ডা. হারুন অর রশিদ জুয়েল
আমাদের অনেকেরই ধারণা, আমরা যখন অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ অসম্পূর্ণ রাখি (১০ দিনের কোর্স শেষ না করে ৫ দিন খেয়ে বাদ দেই), তখন শরীরে বেঁচে যাওয়া প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়াগুলো এই অ্যান্টিবায়োটিককে চিনে রাখে এবং এই অ্যান্টিবায়োটিক থেকে রক্ষার কৌশল (ডিফেন্স মেকানিজম ডেভেলপ) গড়ে তোলে। ফলে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। একই অ্যান্টিবায়োটিকে আর পরবর্তীকালে কাজ হয় না।
না, এটা ঠিক এভাবে হয় না। তাহলে? আসলে একটা অরগানিজম কিভাবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্ট হয়? আলোচনার সুবিধার্থে শুধু ‘ব্যাকটেরিয়া’ ও ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ নিয়ে কথা বলবো।
ব্যাকটেরিয়া খুব কম সময়ে বংশবৃদ্ধি (রিপ্রোডিউস) করে। মানে তাদের কোষ বিভাজন (সেল ডিভিশন) খুব দ্রুত হয়। অনেক অনেক পরিমাণে হয়। খুব সামান্য সময়ের মধ্যে মিলিয়ন, বিলিয়ন পরিমাণ হয়ে যায়। এখন এই যে এত পরিমাণ সেল ডিভিশন, এত এত ডিএনএ রেপ্লিকেশন হয়, এতে তো কিছু ভুল হয়েই যায়। মানে, কিছু মিউটেশন হয়ে যায়। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রাকৃতিক, স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। এই যে আমি, আপনি আমরা মানুষ, আমাদেরও সেল ডিভিশনের সময় কিছু মিউটেশন হয়, যার রেট খুব কম। কিন্তু হয়। এখন এই ন্যাচারাল, স্পনটেনাস মিউটেশন—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় হার্মলেস। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই মিউটেশনের ফলে ব্যাকটেরিয়া এমন কোনো বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, যেটা তাকে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা দেয়।
ধরা যাক, আপনার শরীরে একটা ইনফেকশনের সময় একটা নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া আছে ১০ মিলিয়ন। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯০টি ব্যাকটেরিয়া মোটামুটি একই রকম। বাকি ১০টি ব্যাকটেরিয়াতে এমন কিছু মিউটেশন হইছে, যেগুলোর ফলে সে একটা নতুন এনজাইম তৈরি করতে পারছে। যে এনজাইম পেনিসিলিন অ্যান্টিবায়োটিককে ডেস্ট্রয় করার ক্ষমতা রাখে। এখানে উল্লেখ্য যে, আপনি হয়তো জীবনে কোনোদিন পেনিসিলিন ছুঁয়েও দেখেননি, খাওয়া তো দূরের কথা! এখন এই মাত্র দশটা আলাদা ব্যাকটেরিয়ার এমনিতে আপনার তেমন কোনো ক্ষতি করার সক্ষমতা নাই। এখন আপনি যদি পেনিসিলিন খাওয়া শুরু করেন, ধরেন আপনি তিন দিন খাইলেন। সেক্ষেত্রে যারা সবচেয়ে বেশি সেনসিটিভ সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো আগে মারা যাবে। যারা আরেকটু টাফ, তারা হয়তো ৫ দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে মারা যাবে, যারা আরো টাফ তাদেরকে মারতে হয়তো ৭ দিন লাগবে!
