মোহাম্মদ জুবায়ের : লোকজন দৌড়াচ্ছে হন্তদন্ত হয়ে। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে সবাই দৌড়াচ্ছে। জীবনের অনেক স্বপ্ন-চাওয়া পূরণ করতে না পারা এই মানুষগুলোর লক্ষ্য একটাই-ধরতে হবে টিসিবির ট্রাক। এই দৃশ্য দেখে আবার কিছু লোক হাসছেনও। হাসতে-হাসতে চোয়াল কষে আসছে, তবু তারা হাসছেন! পৃথিবীর কোনো রেসের ট্র্যাকে নারী-পুরুষ, বুড়ো-গুড়োদের এমন সম্মিলিত দৌড় দেখা যায় না যে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই লোকগুলো কেন হাসছে? নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিতদের আর্তনাদ-ছোটাছুটি দর্শনে হাসির খোরাক কোথায়? এর উত্তরও আছে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘একটি তুলসী গাছের আত্মকাহিনী’ গল্পে ‘অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা’। এই নেশার ঘোরে বুঁদ হয়ে আছে বঙ্গরাষ্ট্র। তাই এই ‘বঞ্চিত-অপমানিত’দের ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি দেখে অনেকে মজা পায়; তাই হাসে।
বেশ ভাইরাল হয়েছে ভিডিওটি। টিসিবির ট্রাকটি ছুটছে, তার পেছনে প্রাণপণ ছুটছে মানুষ। কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে, কেউ পথে লুটিয়ে পড়া আচঁল টানতে-টানতে, কেউ ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গির গিট আঁটতে-আঁটতে। প্যান্ট-শার্ট-জুতো পরে কেতাদুরস্ত সেজে দৌড়ানো যায় না, কিন্তু ক্ষুধার দৌড়ানিতে তারাও দৌড়াচ্ছে। ট্রাকের গিয়ারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের দৌড়ের গিয়ারও বাড়ে। ফার্স্ট হওয়া চাই, নইলে হাতছাড়া হয়ে যাবে পুরস্কার।
কী ‘পুরস্কার’ থাকে এই টিসিবির ট্রাকে? যার জন্য ট্রাকের পেছনে লেখা ‘নিরাপদ দুরত্বে থাকুন’, ‘৫০-১০০ গজ দূরে থাকুন’- জীবন রক্ষাকারী এমন বার্তার তোয়াক্কাও করছে না মানুষ। দৌড়াচ্ছে, পেছনের ডালা ধরে ঝুলছে। ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে এসে লাইনে টানা দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া হাতটি গলে একসময় বেরিয়ে যায় ট্রাকটি। এই ট্রাকে থাকে চাল। সবাই জানে এক টাকায় আট মণ চালের সেই শায়েস্তা খাঁর আমল নেই। চালের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কৃষক ধানের দাম ঠিকঠাক পাক বা না পাক, চালের বেপারির পোয়া বারো। বেপারিদের এই ‘বারো’ সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় ঠেকবে কে জানে? এক কেজি নাজির শাহ চাল ৭৭ টাকা। মোটা চাল ৪৪ টাকা কেজি। প্রায়ই দুর্গন্ধময় ডাস্টবিন ঘেঁষে দাঁড়ানো টিসিবির ট্রাকের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে থাকাদের কাছে সুগন্ধী চালের দাম বলা বোধহয় তাদেরকে আরও একবার অপমানিত করা। তাই ও প্রসঙ্গ বাদ।
চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল- এসবের সঙ্গে থাকে আরেক মহার্ঘ্য, যার নাম তেল। পণ্যের দাম বাড়াতে অসাধু ব্যবসায়ী, মধ্যসত্ত্বভোগীদের যে তেল খরচ হয়, যোগ্যদের টপকে অযোগ্যদের উপরে উঠতে যে ‘তেল মারতে’ হয়, এ তেল সেই তেল নয়, এ ভোজ্যতেল। যার দাম ইদানিং বাড়ছে উসাইন বোল্টের দৌড়ের গতিতে। ভুখা-নাঙ্গা মানুষ সে দৌড়ের সঙ্গে পেরে উঠবে কিভাবে? বোতলজাত এক লিটার তেলের দাম সবশেষ আরও ৮ টাকা বৃদ্ধির পর দাঁড়িয়েছে ১৬৮ টাকা। সব মিলিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন। নি¤œ ও মধ্য আয়ের মানুষের দৌড়াদৌড়িও লাগামহীন। এগুলো নিয়ে কথা হয়। লেখালেখি হয়। একটু-আধটু প্রতিবাদও হয়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না মোটেও। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’- এইভাবে থেকে যায় সবকিছু। তাই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অনায়াসে বলে দিতে পারেন, “ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদেরও এখন টিসিবির লাইনে দেখা যাচ্ছে।” কিন্তু ‘ভালো মন’ নিয়ে কি কেউ ওই লাইনে দাঁড়াচ্ছে?
মনে পড়ছে, চেকে ‘ডিসেম্বর’ বানান বাংলায় লিখেছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এই ‘অপরাধে’ তা ফেরত পাঠিয়েছিল একটি ব্যাংক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি লিখেছিলেন, “মন চাইছে আত্মহত্যা করি। একটি চেকে আমি ডিসেম্বর বাংলায় লিখেছি বলে কাউন্টার থেকে চেকটি ফেরত দিয়েছে। কোন দেশে আছি?’। ভাষার প্রতি অবজ্ঞা মন্ত্রী মেনে নিতে পারেননি; আমরাও পারি না। অথচ ট্রাকের পেছনে ছোটা ‘মানুষগুলোকে’ দেখে মনে হয় জীবনের প্রতি অবজ্ঞা তারা সয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে ছুটছে। আমরাও সয়ে যাচ্ছি এবং শুধু দেখছি; কেউ কেউ হাসছি।
অথচ ট্রাকের পিছে হন্তদন্ত হয়ে ছোটা এই মানুষগুলোর পূর্বসূরিরাই ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১-এ ছুটেছে রাজপথে, রণাঙ্গণে। আদায় করে নিয়েছে অধিকার। অধিকারবঞ্চিদের প্রতি তাই আমাদের ভাবুক বন্ধু ভ্যাবলা বিশেষ দরদ অনুভব করে না। বরং চাল-ডালের জন্য দৌড়াদৌড়ির ভিডিও দেখে সে আজ বিশ্রীভাবে হাসছে! হাসির কারণ জানতে চাইলে শিক্ষার শুরুর ‘গলদ’ টেনে বলল, “অ-তে অজগর, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে-এগুলো না, আসলে হবে অ-তে অধিকার, আ-তে আদায়। বুঝলে?”
লেখক : কলামিস্ট
অ-তে অধিকার, আ-তে আদায়
ট্যাগস :
অ-তে অধিকার
জনপ্রিয় সংবাদ