ঢাকা ০৭:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

অ্যাডিনোভাইরাস: রোগীতে ঠাসা কলকাতা, সতর্কতা নেই ঢাকায়

  • আপডেট সময় : ১২:২৭:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ ২০২৩
  • ৮৩ বার পড়া হয়েছে


স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ডেস্ক : করোনাভাইরাস না যেতেই আরেক ভাইরাসের প্রকোপে বিপাকে কলকাতা। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০। হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা; লাগছে ভেনটিলেশন, আইসিইউ। অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ নতুন কিছু নয়, তবে কলকাতায় এবারের পরিস্থিতিকে ধরা হচ্ছে ‘গুরুতর’। এ রোগের লক্ষণও অনেকটা কোভিডের মত; সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটের সমস্যা বা বমি বমি ভাব। তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে দ্রুত। আক্রান্ত হতে পারে শ্বাসনালি, ফুসফুস। ভাইরাসটি নিয়ে কলকাতায় যে উদ্বেগ আর স্বাস্থ্য প্রশাসনের যে কড়া সতর্কতা, তার ছিটেফোঁটাও নেই বাংলাদেশে। অথচ একই লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছে বহু শিশু। শিশুদের একটি হাসপাতালের পরিচালক বলছেন, নেপথ্যে থাকতে পারে অ্যাডিনোভাইরাস, তবে পরীক্ষার ব্যবস্থাই নেই তাদের এখানে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের একজন পরিচালক স্বীকার করেছেন, তাদের কোনো নজরদারি নেই। ফলে তারা জানেন না কারা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে উপসর্গ আছে, তাদের মধ্যে কতজন অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলছেন, যাদের মধ্যে উপসর্গ আছে, তারা অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত কি না, সেটা জানা জরুরি। কলকাতায় সংক্রমণ বাড়ায় বাংলাদেশও যে ঝুঁকিতে, সেটাও তিনি বললেন।
কলকাতার পরিস্থিতি
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভাইরাল নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি ২৬ জনের মধ্যে ১৬ জন অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। সব মিলিয়ে সেখানে অ্যাডিনোভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১১, যাদের সবাই শিশু। হাসপাতালে ভিড় এতটাই বেশি যে এক শয্যায় রাখতে হচ্ছে দুই শিশুকে। খড়্গপুর শহরে এক কিশোরীর মৃত্যুর পর সেখানে ছাড়াও অন্য এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জারি করা হয়েছে নির্দেশিকা। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, সর্দিতে ভুগতে থাকা রোগীদের বলা হয়েছে দ্রুত হাসপাতালে নিতে। যাদের মধ্যে উপসর্গ আছে, তাদের পিসিআর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আনন্দবাজার লিখেছে, আগেও ছিল এ ভাইরাস, এবার কেন ভয়াবহ? তার কারণ জানতেও চলছে চেষ্টা কলকাতায়। মিউটেশন হয়ে নতুন কোনও প্রজাতি তৈরির প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে দুটো স্ট্রেইন বা সেরোটাইপের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে ‘রিকম্বিন্যান্ট ভাইরাস’।
একই উপসর্গ, পাচ্ছে না ‘গুরুত্ব’
জ্বর, ঠান্ডা ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ নিয়ে শিশুদের ভিড় বেড়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। ছেলে জুনায়েদকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে এসেছিলেন ফয়সাল মাহমুদ। জানান, সর্দি-কাশির পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট হওয়ায় জুনায়েদকে সোমবার রাতে নিয়ে যান সেখানে। চিকিৎসক দেন ভর্তির পরামর্শ। কিন্তু ফাঁকা ছিল না শয্যা। পরে যান একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বুধবার আবার ফেরেন এখানে।
