প্রত্যাশা ডেস্ক: রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকটের যদি মীমাংসা না হয়, তাহলে সমগ্র অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।
শুক্রবার ব্যাংককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন বলে বাসস জানিয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে স্থায়ী প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারের আরো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইন রাজ্যে আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে ইউএনডিপি’র সতর্কবার্তার মধ্যে, রাখাইন থেকে আরো বাস্তুচ্যুতি বন্ধ করার জন্য জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাখাইনে একটি মানবিক চ্যানেল স্থাপন করা যেতে পারে। সরকারপ্রধান বলেন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিশেষ করে রাখাইনের বিরোধপূর্ণ পক্ষগুলোর মধ্যে সমাধানের জন্য বিমসটেক সংলাপ চালাতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠেয় ‘রোহিঙ্গা মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে’ বিমসটেক সদস্য দেশগুলোর অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে। থাই প্রধানমন্ত্রী ও সম্মেলনের চেয়ারপারসন পায়োংতার্ন সিনাওয়াত্রা, বিমসটেকের মহাসচিব রাষ্ট্রদূত ইন্দ্রা মণি পান্ডে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বিমসটেকের জন্য ৪ প্রস্তাব: এদিকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনে বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশনের (বিমসটেক) জন্য চারটি প্রস্তাব রেখেছেন। যুবসমাজের শক্তিকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশি তরুণরা সামনে থেকে এতটা ইচ্ছা এবং কর্মপ্রচেষ্টা দেখাচ্ছে; এমনকি শাসনব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী কিছু ধারণা সংস্কার করার জন্যও প্রস্তাব করেছে।
অধ্যাপক ইউনূস কৃষিকাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশেষ করে এই অঞ্চলের বিশাল ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে সংযোগ স্থাপনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং এ সম্পর্কিত ‘ফোর আইআর’কে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছেন। সরকার প্রধান বিমসটেক দেশগুলোকে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ নিতে সম্পদ তৈরি, উদ্ভাবন এবং তা উন্মুক্ত করার সুপারিশ করেছেন। তিনি এমন একটি ইকো-সিস্টেম প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব করেছেন যেখানে সরকার ছাড়াও অন্যান্য সংস্থাগুলো জনস্বাস্থ্য বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জলবায়ু অভিযোজন- জরুরি অবস্থা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিমসটেকের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সময় আমাদের পক্ষে নেই। আমাদের কেবল পরিবর্তন আনতে হবে না, রূপান্তর করতে হবে। এজন্যই বাংলাদেশ তিনটি শূন্যের বিশ্বকে এগিয়ে নিতে চায়: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন।
দুর্নীতি প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড এমওইউ: দুর্নীতি দমনে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্য নিয়ে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড।
শুক্রবার ব্যাংককে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও থাইল্যান্ডের জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশন (এনএসিসি) এই সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানিয়েছে।
অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এবং এনএসিসি প্রেসিডেন্ট সুচার্ট ট্রাকুলকাসেমসু নিজ নিজ সংস্থার পক্ষে এই চুক্তিতে সই করেন। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত ছিলেন। এই সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো ‘কার্যকরভাবে একসঙ্গে কাজ করতে’ পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন দুদক চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক দুর্নীতির সন্দেহভাজন ব্যক্তি প্রতিবেশী কিছু দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই চুক্তি তাদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনতে সহায়ক হবে। এই চুক্তির আওতায়, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড একে অপরকে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহ করবে। এছাড়া দুর্নীতি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে তথ্য সংগ্রহে অভিজ্ঞতা ও সর্বোত্তম পদ্ধতি বিনিময়, যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ, গবেষণা ও তথ্য বিনিময়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা করবে। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের ৪৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এই চুক্তি দুই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সরাসরি সহযোগিতা নিশ্চিত করবে।
আসিয়ান সদস্যপদের জন্য থাইল্যান্ডের সমর্থন চাইলেন ইউনূস: এক প্রতিবেদনে বাসস জানিয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক জোট-আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগদানের ঢাকার প্রতি সমর্থন জানাতে থাইল্যান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দেশটির সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে বলেন, আসিয়ানের খাতভিত্তিক সংলাপ অংশীদার হিসেবে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের, তবে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল এই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক গোষ্ঠীর পূর্ণ সদস্য হওয়া।
শুক্রবার ব্যাংককের একটি হোটেলে এক প্রাতঃরাশ বৈঠকে ইউনূস এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এই পথেই আমাদের ভবিষ্যৎ।বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে এবং সার্ক ও বিমসটেকের গর্বিত সদস্য। এ সময় আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারে আরো বেশি উদ্যোগ নেওয়ায় তাগিদ দেন ইউনূস। ওই বৈঠকে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎ ভেজ্জাজীবা, সাবেক এক উপ প্রধানমন্ত্রী, শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংকার, শিক্ষাবিদ এবং নাগরিক সমাজের নেতারাও অংশ নেন।
ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ আশা করছে আসিয়ানের সদস্যপদ অর্জনে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানের শীর্ষ দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া যাবে। তিনি থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে আরো বৃহত্তর সহযোগিতার ওপর জোর দেন।
ইউনূস বলেন, উভয় দেশ একইরকম ইতিহাস ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। আমরা যে ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই, এই বৈঠকের মাধ্যমে তার সূচনা হল।
প্রধান উপদেষ্টা সাম্প্রতিক বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, বিশ্ব এই ‘বিশৃঙ্খল অবস্থা’কে তার সুবিধায় রূপান্তর করতে পারে। সরকার প্রধান বলেন, বিশৃঙ্খলা অনেক কিছুকে নাড়িয়ে দিতে পারে। আমাদের আরো সহযোগিতা দরকার। আমরা একটি নতুন ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে ভাবতে পারি কী না সে বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ওই বৈঠকে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা গণঅভ্যুত্থানের কথা তুলে ধরে বলেন, এই অভ্যুত্থান একজন নিষ্ঠুর স্বৈরশাসককে উৎখাত করে দেশে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে।
বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মূখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।