাগের (শপিং ব্যাগ) চাহিদা দেখা দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না লিপির। একদিন বাজার থেকে একটি শপিং ব্যাগ কিনে এনে সেলাই খুলে কাটিং ও বানানোর কৌশল রপ্ত করেন। শেখেন স্ক্রিন প্রিন্টের কাজও। পরে ঢাকা থেকে কিছু টিস্যু কাপড় কিনে এনে শুরু করেন শপিং ব্যাগ তৈরির কাজ। প্রথমদিকে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করতেন। ওইসময় একদিন সৌদি আরবের এক প্রবাসী তাকে ২০ হাজার শপিং ব্যাগের অর্ডার দেন। কিন্তু বাঁধ সাধে পুঁজির সংকট। বাবার জমি বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা জোগাড় করেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ নেন ৩০ হাজার টাকা। তাতেও না হওয়ায় ছুটে যান একটি প্রাইভেট ব্যাংকে। সেখান থেকে ঋণ নেন আরো ৫০ হাজার। এভাবে জোগাড় করা টাকায় অর্ডার সরবরাহ করে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা লাভ পান। ওই টাকায় কিছু ঋণ শোধের পাশাপাশি আড়াই শতক জায়গা কিনে একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে স্থাপন করেন কারখানা।
২০১২-২০১৩ সালের দিকে নেত্রকোনা ছাড়াও ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শপিং ব্যাগ সরবরাহ করতে শুরু করেন লিপি। বেশকিছু বড় কোম্পানি টিনশেড কারখানা দেখে ব্যাগের অর্ডার দিতে রাজি হননি। তাই তিনি দেখতে শুরু করেন একটি ভবন নির্মাণের স্বপ্ন। কিছুদিন বাদে লাভের টাকা জমিয়ে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে তার বাবার কাছ থেকে কারখানার জন্য কিনে নেন ১২ শতক জমি।
দর্জি থেকে গার্মেন্ট কারখানার মালিক: ২০১৪ সালের দিকে এসে কামরুন্নাহার লিপির হাতে একটা ছোটখাটো তহবিল দাঁড়িয়ে যায়। তাই সাত শতক জমির ওপর ৩২ লাখ টাকায় একটি ভবন নির্মাণ করেন কারখানার জন্য। এ কারখানায় শুরু করেন জিন্স প্যান্ট, টিশার্ট ও ট্রাউজার তৈরির কাজ। নেত্রকোনার বাড়ির কারখানায় শুধু স্যুইংয়ের কাজ করান আর ফিনিশিং করান ঢাকার কুড়িল এলাকায়। এ জন্য কুড়িলে ফিনিশিং সেন্টারও স্থাপন করেছেন। তিনিই ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
কামরুন্নাহার লিপি জানান, তার কারখানায় এখন শপিংব্যাগ, চটের ব্যাগ, জিন্স প্যান্ট, টিশার্ট, ট্রাউজার, মাস্ক ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের পণ্য তৈরি হয়। দেশে ছাড়াও যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ভারত, দুবাই, ইতালিসহ আরো কয়েকটি দেশে সরবরাহ হয় তার উৎপাদিত পণ্য। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে ৪-৫ কোটি টাকার লেনদেন হয় তার। ৭০-৮০ লাখ টাকার পণ্য সব সময় তার মজুত থাকে। এর বাইরেও বেশকিছু সম্পদ করেছেন তিনি। আরো ৭৭ শতক জমি কিনেছেন। ৩১ শতক জমিতে পুকুর দিয়ে করছেন মাছ চাষ। তার কারখানায় আছে ৫০টি সেলাই মেশিন ছাড়াও গার্মেন্ট কাজের অসংখ্য যন্ত্রপাতি।
কাজ পান অসহায়-নির্যাতিত-বঞ্চিতরা: লিপির কারখানায় এখন ৮৫ শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে আছেন ৬৩ নারী। তাদের মধ্যে অনেকে প্রতিবন্ধী, তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা, অসহায়, নির্যাতিনের শিকার বা দরিদ্রতার কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থী। পিছিয়ে পড়া পরিবারের এসব নারী তার সান্নিধ্যে এসে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। আবার তার সহযোগিতা নিয়ে কেউ কেউ লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছেন।
কামরুন্নাহার লিপি বলেন, ‘লেখাপড়ার প্রয়োজনে কারো যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়, তাহলে তাদের ওই সুযোগ দিই; এমনকি কারো টাকার অভাব থাকলে সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। আমি চাই- যার সুযোগ আছে, সে লেখাপড়া করুক; আর যাদের লেখাপড়ার সুযোগ নেই, তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হোক।’
লিপি কঠিন জীবনযুদ্ধেও চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। এরই মধ্যে এলএলবি পাস করেছেন। দু’জায়গায় কারখানা স্থাপনের পর তিনি অনুভব করেন বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী প্রয়োজন। তাই প্রথম জীবনে যে বন্ধু সেলাই মেশিন দিয়েছিলেন, তাকেই বিয়ে করেন তিনি। তার স্বপ্ন আন্তর্জাতিক মানের একটি কমপ্লেক্স ফ্যাক্টরি তৈরি করা, যেখানে শ্রমিকদের জন্য উন্নতমানের ক্যান্টিন, ডে কেয়ার সেন্টার, পর্যাপ্ত লাইটিং, বিশ্রামাগার, বিনোদন কেন্দ্র, নারী-পুরুষের আলাদা টয়লেট, গ্যাস সংযোগ প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধা থাকবে। নেত্রকোনার বিসিক শিল্প নগরীতেও একটি কারখানা স্থাপনে আবেদনও করে রেখেছেন।
২০১৪ সালে অর্থনৈতিক ক্যাটাগরিতে ‘দেশসেরা জয়িতা পুরস্কার’ পান লিপি। এর আগে তিনি ঢাকা বিভাগেও শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পান। ২০২০ সালে অর্জন করেন কলকাতা-বাংলাদেশ মৈত্রী পুরস্কার। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় প্রবর্তিত ‘ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয় তাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে স্থানীয়ভাবে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন আত্মপ্রত্যয়ী এই নারী।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ


























