ঢাকা ১০:৩৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

আইএমএফের ঋণছাড়: পরের পথটা অনেক জটিল

  • আপডেট সময় : ০৭:১৬:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫
  • ১ বার পড়া হয়েছে

ড. সেলিম জাহান

শেষ পর্যন্ত অচল অবস্থাটি কাটল- বাংলাদেশ টাকার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক নমনীয় হারের ওপরে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে দেয় মোট ৪৭০ কোটি ডলারের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলারের অবমুক্তি অনুমোদন করেছে। দুই পক্ষের মতানৈক্যের মূল জায়গাটি ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার। আইএমএফ বারবার জোর দিচ্ছিল- বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এ সুপারিশের বিরোধিতা করছিল। এখন যখন বাংলাদেশ আইএমএফের সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়েছে, তখন সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে।

বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের চালচিত্রটি বেশ জটিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি পর্যবেক্ষণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা বেশ কয়েক মাস ধরেই চলছিল। গত মাসে আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় এসেছিল। তার সূত্র ধরেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন সভার সময়ে গত মাসে বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও আইএমএফের মিশন ওয়াশিংটনে আলোচনা অব্যাহত রাখে। কিন্তু অচলাবস্থা কাটেনি। একটি মতৈক্যে তখনই পৌঁছানো গেছে, যখন তার মুদ্রার হারকে নমনীয় করতে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বিনিময় হারের নমনীয়তার বিষয়টি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির একটিমাত্র শর্ত। আইএমএফের সুপারিশকৃত অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে রয়েছে করনীতি, কর প্রশাসনের সংস্কারসহ পুরো করকাঠামোর সংস্কার, আর্থিক খাতের আইনগত ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামোর সংস্কার, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ের মধ্যে আইএমএফ ও বাংলাদেশের মধ্যে মতভেদের মূল জায়গা ছিল টাকার বিনিময় হারের বিষয়টি।

তৃতীয়ত, কিছু কিছু সংস্কার বাংলাদেশের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। তাই আইএমএফের শর্ত বা চাপনির্বিশেষে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এগুলো যতই বিরাগজনক হোক না কেন, বাংলাদেশকে এসব সংস্কার করতেই হবে। সংস্কারকাজটিই বড় কঠিন।

আইএমএফের ঋণ ও এর শর্তাবলি কোনো আবেগের বিষয় নয়; এগুলো অত্যন্ত বাস্তববাদী প্রায়োগিক বিষয়। তবু কখনো কখনো এসব বিষয়ে নানা রকমের আবেগপ্রবণ মন্তব্য আমরা করেছি। এটা বোধগম্য, বিষয়গুলো যখন অনিশ্চিত থাকে এবং সময়টা যখন নাজুক, তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ঘটনাপ্রবাহকে শান্ত করতে আমাদের আবেগপ্রবণ কথা বলতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বিবেচনা করে দেয় অবস্থাটাকে আমাদের বস্তুনিষ্ঠভাবে বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করতে হয়। তাই ঋণের কিস্তির বিষয়টিকে সরিয়ে রেখে আমরা যদি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইএমএফের ঋণের বিষয়টি বিবেচনা করি, তাহলে বাংলাদেশকে দেয় আইএমএফের ঋণ ন্যূনতমপক্ষে তিনটি বিচারে বিবেচনাযোগ্য-

এক. এটা সত্য, আইএমএফের দেয় ঋণ পরিমাণের দিক থেকে এতা বড় নয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বিষয়ে একটি সম্মানজনক অবস্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থপ্রবাহের একটি স্থিতিশীল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ে বেশ কিছু অন্তরায় ও নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে। এসব অন্তরায় ও নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, উৎপাদনের ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্মহীনতা, দুর্বল ব্যাংকিং খাত ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলোর কোনো কোনোটিকে মোকাবেলা করার জন্য আইএমএফের ঋণ সহায়ক হতে পারে।

দুই. বাংলাদেশের বর্তমান সম্পদসংকট সবার জানা আছে। বলা হচ্ছে, দেশের আগামী বাজেটকে অনেক ছোট করতে হবে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিকে ছেঁটে দেওয়া হবে, দেশের সুদ পরিশোধের পরিমাণ হবে অনেক। একই সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে যে ৫০০ কোটি ডলারের সম্পদ-সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, তার জবাব এখনো মেলেনি। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের সম্পদের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করতে পারে।