তিনি বলেন, “বাচ্চার ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর। একদিন পর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। এ কারণে নিয়ে এসেছি।” টঙ্গীর বাসিন্দা সানজিদা আক্তার নিয়ে আসেন তার দেড় বছর বয়সী সন্তান সাফায়েত হোসেনকে। তিনি বলেন, “বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর, সর্দি। এ কারণে হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তার এক্সরে করতে দিয়েছে। এক্সরে করলে জানা যাবে সমস্যা কী।” জরুরি বিভাগের সামনে এক শিশুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক ধরেছিলেন দাদি রওশন আরা। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা তারা। রওশন বলেন, “ঠান্ডা জ্বরের পর নাতির নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। শ্বাসকষ্ট হওয়ায় গ্যাস (অক্সিজেন) দেওয়া লাগতেছে।” হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক এ এস এম নওশাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “শীতের শুরুতে এবং শেষে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়। তারা অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, আবার অন্য ভাইরাসও হতে পারে। তবে কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তার পরীক্ষা শিশু হাসপাতালে হয় না।” আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে এখন এই রোগটি কেমন ছড়িয়েছে তা জানার জন্য পরীক্ষা করাতে হবে। ভেক্টরোলজিক্যাল টেস্ট, ভাইরোলজিক্যাল টেস্ট করলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলামও জোর দিয়েছেন পরীক্ষার ওপর। তিনি বলেন, “কলকাতায় এই ভাইরাসের কোনো উপধরন ছড়াচ্ছে সেটি জানা জরুরি। বাংলাদেশেও লক্ষণ পাওয়া গেলে তা পরীক্ষা করা দরকার।” তবে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, “আমাদের এখানে অ্যাডিনোভাইরাস নিয়ে কোনো ‘সার্ভেইলেন্স’ (নজরদারি) নেই। এ কারণে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বলতে পারব না- কারা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে, যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে কতজন অ্যাডিনোভাইরাস আক্রান্ত।” স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, “আইইডিসিআরসহ বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি মনে করে কোনো ভাইরাস নিয়ে সতর্কবার্তা আছে, তাহলে তারা সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানায়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। “প্রতিবেশী দেশে কোনো রোগের সংক্রমণ দেখা দিলে স্বাস্থ্য বিভাগ সে বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখে। সেখান থেকে রোগটি বাংলাদেশে আসার আশঙ্কা থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করে। বাংলাদেশে প্রচলিত লক্ষণ-উপসর্গের বাইরে যদি কিছু পাওয়া যায় সেটাও চিকিৎসকরা জানান।” দেশে প্রকোপের লক্ষণ থাকলেও নজরদারি না থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “অপ্রচলিত কিছু পাওয়া গেলে কারও না কারও নজরদারিতে আসবেই। সন্দেহজনক রোগ নিয়ে যদি চিকিৎসকরা আমাদের অবহিত করেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল যদি এই রকম কিছু হয়, তাহলে তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেব।”
ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে বাংলাদেশেও ভাইরাসের কলকাতার ধরনটি আসতে পারে বলে শঙ্কার কথা বলছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার, আমাদের এখানে চলে আসবেই। “আমাদের নিস্তার নাই। সবাই টিকা নেওয়ায় করোনাভাইরাস হয়ত কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু ‘এমার্জিং ডিজিজ’, বিশেষ করে ‘ভাইরাল ডিজিজ’ থেকে মানুষ সহজেই নিস্তার পাবে না।” আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “পুরোনো এই অ্যাডিনোভাইরাস যা সারাবিশ্বেই আছে। কলকাতায় হয়ত নতুন করে প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এই ভাইরাস আমাদের এখানে থাকলেও খুব বেশি না।”
সংক্রমণের প্রকাশ কীভাবে
