নিজস্ব প্রতিবেদক : অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই অর্থের মধ্যে সরকারকে সুদ ব্যয় বাবদই বরাদ্দ রাখতে হবে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ সুদ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে সুদ ব্যয় বাবদ ধরা আছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো জানায়, চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ শেষ পর্যন্ত কুলাচ্ছে না। সংশোধিত বাজেটে সুদ ব্যয় বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে এরই মধ্যে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
জানা গেছে, সুদ ব্যয়ের বড় অংশই যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা গুনতে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে চলতি অর্থবছরের সাত মাসের যে হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেতিবাচক। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরে নতুন সঞ্চয়পত্র যত বিক্রি হচ্ছে, গ্রাহকেরা আগে কেনা সঞ্চয়পত্র তার তুলনায় বেশি পরিমাণে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তবে সরকারের ব্যাংকঋণ এখন পর্যন্ত সীমার মধ্যেই আছে বলে জানা গেছে। বাজেটে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। তবে জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে সরকার নিয়েছে এর এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আগের নেওয়া ঋণসহ সরকারের ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
সুদ খাতে এত বরাদ্দ কেন: সাত মাসে ব্যাংকঋণ কম থাকলেও আগামী বাজেটে সুদ ব্যয় বাবদ এত বরাদ্দ রাখার চিন্তা কেন করা হচ্ছে, এ নিয়ে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা স্পষ্ট কোনো কথা বলেননি। একজন কর্মকর্তা শুধু এটুকু বলেন, আগামী অর্থবছরে ঋণ বেশি নিতে হবে, তাই সুদ ব্যয়ও বেশি হবে। এমনকি চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে অর্থাৎ মে-জুনের দিকে ব্যাংকঋণ বেশি নেবে সরকার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘পরিমাণটা বেশি। সুদ ব্যয় এভাবে বাড়তে থাকলে চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। আমার মনে হয়, প্রথমেই নতুন ঋণ নেওয়া কমাতে হবে।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার মান কমে যাওয়ায় সুদের পরিমাণের ওপর প্রভাব পড়েছে, বিশেষ করে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে। তবে সঞ্চয়পত্রের সুদ ব্যয় আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে কমে যাবে। আর ভবিষ্য তহবিলের টাকাটা অন্য দেশের মতো যদি কোথাও খাটানো যেত, তাহলে সরকারের একটু আয় বাড়ত। কিন্তু সে লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। চলতি অর্থবছরে সুদ ব্যয়ের অর্ধেকের বেশিই সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। পরিমাণ ৪২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ট্রেজারি বন্ডের বিপরীতে সুদ ২২ হাজার ৩০৫ কোটি, বিদেশি ঋণের সুদ ৭ হাজার ২৫৯ কোটি ও ভবিষ্য তহবিলের ওপর সুদ ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, সঞ্চয়পত্র ছাড়া সব ধরনের ঋণ বৃদ্ধির কারণে আগামী অর্থবছরে এ সব খাতে সুদ ব্যয় বাড়বে। এমনকি আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়ও বাড়বে। আর নতুন সঞ্চয়পত্র বিক্রি কম হলেও আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদ ব্যয় ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত ছয়টি অর্থবছরের বাজেটের সারসংক্ষেপ ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুদ ব্যয় ছিল ৪৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। পরে এই ব্যয় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫৭ হাজার ৬৬৪ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ হাজার ৬০৬ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। সুদ ব্যয় আগামী দুই থেকে তিন অর্থবছর পর থেকে কিছুটা কমবে বলে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন। এ আশার ভিত্তি হচ্ছে, আয়করসংক্রান্ত কাগজপত্র দাখিল করার শর্তের কারণে সঞ্চয়পত্রের অনেক গ্রাহক নতুন করে সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটাবেন না। আরেকটি কারণ হচ্ছে, ভবিষ্য তহবিলের ওপর বর্তমানে যে ১২ শতাংশের মতো উঁচু হারে সুদ দেওয়া হয়, সে হার কমিয়ে আনার চিন্তা চলছে। যদিও গোষ্ঠীস্বার্থে শেষ পর্যন্ত তা না–ও ঘটতে পারে বলেও কর্মকর্তারা মনে করছেন। সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, খরচ কমানো যাবে না। আর ঘাটতি বাজেটে ঋণ নিতেই হবে এবং তার বিপরীতে সুদও দিতে হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় যে পরিমাণ কর সংগ্রহ করা সম্ভব, তা কি সংগ্রহ করা হচ্ছে? হচ্ছে না। মাহবুব আহমেদ আরও বলেন, কর সংগ্রহ করা গেলে সরকারকে এত পরিমাণ ঋণ নিতে হতো না এবং তার বিপরীতে এত সুদও গুনতে হতো না। ঋণ নিয়ে ভালো কোনো লাভজনক খাতে বিনিয়োগের সুযোগও কম, যেখান থেকে আয় করা সম্ভব।
আগামী বাজেটে সুদ দিতে হবে এক লাখ কোটি টাকার বেশি
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