ঢাকা ০২:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৫

আইন থাকলেও বাবার সম্পত্তি পেতে থামেনি নারীদের লড়াই

  • আপডেট সময় : ০৭:৫৭:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
  • ২ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য দরকার পায়ের নিচের জমি। সভ্য সমাজ নারী-পুরুষ উভয়েরই সংমিশ্রিত রূপ ও অবদান। কিন্তু বর্তমানেও নারীরা বঞ্চিত হন পরিবার ও সমাজে। পারিবারিক সম্পত্তিতেও পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য অংশ। ফলে নিগৃহীত হচ্ছেন পদে পদে। প্রাচীনকাল থেকেই নারীকে অবদমন করার চর্চা চালু রয়েছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব দিক থেকেই নারী হয়েছেন শোষণের লক্ষ্যবস্তু। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে অনাকাক্সিক্ষত কন্যাসন্তানকে জীবিত হত্যা করা হতো, অস্বীকার করা হতো। ওই চর্চা এখনো এ সমাজে প্রচলিত! এখনো অনেক পরিবারে কন্যাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে, অধিকার হরণ করে সন্তান হিসেবে অস্বীকৃতি জানানো হয়! এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার

মানিকগঞ্জের আয়েশা বেগম (ছদ্মনাম)। এক যুগ আগে বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য সালিশে পাঁচ বিঘা জমির ভাগ পান। দলিল, পর্চা, খাজনা খারিজ-সব কাগজ হাতে থাকলেও এখনো জমি বুঝে পাননি তিনি। যতবারই জমি নিতে যান, ভাইয়েরা নানা অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে দেন। এক যুগ ধরে ভাইদের সঙ্গে এমন মনোমালিন্য চলছে। আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সত্ত্বেও এখনো জমির অধিকার পায়নি আয়েশা।

শুধু আয়েশা নন, তার মতো হাজারো নারী বাবার সম্পত্তি পেতে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন ও ধর্ম তাদের অধিকার নিশ্চিত করলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। ভাইদের অনিচ্ছা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা না পাওয়া এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে অনেক নারী জমি বুঝে নিতে পারছেন না। তারা জানান, বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য সালিশে জমি পান তারা। পর্চা, খাজনা খারিজ ও দলিলও তারা বুঝে পেয়েছেন। তবু আপন ভাইয়েরা জমি বুঝে দিচ্ছেন না-যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমি উদ্ধারে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও অনেকে কোনো সহায়তা পাননি; বরং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন। এতে ভাইদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে গেছে।

সম্পত্তি চাইলে মনোমালিন্য বাধে: আয়েশা আক্তারের একমাত্র ছেলে রুবেল বলেন, ‘মামারা আমাদের জমি দিতে চায় না। অথচ আমার মা পাঁচ বিঘা জমি পাবে। কিন্তু আইনে থাকলেও আমরা নিতে পারছি না। প্রতি বছর জমি চাইতে গেলেই মনোমালিন্য শুরু হয়।’

২৫ বছরেও জমির দখল পাননি নাজমা আক্তার: যশোরের কলারোয়া উপজেলার কেরালকাথা ৯নং ইউনিয়নের নাজমা আক্তারের গল্পও একই রকম। ছয় বোন ও তিন ভাই তারা। বাবার মৃত্যুর পর বোনেরা তিন বিঘা জমি পান। যদিও তাদের বাড়ি ভিটা মিলে জমির পরিমাণ ছিল ১৮ বিঘা। কিন্তু তাদের ভাইয়েরা বাকি সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। শুধুমাত্র ৯ বিঘা জমি ভাগ বণ্টন হয়। দলিল, পর্চা, খাজনা খারিজ-সবই আছে। তবু ২৫ বছর ধরে জমির দখল নিতে পারেননি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার দ্বারস্থ হয়েও সমাধান হয়নি। শেষমেষ বণ্টননামার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু সেই মামলাতেও তারা জমির দখল বুঝে পাবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহে আছেন।

দেড় যুগ আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় নাজমা আক্তারের। এখন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরি করেই সংসার চলে তার। স্বপ্ন ছিল বাবার সম্পত্তি পেলে হয়তো তার জীবনের কিছুটা গতি আসতো। মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিতেন জমি বিক্রির টাকায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন আলোর মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত নাজমা।