অনেকটা করোনাভাইরাসের মত এর উপসর্গ। চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ লক্ষণগুলো হলো- সাধারণ সর্দি-জ্বর, গলাব্যথা, তীব্র ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, চোখ-ওঠা রোগ বা কনজাঙ্কটিভাইটিস। পাকস্থলি বা অন্ত্রের প্রদাহও দেখা দেয়, যা ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব ও পেটে ব্যথা তৈরি করে। মূত্রাশয়ে প্রদাহ বা সংক্রমণ, নিউরোলজিক ডিজিস যেমন, ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা হতে পারে, তবে এটি খুব সাধারণ লক্ষণ নয়। ভাইরাসটির সংক্রমণে মাঝারি থেকে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শ্বাসতন্ত্র বা হৃদরোগ আছে তাদের জন্য ঝুঁকি বেশি। শিশু এবং প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারাই বেশি আক্রান্ত হতে পারে।
সতর্কতা জরুরি
সতর্কতার বিকল্প নাই জানিয়ে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “করোনাভাইরাসের জন্য আমরা সবাই এক ধরনের সতর্কতার মধ্যেই আছি। কাজেই বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু নজরদারির জায়গাটায় আমরা খেয়াল রাখছি।” অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, এটা জরুরি। আমরা ‘ঢিলা দিয়েছি’ মাস্ক পরার ব্যাপারে, এটা আবার শুরু করতে হবে।”
কীভাবে ছড়ায়
অ্যাডিনোভাইরাস আক্রান্ত একজন থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) যে মাধ্যমগুলোর কথা বলছে তা হলো-

  • স্পর্শ ও করমর্দনের মতো শারীরিক সংস্পর্শ ছড়াতে পারে।
  • হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসের সাহায্যে ছড়াতে পারে।
  • অ্যাডিনোভাইরাস রয়েছে এমন কিছুতে স্পর্শের পর হাত ভালোভাবে না ধুয়ে নাক-মুখ ও চোখে স্পর্শ করলে ছড়াতে পারে।
  • আক্রান্ত শিশুদের পয়োঃবর্জ্য থেকে ছড়াতে পারে। যেমন- ডায়াপার পরিবর্তনের সময় এই ঝুঁকি থাকে।
    সিডিসি বলছে, অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত কেউ সুস্থ হয়ে উঠলেও ওই ব্যক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। বিশেষ করে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের মাধ্যমে এটি হতে পারে। এ ছাড়া অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত, কিন্তু উপসর্গ বা লক্ষণ নেই, এমন ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যদের শরীরে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
    প্রতিরোধের উপায়
    অ্যাডিনোভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে কিছু উপায় তুলে ধরেছে সিডিসি।
  • সাবান-পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ভালোভাবে হাত ধোয়া, শিশুদেরও এই অভ্যাস তৈরি করা।
  • অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা।
  • অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
  • নিজে আক্রান্ত হলে বাড়িতে অবস্থান করা।
  • হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখ আটকানো।
  • অন্যের ব্যবহৃত জিনিস যেমন, কাপ ও খাবাবের থালা-বাটি ব্যবহার না করা।
  • আক্রান্ত হলে চুম্বন থেকে বিরত থাকা।
  • বাথরুম থেকে ফিরে সাবন-পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে হাত ধোয়া, অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
    চিকিৎসা
    অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা বা ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ নেই। আক্রান্তদের হাসাপাতালে রেখে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হতে পারে। বেশিরভাগ অ্যাডিনোভাইরাস সংক্রমণ মৃদু হয় এবং এ থেকে মুক্তি পেতে কেবল বিশ্রাম, পরিচর্যা প্রয়োজন হতে পারে। সেইসঙ্গে উপসর্গগুলো সারাতে জ্বরের ওষুধ কাজে লাগতে পারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সেবনের পরামর্শ দিয়েছে সিডিসি। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ওষুধ খেলে চারদিন, না খেলে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে।”
    টিকা
