খুলনা সংবাদদাতা : খুলনায় গত চার মাসে অন্তত ১১ খুনের ঘটনা ঘটেছে। সবশেষ গত শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অর্ণব কুমার সরকারকে (২৬) প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মহানগরের ব্যস্ততম কেডিএ এভিনিউ সড়কের তেঁতুলতলার মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। নিহত অর্ণব মহানগরের সোনাডাঙ্গার আবু আহমেদ রোড়ের বাসিন্দা নিতিশ চন্দ্র সরকারের ছেলে। অর্ণব তেঁতুলতলা মোড়ে একটি মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে চা পান করছিলেন। এ সময় ১০-১৫টি মোটরসাইকেলে সশস্ত্র লোকজন এসে প্রথমে তাকে গুলি করে। গুলি লাগার পর রাস্তার ওপর পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পার্শ্ববর্তী খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে খুলনায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মন্টু শেখ (৪৫) নামে বিএনপির এক কর্মীর দুই চোখ ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। দিঘলিয়া উপজেলার দক্ষিণ চন্দনীমহল মালোপাড়া নারদের দোকানের সামনে এ ঘটনা ঘটে। আহত মন্টুকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তিনি দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনীমহল কাঁটাবন এলাকার ইয়াদ শেখের ছেলে। একই দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সন্ত্রাসীর গুলিতে জিয়া প্রজন্ম দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইকরাম হাওলাদার আহত হন। রূপসা উপজেলার ১ নং আইচগাতি ইউনিয়নের ঠান্ডার বাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। আনুমানিক ২০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল তার বাড়ি ঘিরে ফেলে।
ঘরের দরজার কাছে গিয়ে সন্ত্রাসীরা হত্যার উদ্দেশ্যে তাকে গুলি করে। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাম পায়ে বিদ্ধ হয়। গুলির শব্দে এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। এদিকে ডাকাতদের ডাকাতির দু’টি মিশন ব্যর্থ করে দেয় পুলিশ। প্রথমে নগরের সোনাডাঙ্গা বাসটার্মিনাল এলাকায় একটি ব্যাটারির দোকানে এবং এটি ব্যর্থ হলে হরিণটানার একটি গরুর খামারে ডাকাতির পরিকল্পনা ছিল তাদের। এই দু’টি মিশন সফল করতে ১০/১২ জনের ডাকাতদল দু’টি পিকআপ প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু সোনাডাঙ্গা থানা পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয় এই চক্রের ২ সদস্য। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪টি রাম দা, ১টি কাটার, ১টি লোহার পাইপ, ২টি রডসহ একটি পিকআপ জব্দ করা হয়। আটক হওয়া ডাকাতদলের সদস্যরা হলেন, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফয়লা এলাকার বরকত উল্লাহর ছেলে ইয়াদ আলী (৩০) এবং বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জ উপজেলার চুলিগাতি এলাকার মৃত এ্যাকেন আলীর ছেলে শেখ সুমন ওরফে মিজান (৩৫)। এর আগে ২০ জানুয়ারি খুলনায় মানিক হাওলাদার (৩৫) নামের যুবদলের সাবেক নেতা দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। তিনি ২১ নং ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি ছিলেন।
মানিক পুরাতন রেলস্টেশন রোড রেলওয়ে মসজিদ এলাকায় মনছুর হাওলাদারের ছেলে। বেলা সাড়ে ১১টায় খুলনা মহানগরের পুরাতন রেলস্টেশন রোড রেলওয়ে মসজিদের পেছনে মানিককে ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। তাকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। ওই দিন সন্ধ্যায় মহানগরের কমার্স কলেজ মধ্য রোডে নওফেল নামে এক ছাত্রদল কর্মীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে রাত সাড়ে ৯টার দিকে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সজীব শিকদার (২৯) নামে এক যুবক গুরুতর আহত করা হয়। গত ১৮ জানুয়ারি রাত সোয়া ১০টার দিকে খুলনায় মুখোশধারী একদল সন্ত্রাসী শাহীন (৪০) নামে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। মহানগরের মিস্ত্রিপাড়া এলাকার রসুলবাগ মসজিদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। আহত যুবক ওই এলাকার জোনাব আলীর ছেলে।
এর আগে ৯ জানুয়ারি খুলনার চরমপন্থীদের পরিকল্পনায় কক্সবাজারে পরিকল্পিতভাবে খুন হন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) ৪ নং ওয়ার্ডের অপসারিত কাউন্সিলর গোলাম রব্বানি টিপু। খুলনায় সন্ত্রাসীর গুলিতে আকাশ নামে এক যুবক আহত হন শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে। মগনগরের মিয়াপাড়া বন্ধনের মোড়ে এই ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ আকাশ নগরের পূর্ব বানিয়াখামার চৌধুরী গলির মৃত হাফিজুল ইসলামের ছেলে। ১২ ডিসেম্বর রাত পৌনে ৮টার দিকে জিরোপয়েন্ট এলাকার মেসার্স সিকদার ফিলিং স্টেশনের সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে রেজা শেখ (৩৫) নামে এক যুবকের পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সন্ত্রাসীরা।
আহত রেজা শেখ লবণচরা থানাধীন কৃষ্ণনগর এলাকার সুলতান শেখের ছেলে। ৬ ডিসেম্বর বিকেলে রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইমরান হোসেন মানিক নামে এক যুবক আহত হন। ৩ ডিসেম্বর রাত ৮টার দিকে নিরালা এলাকায় ১০-১৫টি মোটরসাইকেলে এসে একদল সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে পথচারী ইউনুস শেখ গুলিবিদ্ধ হন। এরপর সন্ত্রাসীরা চানমারি এলাকায় গিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া ওই এলাকার আব্দুল আহাদ হাওলাদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে আহত করে। গত ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ডুমুরিয়া উপজেলার শরাফপুর বাজারে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সবজি বিক্রেতা নাঈম সানা গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে গত ২৯ নভেম্বর রাতে টুটপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
এরপর তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আমিন মোল্লা বোয়িংকে গুরুতর আহত করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। বসুপাড়া এলাকায় গত ৫ নভেম্বর রাতে অস্ত্রধারীরা রফিকুল ইসলাম মুক্তা নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। ২ নভেম্বর রাতে আলকাতরা মিল এলাকায় সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে পঙ্গু রাসেল নামে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করে। এ সময় সজীব ও ইয়াসিন নামে দুই যুবককে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা। একই রাতে নগরের বাবু খান রোডে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রহমান বেলালকে আহত করে।
গত ২৮ অক্টোবর দুপুরে সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দৌলতপুর থানার কালীবাড়ি বাজারের দত্ত জুয়েলার্সে ডাকাতি করে। তারা জুয়েলার্স থেকে স্বর্ণালংকার ও নগদ ২ লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। গত ২১ অক্টোবর রাতে কয়রা উপজেলার কাটাখালী গ্রামে পুলিশের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা অপহরণ মামলার আসামি হারুন গাজীকে ছিনিয়ে নেয়। তাদের হামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) এডিসি (মিডিয়া) মোহাম্মদ আহসান হাবীব বলেন, খুনের ঘটনার আসামিরা গ্রেপ্তার হচ্ছে। যারা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি তাদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।