নাজমা আক্তার বলেন, ‘২৫টা বছর ধরে ঘুরতেছি। গ্রাম্য সালিশ, বিচার, ইউএনও সবার কাছে গিয়েছি কিন্তু কেউ সমাধান দিতে পারেনি। ভাইয়েরা বসবে বলে তারিখ দেয়, কিন্তু দেখা যায়, ওই দিন তারা বাড়ি থেকে উধাও। ২০২২-২৩ সালে স্থানীয় ইউএনওকে ধরলাম। তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিলেন। ছুটি নিয়ে ১২ দিন গ্রামে ছিলাম কিন্তু চেয়ারম্যান আমাকে দেখা দেয়নি। এমনকি বিষয়টি সমাধান করে দেবেন কিনা সে বিষয়েও কিছু বলেনি। আমি এখন হতাশ।’

আইন থাকলেও কার্যকর নয়: দিনাজপুরের রুবিনা আক্তারের তিন বোন ও চার ভাই। অন্য দুই বোনের আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তারা জমির ভাগ চান না। কিন্তু রুবিনার সংসারিক অবস্থা ভালো না হওয়ার ভাইদের কাছে জমি চান। এ নিয়ে ভাইদের সঙ্গে তার তিন যুগ ধরে মনোমালিন্য চলছে।

রুবিনার ছোট ছেলে সামাদ বলেন, ‘মামাকে বলেছি জমির ভাগ না দিলে প্রয়োজনে আদালতের দারস্ত হব।’
এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ১৯৭০ সালের আগে মারা যান দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মমতাজ বেগম। সন্তানরা বড় হলেও মামারা তাদের জমি বুঝে দিচ্ছেন না। তার পাঁচ বিঘা জমি এখনো ভাইয়েরা দখলে রেখেছেন।

মমতাজের ছেলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আইন থাকলেও মামারা আমাদের জমি দেয়নি। বলে তোরা তো আইনে পাবি না। আমরা এতিমের মতো মানুষ হয়েছি।’

জমি পেলেও কম দামে বিক্রির চাপ: শেরপুরের রহিমা বেগম দুই বিঘা জমি ভাগে পেলেও ভাইদের চাপে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

রহিমা বলেন, ‘এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল ভাইদের কাছে জমি বিক্রি না করলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তারা মনঃক্ষুণ্ন হতো। উপায় না পেয়ে কম দামে ভাইদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হই।’
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়। সেখানে বাবার সম্পদ পেলেও ভাইয়েরা সম্পদ দিচ্ছেন না বলে এক নারী অভিযোগ করেন। ভাইয়েরা তাদের কাছে জমি বিক্রি করতে বলছে। বাজার দর অনুযায়ী ওই জমির দাম ৩০ লাখ টাকা হলেও ভাইয়েরা তাকে দিতে চায় মাত্র ছয় লাখ টাকা।

ইউএনও মায়েদুল ইসলাম বলেন, ‘এমন অভিযোগ প্রায়ই আসে। এমন অভিযোগের সংখ্যা অনেক। তবে আমরা এসব বিষয়ে আগে অভিযোগ নিই। পরে শুনানিতে আমরা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি।’
মুসলিম আইন কী বলে: মুসলিম আইনে বাবা মারা গেলে ছেলেমেয়ে উভয় থাকলে ছেলেরা যত সম্পত্তি পাবে, মেয়েরা তার অর্ধেক পাবে। অর্থাৎ ভাইয়েরা চাইলে বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর যদি মৃত ব্যক্তির ছেলে না থাকে এবং এক বা একাধিক মেয়ে থাকে, তবে তারা মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে।

মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পেতে আইনি জটিলতাটি কোথায়: দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মমতাজ বেগম। সত্তরের দশকের আগে মারা যান। পাঁচ বছরের কন্যা ও দেড় বছরের ছেলেকে রেখে বিরল রোগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর সেই ছেলে মেয়েরা সাবালক হলে মামাদের কাছে মায়ের জমির ভাগ চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মামারা কোন ভাগ দেয়নি। মানবিক সহানুভূতিতেও নয়। উল্টো তাদের মায়ের পাঁচ বিঘা জমি তিন ভাই মিলে ভোগ দখল করে খাচ্ছেন। তার একমাত্র ছেলে জিয়াউর রহমান বলেন, মা তার বাবার সম্পত্তি পাবেন কিন্তু তিনি ১৯৭০-এর আগে মারা যাওয়ায় আমরা কোন ভাগ পাইনি। দুই ভাই বোন এতিমের মতো মানুষ হয়েছি। মামারা আজো কোনো ভাগ দেয়নি। বলে তোরা তো আইনে পাবি না।

শেরপুরের রহিমা বেগম তার বাবার সম্পত্তি থেকে দুই বিঘা জমি ভাগে পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাইদের আপত্তির মুখে সেই জমি তাদের কাছে কম দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি। তার মতে, এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যদি তাদের কাছে জমি বিক্রি না করতাম তাহলে ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বসে থাকতো।

যা বলছেন আইনজীবী ও আলেমরা: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে যে আইন আছে তাতেই নারীরা তাদের সম্পত্তির ভাগ পেতে পারে। কিন্তু মামলার করলে দীর্ঘদিন ধরে চলে সেই মামলা। রায় হতে হতে অনেকে মারা যান। এক সময় ছেলেমেয়েরা আশা ছেড়ে দেন। বাঁটোয়ারা মামলা করলে একজন ভুক্তভোগী আইনি বিচার পেতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকায় জটের কারণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হওয়ায় ভুক্তভোগীদের বিচার পেতেও দীর্ঘ সময় লাগছে। বিষয়টি সমাধানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা যেতে পারে।’

অনেক আইনজীবীর মতে, শুধু ভাগবাঁটোয়ারার মামলা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রকৃত সমাধান আসে সমাজের মানুষের সচেতনতা ও ন্যায্য বোধ জাগ্রত হলে। বিশেষ করে ভাইদের দায়িত্ব প্রথমে সচেতন হওয়া, যাতে বোনরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। যতক্ষণ ভাইদের মধ্যে এই বোধশক্তি তৈরি হবে না, ততক্ষণ আইনও একা সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। এ ছাড়া, দীর্ঘসূত্রীর মামলার কারণে ভুক্তভোগীরা প্রায়ই হয়রানি ভোগ করেন এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।

মোহাম্মদপুর জামিয়া রহমানিয়া মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা কামরুল হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই পরিষ্কার। এখানে নারীকে তার ভাগ দিতেই হবে এটি স্পষ্ট করেই বলে হয়েছে। ইসলাম বলেছে, নারী যা অংশ পাবে তার দ্বিগুণ পাবে ভাই। নারী পাওয়াটাই এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর এই ভাগ বা অংশ যদি কেউ না দেন, তবে তিনি খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী হিসেবেই গণ্য হবে। হাশরের ময়দানে যে বোন বা যাকে তার সম্পদ দিলো না সেই পাওনাদারকে তার আমলনামা তাকে দিয়ে তারপর পরিত্রাণ পেতে হবে। এ ছাড়া তার পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোন রাস্তা নেই।’ তিনি বলেন, ‘কারো কাছে ১০ হাজার টাকা ধার নিয়ে তা পরিশোধ করা যেমন জরুরি, বোন বা মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ তাকে ফিরিয়ে দেওয়াও তেমনি জরুরি। এটা তার হক। তা থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। যদি কেউ আত্মাসাৎ করে, তাহলে তিনি নিজে সরাসরি জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করলেন এবং এর জন্য অবশ্যই কেয়ামতের মাঠে তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে। এই ধারণাটা যদি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং মানুষ যদি এটাকে ব্যাপক চর্চার মধ্যে নিয়ে আসে, তাহলে প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে। এ জন্য ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার।’

