ঢাকা ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ৪৫৫ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ

আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ৪৫৫ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ

  • আপডেট সময় : ০২:২৮:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অক্টোবর ২০২৩
  • ৬৮ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত ১১ বছরে অবৈধভাবে ৪৫৫ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন ছাড়াই ইচ্ছামতো শাখা খুলে এ নিয়োগ দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মানা হয়নি কোনো বিধি। যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অনেকের বৈধ নিবন্ধন সনদও নেই। কয়েকজনের নিবন্ধন সনদ থাকলেও তার মেয়াদ শেষ। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ কিনে এনে অনেকে বনে গেছেন নামি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার শিক্ষক। সংবাদংস্থা জাগো নিউজ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ওই নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ অবৈধ হওয়াদের মধ্যে মতিঝিল শাখার ৩৪৬ শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী আছেন। বনশ্রী শাখার ৫৫ শিক্ষক ও ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুগদা শাখার ১৫ শিক্ষক ও ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। অস্থায়ী ভিত্তিতে ছয়মাসের জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হলেও সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন তারা।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) অডিটে উঠে এসেছে শিক্ষক নিয়োগের এসব অনিয়মের তথ্য। অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি এ অডিট করে। অডিট প্রতিবেদনের কাজ শেষ হয় গত ১২ অক্টোবর। এরপর ১৬ অক্টোবর তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে পাঠানো হয়।
প্রতিবেদনে ৪০০ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল এবং এ পর্যন্ত তাদের তোলা বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। এছাড়া অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ ও আর্থিক অনিয়মের কারণে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এমপিও বাতিল, পরিচালনা কমিটির (গভর্নিং বডি) সভাপতির পদ শূন্য করাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
মূল শাখায় ৩৪৬ জনের নিয়োগ অবৈধ: অডিট প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শাখার জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫৯ জন শিক্ষক ও চারজন ল্যাব সহকারী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এরপর ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মে’র মধ্যে ১১১ শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তিতে থাকা শূন্যপদের চেয়েও অতিরিক্ত ৪২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ হলেও তারা সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন। নিয়োগের পর তাদের বেতন স্কেল ধরা হয় আট হাজার টাকা। অথচ প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের স্কেল হওয়ার কথা ছয় হাজার ৪০০ টাকা।
বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত পদে শিক্ষক এবং ল্যাব সহকারী নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের (ডিজি) কোনো প্রতিনিধিও রাখেনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি। এমনকি নিয়োগ বোর্ড গঠনের রেজ্যুলেশনও গোপন রাখা হয়। সম্পূর্ণ স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হলেও ১১ বছরেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। অথচ তারা চাকরি করে যাচ্ছেন।
অডিটে আরও উঠে এসেছে, ২০১১ সালের ১৪ মে রেজ্যুলেশন অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের কারও কারও নিবন্ধন সনদ ছিল না। কারও আবার নিবন্ধন সনদের মেয়াদোত্তীর্ণ। কিন্তু তাদের নাম বা তথ্য রাখা হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য অ্যাডহক কমিটি থাকাকালে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে অ্যাডহক কমিটি থাকাকালে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এরপর ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ ১৪২ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে নিয়োগ কমিটি না করে করা হয় উপকমিটি। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের নিবন্ধন বা ইনডেক্স নম্বর লেখা ছিল না। ফলে এ নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। এছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৮৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অডিট প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মূল শাখায় ৩৪৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর এ নিয়োগ কোনোভাবেই বিধিসম্মত হয়নি। ফলে ২০১১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে তারা যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন, তা সরকারি কোষাগারে জমা নেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা।