আপনি ৫ দিন ওষুধ খেয়ে সিম্পটম কমে গেল (কারণ, মোস্ট সেনসিটিভ ব্যাকটেরিয়াগুলো মারা গেছে), তাই ওষুধ ছেড়ে দিলেন। এর ফলে এখন ধরেন ওই ১০টা ব্যাকটেরিয়া, যারা নতুন এনজাইম পেয়েছে। তাদের ওপর তো পেনিসিলিন কাজ করবে না। এতদিন ওই ১০টা ব্যাকটেরিয়ার কম্পিটিটর ছিল মাঠে। তাদেরকে আরো অনেকের সাথে নিউট্রিশনের জন্য যুদ্ধ করতে হতো। কিন্তু এখন মাঠ ফাঁকা। এই রেজিস্ট্যান্ট ১০টা ব্যাকটেরিয়া এখন সমানে বংশবিস্তার করবে। তখন আপনার শরীরে যা থাকবে, সব পেনিসিলিন রেজিস্ট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট! এটাকে ব্যাখ্যা করা যায়, ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন ও সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট দিয়ে।
এই যে ব্যাকটেরিয়াগুলো- যারা এখন বেঁচে আছে (মিউটেশনের কারণে), তারা ন্যাচারালি সিলেক্ট হয়েছে (লটারির মতো অনেকটা)। এটাই হচ্ছে ন্যাচারাল সিলেকশন। এবং এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে (অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সৃষ্ট প্রতিকূল পরিবেশে) এরাই বেঁচে থাকবে, কারণ এরা এই পরিবেশের জন্য ফিট! তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াল এই, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার আগেই রেজিস্ট্যান্স ডেভেলপ করে। এটা পুরাটাই একটা ন্যাচারাল জিনিস। এখন সম্পূরক প্রশ্ন হতে পারে- যদি অ্যান্টিবায়োটিক না খেলেও রেজিস্ট্যান্স হয়; তাহলে এই যে অ্যান্টিবায়োটিকের ফুল কোর্স খাওয়া নিয়ে বা র্যাশনাল ইউজ নিয়ে এত কথা হয়, এগুলোর দরকার কী? না খাইলেও যদি হয়, সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া না খাওয়ার সাথে তো রেজিস্ট্যান্সের সম্পর্ক নেই। না! সম্পর্ক আছে।
এই যে আপনি সাত দিনের জায়গায় চার দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে সেন্সিটিভ, দুর্বল ব্যাকটেরিয়াগুলো মেরে ফেলে একটু টাফ ব্যাকটেরিয়ার জন্য মাঠ ফাঁকা করে দিলেন, এটাই আপনার দোষ।
এটাকে বলে সিলেকশন প্রেসার। মানে, রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া ছিল ১০টা। তারা বাকি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯০ টার ভিড়ে কিছু করে উঠতে পারছিল না। আপনি অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ওই ১০টার কাজ সহজ করে দিলেন। এখন তারা পুরো জায়গাটা দখল করে নেবে। আর ফুল ডোজ অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে এমন এক কনসেন্ট্রেশন তৈরি করে, যা অনেক সময় ওই অল্প মিউটেটেড ‘টাফ’ ব্যাকটেরিয়াকেও মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু ডোজ মিস দিলে সেই সুযোগটা থাকে না।
আপনি যদি ভাইরাল ফিভারে হুদাই অ্যান্টিবায়োটিক খান, সেক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। এতে আপনার ভাইরাস তো মরেই না, উল্টো শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো মরে গিয়ে কিছু মিউটেটেড খারাপ ব্যাকটেরিয়ার জন্য জায়গা করে দেয়। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, ব্যাকটেরিয়া হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার করতে পারে। মানে নিজের অস্ত্র সে অন্য ব্যাকটেরিয়াকে দিয়ে দিতে পারে। একটা রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তার রেজিস্ট্যান্সির জন্য যে জিন সে অর্জন করেছে, সেটা পাশের ব্যাকটেরিয়াকে কোনো মূল্য ছাড়াই গিফট করতে পারে! ফলে সেও রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়।
আরেকটা ব্যাপার নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পারছি যে, রেজিস্ট্যান্ট হয় ব্যাকটেরিয়া, মানুষ নয়। এটাও অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। এক বছর বয়সী বাচ্চার যখন কালচার সেনসিটিভিটি রিপোর্টে দেখি সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট! তখন আমরা অনেক সময় আঁতকে উঠি! হায় হায় এই বাচ্চা তো জীবনে অ্যান্টিবায়োটিকই খায়নি, ওর এমন রেজিস্ট্যান্স হলো কেমনে! না, বাচ্চা নয়; মানুষ নয়। রেজিস্ট্যান্স হয় ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস, ভাইরাস।
লেখক: প্রভাষক, প্যাথলজি বিভাগ, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জ
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ