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

আইন থাকলেও বাবার সম্পত্তি পেতে থামেনি নারীদের লড়াই

আপডেট সময় : ০৭:৫৭:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য দরকার পায়ের নিচের জমি। সভ্য সমাজ নারী-পুরুষ উভয়েরই সংমিশ্রিত রূপ ও অবদান। কিন্তু বর্তমানেও নারীরা বঞ্চিত হন পরিবার ও সমাজে। পারিবারিক সম্পত্তিতেও পাচ্ছেন না তাদের ন্যায্য অংশ। ফলে নিগৃহীত হচ্ছেন পদে পদে। প্রাচীনকাল থেকেই নারীকে অবদমন করার চর্চা চালু রয়েছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব দিক থেকেই নারী হয়েছেন শোষণের লক্ষ্যবস্তু। আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে অনাকাক্সিক্ষত কন্যাসন্তানকে জীবিত হত্যা করা হতো, অস্বীকার করা হতো। ওই চর্চা এখনো এ সমাজে প্রচলিত! এখনো অনেক পরিবারে কন্যাকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে, অধিকার হরণ করে সন্তান হিসেবে অস্বীকৃতি জানানো হয়! এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার

মানিকগঞ্জের আয়েশা বেগম (ছদ্মনাম)। এক যুগ আগে বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য সালিশে পাঁচ বিঘা জমির ভাগ পান। দলিল, পর্চা, খাজনা খারিজ-সব কাগজ হাতে থাকলেও এখনো জমি বুঝে পাননি তিনি। যতবারই জমি নিতে যান, ভাইয়েরা নানা অজুহাতে তাকে ফিরিয়ে দেন। এক যুগ ধরে ভাইদের সঙ্গে এমন মনোমালিন্য চলছে। আদালতের দ্বারস্থ হওয়া সত্ত্বেও এখনো জমির অধিকার পায়নি আয়েশা।

শুধু আয়েশা নন, তার মতো হাজারো নারী বাবার সম্পত্তি পেতে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন ও ধর্ম তাদের অধিকার নিশ্চিত করলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন। ভাইদের অনিচ্ছা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা না পাওয়া এবং সামাজিক রীতিনীতির কারণে অনেক নারী জমি বুঝে নিতে পারছেন না। তারা জানান, বাবার মৃত্যুর পর গ্রাম্য সালিশে জমি পান তারা। পর্চা, খাজনা খারিজ ও দলিলও তারা বুঝে পেয়েছেন। তবু আপন ভাইয়েরা জমি বুঝে দিচ্ছেন না-যা তাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জমি উদ্ধারে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলেও অনেকে কোনো সহায়তা পাননি; বরং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছেন। এতে ভাইদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে গেছে।

সম্পত্তি চাইলে মনোমালিন্য বাধে: আয়েশা আক্তারের একমাত্র ছেলে রুবেল বলেন, ‘মামারা আমাদের জমি দিতে চায় না। অথচ আমার মা পাঁচ বিঘা জমি পাবে। কিন্তু আইনে থাকলেও আমরা নিতে পারছি না। প্রতি বছর জমি চাইতে গেলেই মনোমালিন্য শুরু হয়।’

২৫ বছরেও জমির দখল পাননি নাজমা আক্তার: যশোরের কলারোয়া উপজেলার কেরালকাথা ৯নং ইউনিয়নের নাজমা আক্তারের গল্পও একই রকম। ছয় বোন ও তিন ভাই তারা। বাবার মৃত্যুর পর বোনেরা তিন বিঘা জমি পান। যদিও তাদের বাড়ি ভিটা মিলে জমির পরিমাণ ছিল ১৮ বিঘা। কিন্তু তাদের ভাইয়েরা বাকি সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। শুধুমাত্র ৯ বিঘা জমি ভাগ বণ্টন হয়। দলিল, পর্চা, খাজনা খারিজ-সবই আছে। তবু ২৫ বছর ধরে জমির দখল নিতে পারেননি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তার দ্বারস্থ হয়েও সমাধান হয়নি। শেষমেষ বণ্টননামার মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু সেই মামলাতেও তারা জমির দখল বুঝে পাবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহে আছেন।

দেড় যুগ আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় নাজমা আক্তারের। এখন সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। চাকরি করেই সংসার চলে তার। স্বপ্ন ছিল বাবার সম্পত্তি পেলে হয়তো তার জীবনের কিছুটা গতি আসতো। মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিতেন জমি বিক্রির টাকায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন আলোর মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত নাজমা।

