প্রত্যাশা ডেস্ক : বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আগামী জুলাই মাস থেকেই যাত্রীবাহী লঞ্চের পাশাপাশি স্পিডবোট এবং পণ্য ও বালুবাহীসহ সব ধরনের নিবন্ধিত নৌযানের রুট পারমিট নেয়া বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ১১ ক্যাটাগরিতে নৌযানের আকার ও ধরন ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রুট পারমিট ফি আদায়ের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য নৌমন্ত্রণালয়ে পাঠিনো হয়েছে। তাতে নৌযান ভেদে বছরে ৪শ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত রুট পারমিট ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এ বিধান পুরোপুরি কার্যকর হলে রুট পারমিট ছাড়া নিবন্ধিত নৌযান চলাচল করতে পারবে না। যদিও তাতে সরকারের কয়েকটি সংস্থার বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নৌযানের ওপর এমন বাধ্যবাধকতা আরোপের ক্ষেত্রে নৌযান মালিকরা কঠোর বিরোধিতা করছে। পাশাপাশি নতুন নিয়মের শর্তে বিআইডব্লিউটিএ’র ঐতিহাসিক ৭টি ড্রেজারসহ বেশ কয়েকটি নৌযান এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) ঐতিহ্যবাহী স্টিমার লেপচা, টার্ন ও মাসুদসহ প্রায় অর্ধশত নৌযান বন্ধের উপক্রম হবে। বর্তমানে শুধুমাত্র যাত্রীবাহী লঞ্চের রুট পারমিট নেয়া বাধ্যতামূলক। দেশের ২২৭টি নৌপথে ৭৮০টি লঞ্চের রুট পারমিট রয়েছে। নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের হিসাবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত নৌযান রয়েছে ১৩ হাজার ৪৮৬টি। তার বাইরে নৌপথে বিপুলসংখ্যক অনিবন্ধিত নৌযানও চলাচল করছে। মূলত নৌপথে শৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেই এ বিধান কার্যকর করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে যাত্রীবাহী লঞ্চ রুট পারমিট নেয়ায় তারা আইন লংঘন করলে বিআইডব্লিউটিএ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু অন্যান্য নৌযানের রুট পারমিট না থাকায় তারা যথেচ্ছা চলাচল করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এমনকি সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া চলাচলকারী বালুবাহী বাল্কহেডের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। ওসব বাল্কহেড সব নিয়ম লংঘন করে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙর থেকেও পণ্য পরিবহণ করে। রুট পারমিটের বিধান চালু হলে কোনো নৌযান রুটের বাইরে চলতে পারবে না। নিবন্ধিত ১১ ধরনের নৌযান চলাচল করতে হলে রুট পারমিট নিতে হবে। তাতে রয়েছে সব ধরনের যাত্রীবাহী লঞ্চ, পরিদর্শন জাহাজ, ভ্রমণতরী, পর্যটকবাহী জাহাজ, প্রশিক্ষণ জাহাজ, স্পিডবোট ও ওয়াটার ট্যাক্সি। তাছাড়াও রয়েছে পণ্যবাহী জাহাজ, বালুবাহী নৌযান, তেলবাহী জাহাজ, এলপিজি ট্যাংকার, উদ্ধারকারী জাহাজ, ড্রেজার, ফিশিং বোট ও ফেরি। জাহাজের শ্রেণি ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৪শ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বছরে রুট পারমিট ফি দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে রুট পারমিট না নিলে জরিমানাও গুনতে হবে। আর রুট পারমিট ছাড়া চলাচল করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নৌযানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। তাছাড়া বিআইডব্লিউটিএর প্রস্তাব অনুযায়ী কোনো নৌযানকে রুট পারমিট পেতে হলে ওই নৌযানের রেজিস্ট্রেশন সনদ ও সার্ভে সনদ (ফিটনেস সনদ) থাকতে হবে। সার্ভে সনদের মেয়াদ যতোদিন থাকবে, রুট পারমিটও ততোদিন বহাল থাকবে। ওই শর্তের জালেই আটকা পড়বে বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির প্রায় অর্ধশত নৌযান।