    অ্যাডিনোভাইরাসের টাইপ ফোর এবং টাইপ সেভেন এর ভ্যাকসিন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; তবে এ দুটি ধরনে আক্রান্ত বা উচ্চঝুঁকিতে থাকা দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদেরই কেবল ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

অ্যাডিনোভাইরাস: রোগীতে ঠাসা কলকাতা, সতর্কতা নেই ঢাকায়

আপডেট সময় : ১২:২৭:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ ২০২৩


স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা ডেস্ক : করোনাভাইরাস না যেতেই আরেক ভাইরাসের প্রকোপে বিপাকে কলকাতা। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু, মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১০। হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা; লাগছে ভেনটিলেশন, আইসিইউ। অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ নতুন কিছু নয়, তবে কলকাতায় এবারের পরিস্থিতিকে ধরা হচ্ছে ‘গুরুতর’। এ রোগের লক্ষণও অনেকটা কোভিডের মত; সর্দি, কাশি, জ্বর, পেটের সমস্যা বা বমি বমি ভাব। তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে দ্রুত। আক্রান্ত হতে পারে শ্বাসনালি, ফুসফুস। ভাইরাসটি নিয়ে কলকাতায় যে উদ্বেগ আর স্বাস্থ্য প্রশাসনের যে কড়া সতর্কতা, তার ছিটেফোঁটাও নেই বাংলাদেশে। অথচ একই লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছে বহু শিশু। শিশুদের একটি হাসপাতালের পরিচালক বলছেন, নেপথ্যে থাকতে পারে অ্যাডিনোভাইরাস, তবে পরীক্ষার ব্যবস্থাই নেই তাদের এখানে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের একজন পরিচালক স্বীকার করেছেন, তাদের কোনো নজরদারি নেই। ফলে তারা জানেন না কারা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে। যাদের মধ্যে উপসর্গ আছে, তাদের মধ্যে কতজন অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত। ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলছেন, যাদের মধ্যে উপসর্গ আছে, তারা অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত কি না, সেটা জানা জরুরি। কলকাতায় সংক্রমণ বাড়ায় বাংলাদেশও যে ঝুঁকিতে, সেটাও তিনি বললেন।
কলকাতার পরিস্থিতি
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভাইরাল নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি ২৬ জনের মধ্যে ১৬ জন অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। সব মিলিয়ে সেখানে অ্যাডিনোভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ১১, যাদের সবাই শিশু। হাসপাতালে ভিড় এতটাই বেশি যে এক শয্যায় রাখতে হচ্ছে দুই শিশুকে। খড়্গপুর শহরে এক কিশোরীর মৃত্যুর পর সেখানে ছাড়াও অন্য এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য জারি করা হয়েছে নির্দেশিকা। জ্বর, শ্বাসকষ্ট, সর্দিতে ভুগতে থাকা রোগীদের বলা হয়েছে দ্রুত হাসপাতালে নিতে। যাদের মধ্যে উপসর্গ আছে, তাদের পিসিআর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আনন্দবাজার লিখেছে, আগেও ছিল এ ভাইরাস, এবার কেন ভয়াবহ? তার কারণ জানতেও চলছে চেষ্টা কলকাতায়। মিউটেশন হয়ে নতুন কোনও প্রজাতি তৈরির প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে দুটো স্ট্রেইন বা সেরোটাইপের মিশ্রণে তৈরি হয়েছে ‘রিকম্বিন্যান্ট ভাইরাস’।
একই উপসর্গ, পাচ্ছে না ‘গুরুত্ব’
জ্বর, ঠান্ডা ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ নিয়ে শিশুদের ভিড় বেড়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। ছেলে জুনায়েদকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে এসেছিলেন ফয়সাল মাহমুদ। জানান, সর্দি-কাশির পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট হওয়ায় জুনায়েদকে সোমবার রাতে নিয়ে যান সেখানে। চিকিৎসক দেন ভর্তির পরামর্শ। কিন্তু ফাঁকা ছিল না শয্যা। পরে যান একটি বেসরকারি হাসপাতালে। বুধবার আবার ফেরেন এখানে।
তিনি বলেন, “বাচ্চার ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর। একদিন পর শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। এ কারণে নিয়ে এসেছি।” টঙ্গীর বাসিন্দা সানজিদা আক্তার নিয়ে আসেন তার দেড় বছর বয়সী সন্তান সাফায়েত হোসেনকে। তিনি বলেন, “বেশ কয়েকদিন ধরে জ্বর, সর্দি। এ কারণে হাসপাতালে এসেছি। ডাক্তার এক্সরে করতে দিয়েছে। এক্সরে করলে জানা যাবে সমস্যা কী।” জরুরি বিভাগের সামনে এক শিশুর মুখে অক্সিজেন মাস্ক ধরেছিলেন দাদি রওশন আরা। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা তারা। রওশন বলেন, “ঠান্ডা জ্বরের পর নাতির নিউমোনিয়া হয়ে গেছে। শ্বাসকষ্ট হওয়ায় গ্যাস (অক্সিজেন) দেওয়া লাগতেছে।” হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক এ এস এম নওশাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “শীতের শুরুতে এবং শেষে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়। তারা অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে, আবার অন্য ভাইরাসও হতে পারে। তবে কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, তার পরীক্ষা শিশু হাসপাতালে হয় না।” আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে এখন এই রোগটি কেমন ছড়িয়েছে তা জানার জন্য পরীক্ষা করাতে হবে। ভেক্টরোলজিক্যাল টেস্ট, ভাইরোলজিক্যাল টেস্ট করলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলামও জোর দিয়েছেন পরীক্ষার ওপর। তিনি বলেন, “কলকাতায় এই ভাইরাসের কোনো উপধরন ছড়াচ্ছে সেটি জানা জরুরি। বাংলাদেশেও লক্ষণ পাওয়া গেলে তা পরীক্ষা করা দরকার।” তবে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, “আমাদের এখানে অ্যাডিনোভাইরাস নিয়ে কোনো ‘সার্ভেইলেন্স’ (নজরদারি) নেই। এ কারণে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বলতে পারব না- কারা কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে, যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে কতজন অ্যাডিনোভাইরাস আক্রান্ত।” স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, “আইইডিসিআরসহ বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি মনে করে কোনো ভাইরাস নিয়ে সতর্কবার্তা আছে, তাহলে তারা সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানায়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। “প্রতিবেশী দেশে কোনো রোগের সংক্রমণ দেখা দিলে স্বাস্থ্য বিভাগ সে বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখে। সেখান থেকে রোগটি বাংলাদেশে আসার আশঙ্কা থাকলে সাবধানতা অবলম্বন করে। বাংলাদেশে প্রচলিত লক্ষণ-উপসর্গের বাইরে যদি কিছু পাওয়া যায় সেটাও চিকিৎসকরা জানান।” দেশে প্রকোপের লক্ষণ থাকলেও নজরদারি না থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “অপ্রচলিত কিছু পাওয়া গেলে কারও না কারও নজরদারিতে আসবেই। সন্দেহজনক রোগ নিয়ে যদি চিকিৎসকরা আমাদের অবহিত করেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল যদি এই রকম কিছু হয়, তাহলে তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেব।”
ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে বাংলাদেশেও ভাইরাসের কলকাতার ধরনটি আসতে পারে বলে শঙ্কার কথা বলছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার, আমাদের এখানে চলে আসবেই। “আমাদের নিস্তার নাই। সবাই টিকা নেওয়ায় করোনাভাইরাস হয়ত কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু ‘এমার্জিং ডিজিজ’, বিশেষ করে ‘ভাইরাল ডিজিজ’ থেকে মানুষ সহজেই নিস্তার পাবে না।” আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “পুরোনো এই অ্যাডিনোভাইরাস যা সারাবিশ্বেই আছে। কলকাতায় হয়ত নতুন করে প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এই ভাইরাস আমাদের এখানে থাকলেও খুব বেশি না।”
সংক্রমণের প্রকাশ কীভাবে