নাজমা আক্তার বলেন, ‘২৫টা বছর ধরে ঘুরতেছি। গ্রাম্য সালিশ, বিচার, ইউএনও সবার কাছে গিয়েছি কিন্তু কেউ সমাধান দিতে পারেনি। ভাইয়েরা বসবে বলে তারিখ দেয়, কিন্তু দেখা যায়, ওই দিন তারা বাড়ি থেকে উধাও। ২০২২-২৩ সালে স্থানীয় ইউএনওকে ধরলাম। তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দিলেন। ছুটি নিয়ে ১২ দিন গ্রামে ছিলাম কিন্তু চেয়ারম্যান আমাকে দেখা দেয়নি। এমনকি বিষয়টি সমাধান করে দেবেন কিনা সে বিষয়েও কিছু বলেনি। আমি এখন হতাশ।’

আইন থাকলেও কার্যকর নয়: দিনাজপুরের রুবিনা আক্তারের তিন বোন ও চার ভাই। অন্য দুই বোনের আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় তারা জমির ভাগ চান না। কিন্তু রুবিনার সংসারিক অবস্থা ভালো না হওয়ার ভাইদের কাছে জমি চান। এ নিয়ে ভাইদের সঙ্গে তার তিন যুগ ধরে মনোমালিন্য চলছে।

রুবিনার ছোট ছেলে সামাদ বলেন, ‘মামাকে বলেছি জমির ভাগ না দিলে প্রয়োজনে আদালতের দারস্ত হব।’
এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে ১৯৭০ সালের আগে মারা যান দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মমতাজ বেগম। সন্তানরা বড় হলেও মামারা তাদের জমি বুঝে দিচ্ছেন না। তার পাঁচ বিঘা জমি এখনো ভাইয়েরা দখলে রেখেছেন।

মমতাজের ছেলে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আইন থাকলেও মামারা আমাদের জমি দেয়নি। বলে তোরা তো আইনে পাবি না। আমরা এতিমের মতো মানুষ হয়েছি।’

জমি পেলেও কম দামে বিক্রির চাপ: শেরপুরের রহিমা বেগম দুই বিঘা জমি ভাগে পেলেও ভাইদের চাপে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

রহিমা বলেন, ‘এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিল ভাইদের কাছে জমি বিক্রি না করলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তারা মনঃক্ষুণ্ন হতো। উপায় না পেয়ে কম দামে ভাইদের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হই।’
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়। সেখানে বাবার সম্পদ পেলেও ভাইয়েরা সম্পদ দিচ্ছেন না বলে এক নারী অভিযোগ করেন। ভাইয়েরা তাদের কাছে জমি বিক্রি করতে বলছে। বাজার দর অনুযায়ী ওই জমির দাম ৩০ লাখ টাকা হলেও ভাইয়েরা তাকে দিতে চায় মাত্র ছয় লাখ টাকা।

ইউএনও মায়েদুল ইসলাম বলেন, ‘এমন অভিযোগ প্রায়ই আসে। এমন অভিযোগের সংখ্যা অনেক। তবে আমরা এসব বিষয়ে আগে অভিযোগ নিই। পরে শুনানিতে আমরা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি।’
মুসলিম আইন কী বলে: মুসলিম আইনে বাবা মারা গেলে ছেলেমেয়ে উভয় থাকলে ছেলেরা যত সম্পত্তি পাবে, মেয়েরা তার অর্ধেক পাবে। অর্থাৎ ভাইয়েরা চাইলে বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর যদি মৃত ব্যক্তির ছেলে না থাকে এবং এক বা একাধিক মেয়ে থাকে, তবে তারা মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে।

মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পেতে আইনি জটিলতাটি কোথায়: দিনাজপুরের পার্বতীপুরের মমতাজ বেগম। সত্তরের দশকের আগে মারা যান। পাঁচ বছরের কন্যা ও দেড় বছরের ছেলেকে রেখে বিরল রোগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর সেই ছেলে মেয়েরা সাবালক হলে মামাদের কাছে মায়ের জমির ভাগ চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মামারা কোন ভাগ দেয়নি। মানবিক সহানুভূতিতেও নয়। উল্টো তাদের মায়ের পাঁচ বিঘা জমি তিন ভাই মিলে ভোগ দখল করে খাচ্ছেন। তার একমাত্র ছেলে জিয়াউর রহমান বলেন, মা তার বাবার সম্পত্তি পাবেন কিন্তু তিনি ১৯৭০-এর আগে মারা যাওয়ায় আমরা কোন ভাগ পাইনি। দুই ভাই বোন এতিমের মতো মানুষ হয়েছি। মামারা আজো কোনো ভাগ দেয়নি। বলে তোরা তো আইনে পাবি না।

শেরপুরের রহিমা বেগম তার বাবার সম্পত্তি থেকে দুই বিঘা জমি ভাগে পেয়েছিলেন। কিন্তু ভাইদের আপত্তির মুখে সেই জমি তাদের কাছে কম দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি। তার মতে, এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যদি তাদের কাছে জমি বিক্রি না করতাম তাহলে ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বসে থাকতো।

যা বলছেন আইনজীবী ও আলেমরা: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে যে আইন আছে তাতেই নারীরা তাদের সম্পত্তির ভাগ পেতে পারে। কিন্তু মামলার করলে দীর্ঘদিন ধরে চলে সেই মামলা। রায় হতে হতে অনেকে মারা যান। এক সময় ছেলেমেয়েরা আশা ছেড়ে দেন। বাঁটোয়ারা মামলা করলে একজন ভুক্তভোগী আইনি বিচার পেতে পারেন।’ তিনি বলেন, ‘মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকায় জটের কারণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হওয়ায় ভুক্তভোগীদের বিচার পেতেও দীর্ঘ সময় লাগছে। বিষয়টি সমাধানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে মামলাগুলো দ্রুত শেষ করা যেতে পারে।’

অনেক আইনজীবীর মতে, শুধু ভাগবাঁটোয়ারার মামলা দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রকৃত সমাধান আসে সমাজের মানুষের সচেতনতা ও ন্যায্য বোধ জাগ্রত হলে। বিশেষ করে ভাইদের দায়িত্ব প্রথমে সচেতন হওয়া, যাতে বোনরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। যতক্ষণ ভাইদের মধ্যে এই বোধশক্তি তৈরি হবে না, ততক্ষণ আইনও একা সমস্যা সমাধান করতে পারবে না। এ ছাড়া, দীর্ঘসূত্রীর মামলার কারণে ভুক্তভোগীরা প্রায়ই হয়রানি ভোগ করেন এবং সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন।

মোহাম্মদপুর জামিয়া রহমানিয়া মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা কামরুল হাসান বলেন, ‘এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই পরিষ্কার। এখানে নারীকে তার ভাগ দিতেই হবে এটি স্পষ্ট করেই বলে হয়েছে। ইসলাম বলেছে, নারী যা অংশ পাবে তার দ্বিগুণ পাবে ভাই। নারী পাওয়াটাই এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নারীর এই ভাগ বা অংশ যদি কেউ না দেন, তবে তিনি খেয়ানতকারী হিসেবে গণ্য হবেন। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারী হিসেবেই গণ্য হবে। হাশরের ময়দানে যে বোন বা যাকে তার সম্পদ দিলো না সেই পাওনাদারকে তার আমলনামা তাকে দিয়ে তারপর পরিত্রাণ পেতে হবে। এ ছাড়া তার পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোন রাস্তা নেই।’ তিনি বলেন, ‘কারো কাছে ১০ হাজার টাকা ধার নিয়ে তা পরিশোধ করা যেমন জরুরি, বোন বা মেয়েদের সম্পত্তির ভাগ তাকে ফিরিয়ে দেওয়াও তেমনি জরুরি। এটা তার হক। তা থেকে কোনোভাবে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। যদি কেউ আত্মাসাৎ করে, তাহলে তিনি নিজে সরাসরি জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করলেন এবং এর জন্য অবশ্যই কেয়ামতের মাঠে তাকে শাস্তিভোগ করতে হবে। এই ধারণাটা যদি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং মানুষ যদি এটাকে ব্যাপক চর্চার মধ্যে নিয়ে আসে, তাহলে প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে। এ জন্য ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার।’

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