তিন. আইএমএফের ঋণের পরিমাণ নয়; বরং তারা বাংলাদেশকে দেয় ঋণপ্রবাহের স্থগিত অবস্থাকে তুলে নিয়ে যে ছাড় দিয়েছে, এর একটি প্রতীকী ও অনুঘটকীয় ভূমিকা আছে। আইএমএফের অনুমোদন অন্যান্য বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে ও নতুন করে ঋণের বিষয়ে আলোচনা চালাতে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ-সমঝোতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহ বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আইএমএফের আস্থার কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি সম্প্রসারিত ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অন্যান্য সংস্কারের জন্য একটি গতিময়তাও সৃষ্টি করতে পারে।

এসব বলার পরও এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিভিন্ন কারণে আইএমএফের ঋণ ও শর্তাবলির ব্যাপারে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন- নমনীয় বিনিময় হার বজায় রাখার ক্ষমতা এবং বাংলাদেশ অর্থনীতির নানা খাত ও মানুষের কল্যাণের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলোর যথাযথ একটি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ও সম্ভাব্য অর্থপ্রবাহের প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে নমনীয় বিনিময় হারের কারণে মুদ্রাবাজারে যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে, তাকে সামাল দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত আর কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

প্রথমত, এটা অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচায়ক যে একটি স্থিতিশীলতা তহবিল প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আইএমএফের কাছে ১০০ কোটি ডলার সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছে। এটা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে এই আলোচনাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অখণ্ড মনোযোগ শুধু টাকার বিনিময় হারের ওপরে নিবদ্ধ থাকলে চলবে না; অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোও শুরু করতে হবে, তা সেগুলো আইএমএফের সুপারিশকৃত সংস্কার মোর্চার অন্তর্ভুক্ত হোক বা না হোক। যেমন কর প্রশাসন সংস্কারের অংশ হিসেবে বর্তমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিলুপ্তি ঘটবে এবং তার পরিবর্তে দুটি নতুন আলাদা প্রতিষ্ঠান প্রতিস্থাপিত হবে- একটি করনীতির জন্য এবং অন্যটি কর প্রশাসনের জন্য। আসলে ওই সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বব্যাংক কয়েক দিন আগে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা প্রদানে সম্মত হয়েছে। সম্পদ আহরণের জন্য কর ও জাতীয় আয় অনুপাত উন্নীত করার লক্ষ্যে করব্যবস্থায় সাম্য নিশ্চিত করার জন্য, অপ্রত্যক্ষ করের ওপরে নির্ভরতা হ্রাস করে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দেওয়ার জন্য আরো সংস্কার প্রয়োজন বাংলাদেশে। ঠিক তেমনিভাবেই ব্যাংকিং খাতের সংস্কারকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তৃতীয়ত, আইএমএফের ঋণের ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের জন্য এটি জটিল ভারসাম্যের সমস্যা। একদিকে সরকারের কর্মকাণ্ডে এটা যাতে মনে না হয় যে, সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে নতি স্বীকার করছে- যে ধারণা সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হবে। অন্যদিকে প্রাপ্ত ঋণ এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয় এবং মানুষের কুশল নিশ্চিত করা যায়।

এ ভারসাম্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইএমএফের শর্ত পূরণ যেন মানুষের কুশলের সঙ্গে আপস করে না হয়। সোজা কথায় মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করে যেন বাজেটের ভারসাম্য রক্ষিত না হয়। অতীতে আশির দশকে আইএমএফের ‘কাঠামোগত সাযুজ্য সুবিধা’ কর্মসূচি কিংবা নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংকের ‘দারিদ্র্য হ্রাস কৌশলগত পত্রের’ বাস্তবায়নের কালে এ কাজ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে বারবার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বাঞ্ছনীয় নয়।