সূত্র আরো জানায়, বিআইডব্লিউটিএ ১৯৭২ ও ১৯৭৫ সালে ৭টি ড্রেজার সংগ্রহ করেছির। সেগুলোর বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। তাছাড়া পরিদর্শন জাহাজ হাতিয়া, সালমা, সুরাইয়া, আজরা, উদ্ধারকারী জাহাজ হামজাসহ আরো অন্তত ২০টির বেশি জাহাজের বয়স ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। একইভাবে বিআইডব্লিউটিসির ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার অস্ট্রিচ, মাসুদ, লেপচা, শেলা, উপকূলীয় জাহাজ মতিন, মনিরুল হকসহ ১০টির বেশি জাহাজের বয়স ৪০ বছরের বেশি। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ অনুযায়ী প্রতিটি নৌযান সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত চলতে পারে। তার বেশি বয়সি হলে সেগুলোর সার্ভে সনদ দেয় না নৌ মন্ত্রণালয়ের আরেক সংস্থা নৌপরিবহণ অধিদপ্তর।
এদিকে ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ (নৌরুট পারমিট, সময়সূচি ও ভাড়া নির্ধারণ) বিধিমালা’ ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর জারি হয়। ওই বিধিমালা জারির আগে শুধু লঞ্চের রুট পারমিট নেয়ার বিধান ছিল। নতুন বিধিমালায় সব ধরনের নৌযানকে রুট পারমিট নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। তাতে সারা দেশকে ১৫টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। তবে বিআইডব্লিউটিএ দেড় বছরেও ওই বিধিমালা পুরোপুরি কার্যকর করেনি। এমনকি বিধিমালার ৩৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী রুট পারমিট ফি নির্ধারণ করেনি। সম্প্রতি ১২ ধরনের নৌযানের আকার ও শ্রেণি অনুযায়ী ফি আরোপের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য নৌমন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় রুট পারমিট নেয়ার বাধ্যবাধ্যকতা থেকে কাঠের নৌকা বাদ দেয়া হয়। বাকি ১১ ধরনের নৌযানের রুট পারমিট নেয়া ও এ সংক্রান্ত ফি দেয়ার প্রস্তাব বহাল রাখা হয়।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. খুরশীদ আলম জানান, নৌপথে সব নৌযানের রুট পারমিট বিধিমালা কার্যকর হলে পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। পণ্য পবিরহনে ট্রাকের যেমন কোনো রুট পারমিট থাকতে পারে না, তেমনি মালবাহী নৌযানেরও কোনো নির্দিষ্ট রুট থাকতে পারে না। যখন যেখানে ট্রিপ পাবে সেখানেই যাবে- এটাই তার রুট। এর বাইরে কোনো রুট বেঁধে দেয়া হলে সেখানে ট্রিপ নাও পেতে পারে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম জানান, বিআইডব্লিউটিসির যেসব জাহাজের বয়স ৪০ বছরের বেশি সেগুলোর সার্ভে সনদ নেই। তবে নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের বিশেষ অনুমতি নিয়ে চলে। এখন যদি রুট পারমিট বিধিমালা কড়াকড়ি করে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ওসব জাহাজ আউট অব সার্ভিস হিসাবে বিক্রি করে দিতে হবে।
একই প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক জানান, নতুন অর্থবছরে সব নৌযানের জন্য রুট পারমিট বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যাতে রুট পারমিট ফি থেকে সংস্থার রাজস্ব আদায় বাড়বে। পাশাপাশি নৌপথেও শৃঙ্খলা আসবে। কোন অঞ্চলে কতোটি নৌযান চলাচল করবে তা ঠিক করে দেয়া যাবে। অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধ করা হবে। যদিও এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। তবে সেগুলো আলোচনা করে সমাধান করা হবে।
আগামী মাস থেকেই সব নৌযানের রুট পারমিট বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ
