বনশ্রী শাখায় ৭০ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ: ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখায় ৫৫ শিক্ষক ও ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবরের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিলে তা অবৈধ বিবেচিত হবে। মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা না মেনে এই ৬৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া ২০১৪ সালে বনশ্রী শাখার বাংলা ভার্সনে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার নিয়োগের ক্ষেত্রে বোর্ডে মাউশির কোনো প্রতিনিধি ছিল না। তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষকও নন। ফলে তার নিয়োগও বৈধ নয় এবং বাতিলযোগ্য বিবেচিত বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এজন্য ২০১৪ সালের ১১ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তিনি যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন, তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
অবৈধভাবে মুগদা শাখায় ৩৯ জনকে নিয়োগ: আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা শাখায়ও ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে ৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবরের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানা হয়নি। ফলে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তারা যে বেতন-ভাতা তুলেছেন, তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে ২০২১ সালের ২ মে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেওয়া রফিকুল ইসলামের নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। তার নিয়োগ বোর্ডে মাউশির প্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষকও নন। নিয়োগের তারিখ থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ তার তোলা তিন লাখ ২২ টাকা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ফেরত নেওয়া এবং তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
বৈধ সনদ নেই অনেকের, অডিট টিমকে দেখাননি ১৪ জন: মুগদা শাখার কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক আরিফ উর রহমান। ২০০৯ সালে তিনি মাইক্রোসফট সার্টিফিকেট অব এক্সিলেন্স থেকে সনদ নেন। সেই সনদ দেখিয়ে হন সহকারী শিক্ষক। অথচ যে প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সনদ নিয়েছেন তা অনুমোদিত নয়। ফলে তার নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। অথচ তিনি ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে অবৈধ সনদে চাকরি করছেন। তার মতো আরও ১১ জন কম্পিউটার শিক্ষা ও শরীর চর্চা বিষয়ের শিক্ষক ভুয়া সনদে চাকরি করছেন। অডিট টিমের সদস্যদের সনদ দেখাতে পারেননি আরও ১৪ শিক্ষক। এছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ছালাম খান অবৈধ বিএড সনদ জমা দিয়ে চাকরি নেন। অনুমোদনহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রির সনদ দেখিয়ে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন আরও ৪৩ জন শিক্ষক।
২০০৮ সালের ১৫ মে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের টিচার্স ট্রেনিং (টিটি) কলেজ থেকে বিএড সনদ অর্জনে বাধ্যবাধকতা করা হয়। অথচ এই ৪৩ জন শিক্ষক প্রজ্ঞাপন জারির পরও অনুমোদনহীন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দিয়ে চাকরিতে বহাল রয়েছেন।
যা বলছে মন্ত্রণালয় ও আইডিয়াল কর্তৃপক্ষ: জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব সোলেমান খান বলেন, অডিট প্রতিবেদন এসেছে। এখনো দেখা হয়নি। প্রতিবেদন দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, আমরা অডিটের কাজটা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছি। এটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমরা যেসব সুপারিশ করেছি, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে পরে ওই প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এমন অনিয়ম করার সাহস পাবে না। অধিদপ্তরের অডিট প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। চলতি বছরের ২০ আগস্ট থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। মিজানুর রহমান বলেন, যে সময়ে নিয়োগগুলো হয়েছে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। কিছুদিন আগে আমাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি রুটিনকাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কবে কী অনিয়ম হয়েছে, তা বলতে পারবো না। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, অডিট হয়েছিল তা জানি। তবে প্রতিবেদন কবে হয়েছে, কবে জমা হয়েছে, সেখানে কী আছে, সেসবের কিছুই আমরা জানি না। মন্ত্রণালয় বা মাউশি থেকে আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠালে বা জবাব চাইলে তখন গভর্নিং বডির মিটিং ডাকা হবে। সেখানে করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