লেখক: জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

‘ক্ষমতায় থাকতে’ ইউনূস মৌলবাদীদের ‘একখানে করেছেন’: গয়েশ্বর

আইএমএফের ঋণছাড়: পরের পথটা অনেক জটিল

আপডেট সময় : ০৭:১৬:৩৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

ড. সেলিম জাহান

শেষ পর্যন্ত অচল অবস্থাটি কাটল- বাংলাদেশ টাকার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক নমনীয় হারের ওপরে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে দেয় মোট ৪৭০ কোটি ডলারের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির ১৩০ কোটি ডলারের অবমুক্তি অনুমোদন করেছে। দুই পক্ষের মতানৈক্যের মূল জায়গাটি ছিল বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হার। আইএমএফ বারবার জোর দিচ্ছিল- বাংলাদেশকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এ সুপারিশের বিরোধিতা করছিল। এখন যখন বাংলাদেশ আইএমএফের সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়েছে, তখন সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে।

বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের চালচিত্রটি বেশ জটিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি পর্যবেক্ষণ বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা বেশ কয়েক মাস ধরেই চলছিল। গত মাসে আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় এসেছিল। তার সূত্র ধরেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন সভার সময়ে গত মাসে বাংলাদেশি কর্মকর্তা ও আইএমএফের মিশন ওয়াশিংটনে আলোচনা অব্যাহত রাখে। কিন্তু অচলাবস্থা কাটেনি। একটি মতৈক্যে তখনই পৌঁছানো গেছে, যখন তার মুদ্রার হারকে নমনীয় করতে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বিনিময় হারের নমনীয়তার বিষয়টি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির একটিমাত্র শর্ত। আইএমএফের সুপারিশকৃত অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে রয়েছে করনীতি, কর প্রশাসনের সংস্কারসহ পুরো করকাঠামোর সংস্কার, আর্থিক খাতের আইনগত ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামোর সংস্কার, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ের মধ্যে আইএমএফ ও বাংলাদেশের মধ্যে মতভেদের মূল জায়গা ছিল টাকার বিনিময় হারের বিষয়টি।

তৃতীয়ত, কিছু কিছু সংস্কার বাংলাদেশের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। তাই আইএমএফের শর্ত বা চাপনির্বিশেষে এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এগুলো যতই বিরাগজনক হোক না কেন, বাংলাদেশকে এসব সংস্কার করতেই হবে। সংস্কারকাজটিই বড় কঠিন।

আইএমএফের ঋণ ও এর শর্তাবলি কোনো আবেগের বিষয় নয়; এগুলো অত্যন্ত বাস্তববাদী প্রায়োগিক বিষয়। তবু কখনো কখনো এসব বিষয়ে নানা রকমের আবেগপ্রবণ মন্তব্য আমরা করেছি। এটা বোধগম্য, বিষয়গুলো যখন অনিশ্চিত থাকে এবং সময়টা যখন নাজুক, তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ঘটনাপ্রবাহকে শান্ত করতে আমাদের আবেগপ্রবণ কথা বলতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বিবেচনা করে দেয় অবস্থাটাকে আমাদের বস্তুনিষ্ঠভাবে বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করতে হয়। তাই ঋণের কিস্তির বিষয়টিকে সরিয়ে রেখে আমরা যদি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইএমএফের ঋণের বিষয়টি বিবেচনা করি, তাহলে বাংলাদেশকে দেয় আইএমএফের ঋণ ন্যূনতমপক্ষে তিনটি বিচারে বিবেচনাযোগ্য-

এক. এটা সত্য, আইএমএফের দেয় ঋণ পরিমাণের দিক থেকে এতা বড় নয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বিষয়ে একটি সম্মানজনক অবস্থান এবং মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থপ্রবাহের একটি স্থিতিশীল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমান সময়ে বেশ কিছু অন্তরায় ও নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে। এসব অন্তরায় ও নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি, উৎপাদনের ধীরগতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্মহীনতা, দুর্বল ব্যাংকিং খাত ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলোর কোনো কোনোটিকে মোকাবেলা করার জন্য আইএমএফের ঋণ সহায়ক হতে পারে।

দুই. বাংলাদেশের বর্তমান সম্পদসংকট সবার জানা আছে। বলা হচ্ছে, দেশের আগামী বাজেটকে অনেক ছোট করতে হবে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিকে ছেঁটে দেওয়া হবে, দেশের সুদ পরিশোধের পরিমাণ হবে অনেক। একই সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে যে ৫০০ কোটি ডলারের সম্পদ-সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, তার জবাব এখনো মেলেনি। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের সম্পদের চাহিদা মেটাতে সাহায্য করতে পারে।

