ঢাকা ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আজ আপনি সংখ্যালঘু নন তবে কাল কী হবে?

  • আপডেট সময় : ০৯:১১:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১
  • ১১১ বার পড়া হয়েছে

ডা. বিএম আতিকুজ্জামান : অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে উগ্রপন্থী হিন্দুরা, মুসলমানদের বাড়ি ঘর আক্রমণ করছে। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র। আমার মনে আছে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের পাশেই ছিল বিখ্যাত চট্টেশ্বরী মন্দির। আমাদের মেডিক্যাল কলেজে সব প্রগতিশীল ছাত্র মিলে সেদিন মন্দির পাহারা দিয়েছিলাম।
শুধু সে মন্দিরই নয়, আরও অনেক মন্দির সেদিন রক্ষা করেছিল সাধারণ জনতা। পাশাপাশি কোথাও কোথাও মন্দির আক্রমণের হাত থেকে রেহায় পায়নি। অনেক হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর-স্থাপনা আক্রমণ হয়েছিল। এমনকি মেডিক্যাল কলেজের পাশ দিয়ে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানার নিয়ে একদল মানুষ যখন চট্টেশ্বর মন্দিরের দিকে আসছিল, আমরা তখন দলবেঁধে তাদের ধাওয়া করেছিলাম। সেসময়ও একদল মানুষ দেখেছিলাম যারা প্রতিক্রিয়াশীল।
আমরা যদি এর বিরুদ্ধে জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ না হই এবং আইনের শাসন না করতে পারি তবে আমাদের জন্য আরো বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছে। আমাদের সাবধানী নীরবতা আমাদের কাউকেই ছাড়বে না। যে কোনো ইস্যুতে আমরা যে কেউ হয়ে যাবো সংখ্যালঘু, আর রক্ষা পাবো না কেউ
দুই.
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে জাম্বিয়ার একটি নাম না জানা ছোট শহরে জাতিগত দাঙ্গা বেঁধে গেলো। কালো জাম্বিয়ানদের সাথে সংখ্যালঘু ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের। আমি তখন সে শহরের হাসপাতালের একমাত্র ডাক্তার। হঠাৎ করে কারা যেন রটিয়ে দিলো যে ভারতীয়রা জ্যান্ত জাম্বিয়ানদের ধরে ধরে তাদের কলিজা ছিড়ে খায়। গোটা বিশেক ধনী ভারতীয় পরিবারের ওপর নেমে এলো অসহনীয় অত্যাচার। আমাকেও দেখতে ভারতীয়দের মতোই লাগে। ডাক্তার হওয়ার কারণে আমার বাড়িতে কেউ আক্রমণ করেনি। তবে আমি হাসপাতালে আমার রুমেই কাটাচ্ছিলাম পুরো তিনটে দিন। হাসপাতালের নার্স আর কর্মকর্তারা আমাকে আগলে রেখেছিলেন। অবশেষে সেনাবাহিনী এলো। পরিস্থিতির উন্নতি হলো।
পুরো দাঙ্গা তো ছিল একটি হীনমন্য প্লট। অবস্থাপন্ন ভারতীয় অধিবাসীদের সম্পদ লুট করাই ছিল একটি ছোট অংশের লক্ষ্য। তারা সক্ষম হয়েছিল মাজাবুকার অধিকাংশ মানুষকে বোকা বানাতে।
তিন.
আমি তখন মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। দুটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে গেলো। একটি দলের ছাত্ররা রণেভঙ্গ দিয়ে ছাত্রাবাস থেকে পালানোর পর শুরু হলো লঙ্কাকা-। খুঁজে খুঁজে অন্য দলের ছাত্রদের রুমে আগুন দেওয়া হলো, কয়েকজনকে দেখলাম রুমগুলো লুটপাট শুরু করতে। আমি দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। সেদিন যারা আগুন লাগিয়েছিল কিংবা লুটপাট করেছিল তারা কিন্তু বড় নেতা ছিল না। তাদের অধিকাংশই ছিল সুযোগসন্ধানী ও অ্যানার্কিস্ট।
চার.
২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। আমি তখন নিউইয়র্কে আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং করছি। চোখের সামনে টুইন টাওয়ারকে গুঁড়িয়ে দিলো সন্ত্রাসীরা। হাজারের ওপর মানুষ নিহত হলো নিমিষেই। তার পরদিন জরুরি বিভাগে কাজ করবার সময় একটি ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম।
পঞ্চাশ বছর বয়সের এক দাড়িওয়ালা শিখকে মুসলমান সন্ত্রাসী ভেবে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে জরুরি বিভাগে নিয়ে এসেছিলো একদল মানুষ। চোখের সামনে মারা গেলো সেই নিরীহ মানুষটি। একটি ছোট মুদিখানার মালিক এই শিখ লোকটিকে একদল মানুষ মেরেছিল আর একদল মানুষ তার দোকানটি লুটপাট করেছিল। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসছি সংখ্যালঘু মুসলমাদের ওপর অত্যাচার।
এই কোভিড অতিমারিতে দেখছি সংখ্যালঘু এশিয়ানদের ওপর অনাচার-অত্যাচার। সবগুলো ঘটনার পেছনে, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের একটা প্যাটার্ন আছে। অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে। অনেক সময় থাকে একদ লোভী বর্বর সুযোগসন্ধানী মানুষের লালসা।
এবারের বাংলাদেশের দুর্গাপূজার সময় যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটলো এটি তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। সারা বিশ্বজুড়ে চলছে এখন সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার। অতিমারির এ যুগে ফ্যাসিস্টদের বৈশ্বিক বিস্তার অকল্পনীয়। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা যদি এর বিরুদ্ধে জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ না হই এবং আইনের শাসন না করতে পারি তবে আমাদের জন্য আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। আমাদের সাবধানী নীরবতা আমাদের কাউকেই ছাড়বে না। যে কোনো ইস্যুতে আমরা যে কেউ হয়ে যাবো সংখ্যালঘু, আর রক্ষা পাবো না কেউ।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ইসলাম কায়েমের মাধ্যমে ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মুহাম্মদ (সা.)

আজ আপনি সংখ্যালঘু নন তবে কাল কী হবে?

আপডেট সময় : ০৯:১১:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর ২০২১

ডা. বিএম আতিকুজ্জামান : অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে উগ্রপন্থী হিন্দুরা, মুসলমানদের বাড়ি ঘর আক্রমণ করছে। আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শেষবর্ষের ছাত্র। আমার মনে আছে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসের পাশেই ছিল বিখ্যাত চট্টেশ্বরী মন্দির। আমাদের মেডিক্যাল কলেজে সব প্রগতিশীল ছাত্র মিলে সেদিন মন্দির পাহারা দিয়েছিলাম।
শুধু সে মন্দিরই নয়, আরও অনেক মন্দির সেদিন রক্ষা করেছিল সাধারণ জনতা। পাশাপাশি কোথাও কোথাও মন্দির আক্রমণের হাত থেকে রেহায় পায়নি। অনেক হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর-স্থাপনা আক্রমণ হয়েছিল। এমনকি মেডিক্যাল কলেজের পাশ দিয়ে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানার নিয়ে একদল মানুষ যখন চট্টেশ্বর মন্দিরের দিকে আসছিল, আমরা তখন দলবেঁধে তাদের ধাওয়া করেছিলাম। সেসময়ও একদল মানুষ দেখেছিলাম যারা প্রতিক্রিয়াশীল।
আমরা যদি এর বিরুদ্ধে জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ না হই এবং আইনের শাসন না করতে পারি তবে আমাদের জন্য আরো বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছে। আমাদের সাবধানী নীরবতা আমাদের কাউকেই ছাড়বে না। যে কোনো ইস্যুতে আমরা যে কেউ হয়ে যাবো সংখ্যালঘু, আর রক্ষা পাবো না কেউ
দুই.
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারির দিকে জাম্বিয়ার একটি নাম না জানা ছোট শহরে জাতিগত দাঙ্গা বেঁধে গেলো। কালো জাম্বিয়ানদের সাথে সংখ্যালঘু ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষদের। আমি তখন সে শহরের হাসপাতালের একমাত্র ডাক্তার। হঠাৎ করে কারা যেন রটিয়ে দিলো যে ভারতীয়রা জ্যান্ত জাম্বিয়ানদের ধরে ধরে তাদের কলিজা ছিড়ে খায়। গোটা বিশেক ধনী ভারতীয় পরিবারের ওপর নেমে এলো অসহনীয় অত্যাচার। আমাকেও দেখতে ভারতীয়দের মতোই লাগে। ডাক্তার হওয়ার কারণে আমার বাড়িতে কেউ আক্রমণ করেনি। তবে আমি হাসপাতালে আমার রুমেই কাটাচ্ছিলাম পুরো তিনটে দিন। হাসপাতালের নার্স আর কর্মকর্তারা আমাকে আগলে রেখেছিলেন। অবশেষে সেনাবাহিনী এলো। পরিস্থিতির উন্নতি হলো।
পুরো দাঙ্গা তো ছিল একটি হীনমন্য প্লট। অবস্থাপন্ন ভারতীয় অধিবাসীদের সম্পদ লুট করাই ছিল একটি ছোট অংশের লক্ষ্য। তারা সক্ষম হয়েছিল মাজাবুকার অধিকাংশ মানুষকে বোকা বানাতে।
তিন.
আমি তখন মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। দুটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে গেলো। একটি দলের ছাত্ররা রণেভঙ্গ দিয়ে ছাত্রাবাস থেকে পালানোর পর শুরু হলো লঙ্কাকা-। খুঁজে খুঁজে অন্য দলের ছাত্রদের রুমে আগুন দেওয়া হলো, কয়েকজনকে দেখলাম রুমগুলো লুটপাট শুরু করতে। আমি দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। সেদিন যারা আগুন লাগিয়েছিল কিংবা লুটপাট করেছিল তারা কিন্তু বড় নেতা ছিল না। তাদের অধিকাংশই ছিল সুযোগসন্ধানী ও অ্যানার্কিস্ট।
চার.
২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। আমি তখন নিউইয়র্কে আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন ট্রেনিং করছি। চোখের সামনে টুইন টাওয়ারকে গুঁড়িয়ে দিলো সন্ত্রাসীরা। হাজারের ওপর মানুষ নিহত হলো নিমিষেই। তার পরদিন জরুরি বিভাগে কাজ করবার সময় একটি ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম।
পঞ্চাশ বছর বয়সের এক দাড়িওয়ালা শিখকে মুসলমান সন্ত্রাসী ভেবে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে জরুরি বিভাগে নিয়ে এসেছিলো একদল মানুষ। চোখের সামনে মারা গেলো সেই নিরীহ মানুষটি। একটি ছোট মুদিখানার মালিক এই শিখ লোকটিকে একদল মানুষ মেরেছিল আর একদল মানুষ তার দোকানটি লুটপাট করেছিল। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে দেখে আসছি সংখ্যালঘু মুসলমাদের ওপর অত্যাচার।
এই কোভিড অতিমারিতে দেখছি সংখ্যালঘু এশিয়ানদের ওপর অনাচার-অত্যাচার। সবগুলো ঘটনার পেছনে, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের একটা প্যাটার্ন আছে। অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকে। অনেক সময় থাকে একদ লোভী বর্বর সুযোগসন্ধানী মানুষের লালসা।
এবারের বাংলাদেশের দুর্গাপূজার সময় যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটলো এটি তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। সারা বিশ্বজুড়ে চলছে এখন সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার। অতিমারির এ যুগে ফ্যাসিস্টদের বৈশ্বিক বিস্তার অকল্পনীয়। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা যদি এর বিরুদ্ধে জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ না হই এবং আইনের শাসন না করতে পারি তবে আমাদের জন্য আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। আমাদের সাবধানী নীরবতা আমাদের কাউকেই ছাড়বে না। যে কোনো ইস্যুতে আমরা যে কেউ হয়ে যাবো সংখ্যালঘু, আর রক্ষা পাবো না কেউ।