‘ক্ষমতায় থাকতে’ ইউনূস মৌলবাদীদের ‘একখানে করেছেন’: গয়েশ্বর

আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ৪৫৫ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ

আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ৪৫৫ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ অবৈধ

আপডেট সময় : ০২:২৮:৫৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ অক্টোবর ২০২৩

প্রত্যাশা ডেস্ক : রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত ১১ বছরে অবৈধভাবে ৪৫৫ শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন ছাড়াই ইচ্ছামতো শাখা খুলে এ নিয়োগ দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মানা হয়নি কোনো বিধি। যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অনেকের বৈধ নিবন্ধন সনদও নেই। কয়েকজনের নিবন্ধন সনদ থাকলেও তার মেয়াদ শেষ। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ কিনে এনে অনেকে বনে গেছেন নামি এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার শিক্ষক। সংবাদংস্থা জাগো নিউজ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ওই নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ অবৈধ হওয়াদের মধ্যে মতিঝিল শাখার ৩৪৬ শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী আছেন। বনশ্রী শাখার ৫৫ শিক্ষক ও ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুগদা শাখার ১৫ শিক্ষক ও ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। অস্থায়ী ভিত্তিতে ছয়মাসের জন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হলেও সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন তারা।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) অডিটে উঠে এসেছে শিক্ষক নিয়োগের এসব অনিয়মের তথ্য। অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি এ অডিট করে। অডিট প্রতিবেদনের কাজ শেষ হয় গত ১২ অক্টোবর। এরপর ১৬ অক্টোবর তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে পাঠানো হয়।
প্রতিবেদনে ৪০০ শিক্ষক-কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল এবং এ পর্যন্ত তাদের তোলা বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়। এছাড়া অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ ও আর্থিক অনিয়মের কারণে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের এমপিও বাতিল, পরিচালনা কমিটির (গভর্নিং বডি) সভাপতির পদ শূন্য করাসহ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
মূল শাখায় ৩৪৬ জনের নিয়োগ অবৈধ: অডিট প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন শাখার জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫৯ জন শিক্ষক ও চারজন ল্যাব সহকারী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এরপর ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ মে’র মধ্যে ১১১ শিক্ষক ও একজন ল্যাব সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিজ্ঞপ্তিতে থাকা শূন্যপদের চেয়েও অতিরিক্ত ৪২ জন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ হলেও তারা সরকারি বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন। নিয়োগের পর তাদের বেতন স্কেল ধরা হয় আট হাজার টাকা। অথচ প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকদের স্কেল হওয়ার কথা ছয় হাজার ৪০০ টাকা।
বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত পদে শিক্ষক এবং ল্যাব সহকারী নিয়োগে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের (ডিজি) কোনো প্রতিনিধিও রাখেনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি। এমনকি নিয়োগ বোর্ড গঠনের রেজ্যুলেশনও গোপন রাখা হয়। সম্পূর্ণ স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হলেও ১১ বছরেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। অথচ তারা চাকরি করে যাচ্ছেন।
অডিটে আরও উঠে এসেছে, ২০১১ সালের ১৪ মে রেজ্যুলেশন অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্তদের কারও কারও নিবন্ধন সনদ ছিল না। কারও আবার নিবন্ধন সনদের মেয়াদোত্তীর্ণ। কিন্তু তাদের নাম বা তথ্য রাখা হয়নি। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার জন্য অ্যাডহক কমিটি থাকাকালে। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে অ্যাডহক কমিটি থাকাকালে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এরপর ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ ১৪২ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে নিয়োগ কমিটি না করে করা হয় উপকমিটি। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের নিবন্ধন বা ইনডেক্স নম্বর লেখা ছিল না। ফলে এ নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। এছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ৮৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। অডিট প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মূল শাখায় ৩৪৬ জন শিক্ষক-কর্মচারীর এ নিয়োগ কোনোভাবেই বিধিসম্মত হয়নি। ফলে ২০১১ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে তারা যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন, তা সরকারি কোষাগারে জমা নেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা।
বনশ্রী শাখায় ৭০ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ: ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখায় ৫৫ শিক্ষক ও ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবরের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিলে তা অবৈধ বিবেচিত হবে। মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা না মেনে এই ৬৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া ২০১৪ সালে বনশ্রী শাখার বাংলা ভার্সনে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে মোয়াজ্জেম হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার নিয়োগের ক্ষেত্রে বোর্ডে মাউশির কোনো প্রতিনিধি ছিল না। তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষকও নন। ফলে তার নিয়োগও বৈধ নয় এবং বাতিলযোগ্য বিবেচিত বলে অডিট প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এজন্য ২০১৪ সালের ১১ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তিনি যে বেতন-ভাতা নিয়েছেন, তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।
অবৈধভাবে মুগদা শাখায় ৩৯ জনকে নিয়োগ: আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা শাখায়ও ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২১ সালে ৩৮ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবরের পর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানা হয়নি। ফলে গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তারা যে বেতন-ভাতা তুলেছেন, তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে ২০২১ সালের ২ মে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেওয়া রফিকুল ইসলামের নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। তার নিয়োগ বোর্ডে মাউশির প্রতিনিধি ছিলেন না। তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষকও নন। নিয়োগের তারিখ থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ তার তোলা তিন লাখ ২২ টাকা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে ফেরত নেওয়া এবং তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
বৈধ সনদ নেই অনেকের, অডিট টিমকে দেখাননি ১৪ জন: মুগদা শাখার কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক আরিফ উর রহমান। ২০০৯ সালে তিনি মাইক্রোসফট সার্টিফিকেট অব এক্সিলেন্স থেকে সনদ নেন। সেই সনদ দেখিয়ে হন সহকারী শিক্ষক। অথচ যে প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি সনদ নিয়েছেন তা অনুমোদিত নয়। ফলে তার নিয়োগও বিধিসম্মত হয়নি। অথচ তিনি ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে অবৈধ সনদে চাকরি করছেন। তার মতো আরও ১১ জন কম্পিউটার শিক্ষা ও শরীর চর্চা বিষয়ের শিক্ষক ভুয়া সনদে চাকরি করছেন। অডিট টিমের সদস্যদের সনদ দেখাতে পারেননি আরও ১৪ শিক্ষক। এছাড়া সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. ছালাম খান অবৈধ বিএড সনদ জমা দিয়ে চাকরি নেন। অনুমোদনহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রির সনদ দেখিয়ে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন আরও ৪৩ জন শিক্ষক।
২০০৮ সালের ১৫ মে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের টিচার্স ট্রেনিং (টিটি) কলেজ থেকে বিএড সনদ অর্জনে বাধ্যবাধকতা করা হয়। অথচ এই ৪৩ জন শিক্ষক প্রজ্ঞাপন জারির পরও অনুমোদনহীন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ দিয়ে চাকরিতে বহাল রয়েছেন।
যা বলছে মন্ত্রণালয় ও আইডিয়াল কর্তৃপক্ষ: জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব সোলেমান খান বলেন, অডিট প্রতিবেদন এসেছে। এখনো দেখা হয়নি। প্রতিবেদন দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে মন্ত্রণালয়।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, আমরা অডিটের কাজটা সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছি। এটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমরা যেসব সুপারিশ করেছি, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে পরে ওই প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এমন অনিয়ম করার সাহস পাবে না। অধিদপ্তরের অডিট প্রতিবেদন প্রসঙ্গে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। চলতি বছরের ২০ আগস্ট থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। মিজানুর রহমান বলেন, যে সময়ে নিয়োগগুলো হয়েছে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। কিছুদিন আগে আমাকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমি রুটিনকাজ চালিয়ে নিচ্ছি। কবে কী অনিয়ম হয়েছে, তা বলতে পারবো না। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বলেন, অডিট হয়েছিল তা জানি। তবে প্রতিবেদন কবে হয়েছে, কবে জমা হয়েছে, সেখানে কী আছে, সেসবের কিছুই আমরা জানি না। মন্ত্রণালয় বা মাউশি থেকে আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠালে বা জবাব চাইলে তখন গভর্নিং বডির মিটিং ডাকা হবে। সেখানে করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।