তিন. আইএমএফের ঋণের পরিমাণ নয়; বরং তারা বাংলাদেশকে দেয় ঋণপ্রবাহের স্থগিত অবস্থাকে তুলে নিয়ে যে ছাড় দিয়েছে, এর একটি প্রতীকী ও অনুঘটকীয় ভূমিকা আছে। আইএমএফের অনুমোদন অন্যান্য বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে ও নতুন করে ঋণের বিষয়ে আলোচনা চালাতে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ-সমঝোতার কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। ফলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগপ্রবাহ বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আইএমএফের আস্থার কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি সম্প্রসারিত ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আইএমএফের ঋণপ্রাপ্তি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অন্যান্য সংস্কারের জন্য একটি গতিময়তাও সৃষ্টি করতে পারে।

এসব বলার পরও এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিভিন্ন কারণে আইএমএফের ঋণ ও শর্তাবলির ব্যাপারে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন- নমনীয় বিনিময় হার বজায় রাখার ক্ষমতা এবং বাংলাদেশ অর্থনীতির নানা খাত ও মানুষের কল্যাণের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলোর যথাযথ একটি মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ও সম্ভাব্য অর্থপ্রবাহের প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে নমনীয় বিনিময় হারের কারণে মুদ্রাবাজারে যে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে, তাকে সামাল দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত আর কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?

প্রথমত, এটা অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচায়ক যে একটি স্থিতিশীলতা তহবিল প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশ ইতিমধ্যে আইএমএফের কাছে ১০০ কোটি ডলার সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছে। এটা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে এই আলোচনাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অখণ্ড মনোযোগ শুধু টাকার বিনিময় হারের ওপরে নিবদ্ধ থাকলে চলবে না; অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোও শুরু করতে হবে, তা সেগুলো আইএমএফের সুপারিশকৃত সংস্কার মোর্চার অন্তর্ভুক্ত হোক বা না হোক। যেমন কর প্রশাসন সংস্কারের অংশ হিসেবে বর্তমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিলুপ্তি ঘটবে এবং তার পরিবর্তে দুটি নতুন আলাদা প্রতিষ্ঠান প্রতিস্থাপিত হবে- একটি করনীতির জন্য এবং অন্যটি কর প্রশাসনের জন্য। আসলে ওই সংস্কারের পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বব্যাংক কয়েক দিন আগে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা প্রদানে সম্মত হয়েছে। সম্পদ আহরণের জন্য কর ও জাতীয় আয় অনুপাত উন্নীত করার লক্ষ্যে করব্যবস্থায় সাম্য নিশ্চিত করার জন্য, অপ্রত্যক্ষ করের ওপরে নির্ভরতা হ্রাস করে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দেওয়ার জন্য আরো সংস্কার প্রয়োজন বাংলাদেশে। ঠিক তেমনিভাবেই ব্যাংকিং খাতের সংস্কারকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তৃতীয়ত, আইএমএফের ঋণের ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের জন্য এটি জটিল ভারসাম্যের সমস্যা। একদিকে সরকারের কর্মকাণ্ডে এটা যাতে মনে না হয় যে, সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে নতি স্বীকার করছে- যে ধারণা সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হবে। অন্যদিকে প্রাপ্ত ঋণ এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয় এবং মানুষের কুশল নিশ্চিত করা যায়।

এ ভারসাম্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আইএমএফের শর্ত পূরণ যেন মানুষের কুশলের সঙ্গে আপস করে না হয়। সোজা কথায় মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করে যেন বাজেটের ভারসাম্য রক্ষিত না হয়। অতীতে আশির দশকে আইএমএফের ‘কাঠামোগত সাযুজ্য সুবিধা’ কর্মসূচি কিংবা নব্বইয়ের দশকে বিশ্বব্যাংকের ‘দারিদ্র্য হ্রাস কৌশলগত পত্রের’ বাস্তবায়নের কালে এ কাজ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে বারবার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বাঞ্ছনীয় নয়।

লেখক: জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