নিজস্ব প্রতিবেদক: জোট করলেও প্রার্থীর স্ব স্ব দলের প্রতীকে ভোট করা নিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বিধান যুক্ত করায় নির্বাচন কমিশনকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে প্রশংসা করেছে নতুন নিবন্ধিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
বড় কোনো দলের চাপ থাকলেও ইসির সিদ্ধান্ত যেন অটুট থাকে সে দাবি জানিয়েছে দলটি। তবে এবার ভোটের প্রচারে পোস্টার বন্ধ করে দিয়ে নানা ধরনের ‘অমূলক’ বিষয় যুক্ত করায় আচরণবিধি বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দলটির নেতারা।
বুধবার (১৯ নভেম্বর) সকালের পর্বে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে এনসিপিসহ সাতটি দল ইসির সংলাপে অংশ নেয়।
নিবন্ধন পাওয়ার পর এনসিপি প্রথম সংলাপে অংশ নেয়। এতে মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মূসা ও এনসিপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি তাসনিম জারা অংশ নেন। এসময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিন, অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, সিদ্ধান্তে অটুট থাকবেন: জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির মূখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন,জোট করলেও নিজ নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে-ইসির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কোনো বড় দলের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। ইসি যেন নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন সে আহ্বান জানাই।
আগের বিধান অনুযায়ী জোট মনোনীত প্রার্থীরা অন্য দলের প্রতীকেও ভোট করতে পারত। এবার আরপিও সংশোধিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে জোট করলেও ভোট করতে হবে প্রার্থীর নিজ দলের প্রতীকে। বিএনপির পক্ষ থেকে আরপিও বিধানটি ফের সংশোধনের তাগিদ দিয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন ও আইন উপদেষ্টার কাছে।
নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারীর কথায়, প্রতীক কিন্তু একজনের পরিচয়। নিজের শরীর আছে, কিন্তু কেউ অন্যের প্যান্ট, জামা পরে ইলেকশনে যায়, তাহলে মুখ দেখে চেনা যাবে কে? তাই যারা রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিবৃন্দ রয়েছেন, দীর্ঘ সময় পরে আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছে নিজের প্রতীকে নির্বাচন করে নিজের জায়গায় নিজের পরিচয় জানানোর। এই সুযোগটি আমরা হারাবো না—এটা আমাদের বড় পাওয়া। গণভোটের বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কর্মপরিকল্পনাও চান এনসিপি নেতা।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, আমাদের এই ইলেকশনের বড় একটি বিষয় হচ্ছে গণভোট। গণভোট কী প্রক্রিয়ায় হবে? কিভাবে আপনারা এটা বাস্তবায়ন করবেন? এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আমরা কবে পাব? কবে আমরা প্রচারণা করতে পারব সে বিষয়ে জানাবেন। আমরাও কিছু কলাবোরেশন কাজ করতে পারবো বলে আশা করি। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অবস্থান দেখালে দলটির পক্ষ সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
সব দল মাঠে নামলে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির আহ্বান জানিয়ে মূখ্য সমন্বয়ক বলেন, ইলেকশন কমিশন সব দলের উপরে থাকবে। ইসি যদি তার স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রাখতে পারে এবং যদি তার দায়বদ্ধতা সংবিধানের কাছে থাকে, কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে না থাকে; তাহলে আমরা শতভাগ ইসি যে কোঅপারেশন চাওয়া হবে, তা দেবো। এবং ইলেকশন কমিশন যেভাবে ইলেকশনকে দিকনির্দেশনা দেবে, আমরাও সেভাবেই মেনে চলার চেষ্টা করবো।
ভোটকে সামনে রেখে নারী কোনো ধরনের হয়রানি শিকার হলে তা মনিটরিংয়ের পাশপাাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং নির্বাচনি পরিবেশ উৎসবমুখর করতে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান পাটওয়ারী। প্রবাসী ভোটারদের গণভোটে সম্পৃক্ত করা, ব্যাপক প্রচারণা এবং ভোটের আগেও যারা ১৮ বছর হবে তাদের তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক।
সক্ষমতা নেই ইসির: এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মূসা বলেন, দেশের মাটি মানুষ নির্বাচনি সংস্কৃতি ও উৎসবের আমেজ রয়েছে, বিদ্যমান আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন যারা করেছে তার সঙ্গে এর সংযোগ নেই। নির্বাচনি আমেজ মানে পোস্টারিং, মাইকিং, জনসম্পৃক্ততা ও জনসভাকে বুঝি। এখানে এমন অন্যায্য বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে, এটা বাস্তবায়নের করার কোনো সক্ষমতা ইসির নেই।ৃএটা নিপীড়ণমূলক আইন হবে যদি নির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে করে, শক্তিশালী কারোর বিরুদ্ধে একই বিধান ব্যবহারের সক্ষমতাও আপনার নেই। এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব বলেছেন, বিধি লঙ্ঘনের শাস্তি বাস্তবায়ন করা হবে কীভাবে, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কীভাবে কাজটি করা হবে তা স্পষ্ট নেই। তফসিল ঘোষণার পর অভিযোগ পেলে তদন্ত করার জটিলতা ও সময়ক্ষেপণ করা এবং এত অল্প সময়ে এত বার্ডেন নেওয়ার লোকবল, সক্ষমতা ইসির নেই।
কমিশনের প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু কতদিনের মধ্যে কিভাবে করবে তা বলা নেই। ইসির কর্মকর্তা যদি নিরপেক্ষ না থাকে, কোনো প্রতিকারের বিষয় এখানে নেই। কর্মকর্তা কিছু করল না, এর মেকানিজম থাকা দরকার ছিল বিধিতে। সার্বিকভাবে বিদ্যমান আচরণবিধি অবাবস্তবভিত্তিক বলে মনে করেন তিনি।
জহিরুল ইসলাম মূসার ভাষ্য, এটা নির্বাচনি ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছে। পরিবেশবান্ধব করেছে বটে, অবকাঠামোগত সুবিধা অস্বীকার করেছেন। পোস্টার নিষিদ্ধ করেছেন।ৃপ্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রার্থীরা অল্প সময়ে চটের ব্যাগে কাপড়ের প্রিন্ট দিয়ে প্রচারণা করবেন কিভাবে? এটা অমূলক।
ইসির প্রথম টেস্ট, বিএনপির প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন: আচরণবিধিতে (৭ এর চ দফা) বলা হয়েছে, দলীয় প্রার্থী কেবল তার বর্তমান দলীয় প্রধানের ছবি ব্যানার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ও ফেস্টুনে ছাপাতে পারবেন। প্রচারণার ছবি পোট্রেট সাধারণ হতে হবে নির্ধারিত মাপের (আয়তন ৬০ ও ৪৫ সেমি এর মধ্যে)।
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মূসা আচরণবিধির তুলে ধরে বিএনপির নাম নিয়ে বলেন, ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করছি। আপনাদের রিয়েল টেস্ট হবে। বিএনপির প্রধান দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সেখানে বিএনপির প্রার্থীরা (ভারপ্রাপত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানের ছবি ব্যবহার করলে বা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের তার উপরে আচরণবিধি প্রয়োগ ব্যবহার করতে হবে। তিনি জানান, প্রার্থী তার দলের বর্তমান প্রধানের ছবি ছাড়া অন্যদের ছবি ব্যবহার করতে পারবে না।
আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলছি-প্রথম টেস্ট হবে। তারেক রহমানের ছবি বিএনপির প্রার্থী ব্যবহার করলে প্রথমেই তার উপরে আচরণবিধি প্রয়োগ করে সক্ষমতা দেখাতে হবে। তারেক রহমান বা শহীদ জিয়াউর রহমানের ছবি ব্যহার করলে কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তখন এ ইসির সক্ষমতা দেখতে পাবো এটা এটা বাস্তবায়নর জন্য কতটুকু প্রতিজ্ঞবদ্ধ আছেন। বিলবোর্ড, ব্যযসীমা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি।
জহিরুল ইসলাম মূসা বলেন, অন্যায্য প্রতিযোগিতায় হাত-পা বেঁধে ফেলে দিচ্ছেন। মনিটরিং করতে না পারলে এ উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ। সুন্দর আইন তৈরি করে হাঁত পা বেধে দিয়েছে, আইনের ভেতরে এত অস্পষ্টতা, দুর্বলতা রেখেছেন।..এমন এমন আইন করছেন যে নির্বাচনি সংস্কৃতির সঙ্গে এডজাস্ট করছে না।