অনেকটা করোনাভাইরাসের মত এর উপসর্গ। চিকিৎসকরা জানান, সাধারণ লক্ষণগুলো হলো- সাধারণ সর্দি-জ্বর, গলাব্যথা, তীব্র ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া, চোখ-ওঠা রোগ বা কনজাঙ্কটিভাইটিস। পাকস্থলি বা অন্ত্রের প্রদাহও দেখা দেয়, যা ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব ও পেটে ব্যথা তৈরি করে। মূত্রাশয়ে প্রদাহ বা সংক্রমণ, নিউরোলজিক ডিজিস যেমন, ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা হতে পারে, তবে এটি খুব সাধারণ লক্ষণ নয়। ভাইরাসটির সংক্রমণে মাঝারি থেকে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শ্বাসতন্ত্র বা হৃদরোগ আছে তাদের জন্য ঝুঁকি বেশি। শিশু এবং প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারাই বেশি আক্রান্ত হতে পারে।
সতর্কতা জরুরি
সতর্কতার বিকল্প নাই জানিয়ে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “করোনাভাইরাসের জন্য আমরা সবাই এক ধরনের সতর্কতার মধ্যেই আছি। কাজেই বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু নজরদারির জায়গাটায় আমরা খেয়াল রাখছি।” অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, এটা জরুরি। আমরা ‘ঢিলা দিয়েছি’ মাস্ক পরার ব্যাপারে, এটা আবার শুরু করতে হবে।”
কীভাবে ছড়ায়
অ্যাডিনোভাইরাস আক্রান্ত একজন থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) যে মাধ্যমগুলোর কথা বলছে তা হলো-

  • স্পর্শ ও করমর্দনের মতো শারীরিক সংস্পর্শ ছড়াতে পারে।
  • হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসের সাহায্যে ছড়াতে পারে।
  • অ্যাডিনোভাইরাস রয়েছে এমন কিছুতে স্পর্শের পর হাত ভালোভাবে না ধুয়ে নাক-মুখ ও চোখে স্পর্শ করলে ছড়াতে পারে।
  • আক্রান্ত শিশুদের পয়োঃবর্জ্য থেকে ছড়াতে পারে। যেমন- ডায়াপার পরিবর্তনের সময় এই ঝুঁকি থাকে।
    সিডিসি বলছে, অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত কেউ সুস্থ হয়ে উঠলেও ওই ব্যক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। বিশেষ করে যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের মাধ্যমে এটি হতে পারে। এ ছাড়া অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত, কিন্তু উপসর্গ বা লক্ষণ নেই, এমন ব্যক্তির মাধ্যমে অন্যদের শরীরে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
    প্রতিরোধের উপায়
    অ্যাডিনোভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে কিছু উপায় তুলে ধরেছে সিডিসি।
  • সাবান-পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ভালোভাবে হাত ধোয়া, শিশুদেরও এই অভ্যাস তৈরি করা।
  • অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা।
  • অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
  • নিজে আক্রান্ত হলে বাড়িতে অবস্থান করা।
  • হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখ আটকানো।
  • অন্যের ব্যবহৃত জিনিস যেমন, কাপ ও খাবাবের থালা-বাটি ব্যবহার না করা।
  • আক্রান্ত হলে চুম্বন থেকে বিরত থাকা।
  • বাথরুম থেকে ফিরে সাবন-পানি দিয়ে খুব ভালোভাবে হাত ধোয়া, অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
    চিকিৎসা
    অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা বা ভাইরাস প্রতিরোধী ওষুধ নেই। আক্রান্তদের হাসাপাতালে রেখে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হতে পারে। বেশিরভাগ অ্যাডিনোভাইরাস সংক্রমণ মৃদু হয় এবং এ থেকে মুক্তি পেতে কেবল বিশ্রাম, পরিচর্যা প্রয়োজন হতে পারে। সেইসঙ্গে উপসর্গগুলো সারাতে জ্বরের ওষুধ কাজে লাগতে পারে, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে সেবনের পরামর্শ দিয়েছে সিডিসি। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, “এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ওষুধ খেলে চারদিন, না খেলে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে।”
    টিকা
    অ্যাডিনোভাইরাসের টাইপ ফোর এবং টাইপ সেভেন এর ভ্যাকসিন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে; তবে এ দুটি ধরনে আক্রান্ত বা উচ্চঝুঁকিতে থাকা দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদেরই কেবল ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।