পোস্টার-ফেস্টুনের পক্ষে গণসংহতি: অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে আইন-বিধি চূড়ান্ত করায় ইসির সমালোচনা করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি। স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নির্বাচন কমিশন নিশ্চিতে সাংবিধানিক পরিবর্তন ও নিয়োগের প্রস্তাবনাও তুলে ধরেন তিনি। ভোটের আগে নির্বাচনি পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়ে প্রধান সমন্বয়ক বলেন, নির্বাচনি পরিবেশ তৈরিই বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য একটা মনিটরিং কমিটি হওয়া দরকার। দলের প্রতিনিধিসহ সরকার, ইসির প্রতিনিধি নিয়ে এ কমিটি হতে পারে। দলেল সহযোগিতা যখন করেছে, তখন ভালো নির্বাচন হয়েছে।
জোট মনোনীত প্রার্থীদের জন্য প্রতীক বাছাই উন্মুক্ত রাখার পক্ষে মত দেন প্রধান সমন্বয়ক। জোটের প্রতীক নিয়ে বাধা রাখা সমীচিন নয়। অনেকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করবেন। জোটগতভাবে নির্বাচন করলে অন্য দলের প্রতীকে ভোট করার সুযোগ রাখা দরকার-বলেন তিনি।
সংসদ ও গণভোটের জন্য আলাদা বুথ ও গণনা রাখার সুপারিশ করেন জুনায়েদ সাকি। পোস্টার ও ব্যানার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফেস্টুন কার্যকর হবে না এমন বিধান কার্যকর করতে হবে। হাজার হাজার ফেস্টুন ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় রয়ে গেছে। প্রতি ওয়ার্ডে একটা থাকবে বলা হচ্ছে, কিন্তু অনেকে বেশি রাখছে মনিটরিং করতে হবে। পোস্টারও বন্ধ করে দিয়েছেন। পোস্টার-বিলবোর্ড এর বিষয়ে রিথিংক করতে হবে। মানুষজন আসা-যাওয়া পথে যাতে দেখতে পায়, এটা ছাড়া হবে না। নির্বাচই প্রচারণায় বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। পোস্টার ও ফেস্টুন নিয়ে ভাবা দরকার ও প্রচার প্রার্থীর নিজের দায়িত্বে দিলে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন সাকি।
আবুল হোসেন রুবেল বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালন করার যথেষ্ট কর্মকর্তা নেই, সত্যিকার প্রতিকার নেই। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে প্রতিকারের ব্যবস্থা হয় না। কার্যকর ব্যবস্থা আমরা চাই। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রার্থীর এজেন্টদের দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। প্রার্থীদের নিরাপত্তা সামনে হুমকির শঙ্কা প্রকাশ করে অস্ত্র উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া, সিসি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়ে ইসির উদ্যোগ ও এআইয়ের অপব্যবহার রোধে দক্ষ কারিগরি টিম গঠনের পরামর্শন দেন গণসংহতি আন্দোলনের এ নেতা।
আরো কয়েক দলের প্রতিনিধি: তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের পরিপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, যে ক্ষমতায় সব কিছু থাকবে সিইসির। তার ডিরেকশন, প্রজ্ঞায়, তার ক্ষমতায় একটা গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।
বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি-বিএমজেপি’র সভাপতি সুকৃতি কুমার মণ্ডল বলেন, ভোটের আগে ৭ দিন ও ভোটের পরে ১০ দিন সেনাবাহিনীসহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর ইরান বলেন, নির্বাচন কমিশনকে আমরা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে একটা জায়গায় দেখতে চাই। সুন্দর র্বিাচন চই, একটা ভোট উৎসব চাই।
বিরাজমান অস্থির পরিবেশে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন ইনসানিয়াত বিপ্লবের মহাসচিব শেখ রায়হান রহবার। সেক্ষেত্রে মোবাইল ‘ডিজিটাল থাম্ব’ নামে একটি পদ্ধতি প্রবর্তনের সুপারিশ রাখেন তিনি।
বুধবার সকালের পর্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি-বিএমজেপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বাংলাদেশ লেবার পার্টির প্রতিনিধিরা সংলাপে অংশ নেন।
সানা/আপ্র/১৯/১১/২০২৫



















