তৃষিয়া নাশতারান : এই লেখাটা যখন লিখছি তখন নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাক নিয়ে হেনস্তার মূল হোতা মার্জিয়া আক্তার শিলা/ সায়মা গ্রেফতার হয়েছেন। এর তিন দিন আগে ২০ জন নারীবাদী অ্যাক্টিভিস্টের একটা দল নরসিংদী রেলস্টেশন থেকে ঘুরে এসেছে। আমরা কারা, কেন আমরা গেলাম, কীভাবে পরস্পরকে পেলাম, গিয়ে কী দেখলাম, আগামীতে কী করবো ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ছুটে এসেছে আমাদের দিকে। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া জরুরি মনে করছি।
১৮ তারিখের ঘটনার পর নরসিংদী স্টেশনে আমরাই প্রথম দলবেঁধে গেলাম। খবরটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে প্রশংসা আসছে নানাদিক থেকে। অথচ আমার কাছে ব্যাপারটা দুঃখজনক। এই ডিজিটাল যুগে নয় দিন দীর্ঘ সময়। একজন নারী স্বাধীন দেশের উন্মুক্ত জনপরিসরে প্রকাশ্য দিবালোকে পোশাকের জন্য আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এরপর পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গেছে, ঘরে বসে অনলাইনে অনেকে লিখছিলেন কী করা উচিত, অথচ কেউ সশরীরে প্রতিবাদ জানাতে সেখানে যাননি। এটা অদ্ভুত লাগছিল আমার। একরকম বিতৃষ্ণা আর ক্ষোভ নিয়েই আমি একা নরসিংদী স্টেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেটা ২২ তারিখ। আক্রমণের পর চার দিন কেটে গেছে ইতোমধ্যে। আমার পরিকল্পনা ছিল পশ্চিমা পোশাক পরে রেলস্টেশনে গিয়ে ঘোরাঘুরি করা। কোনও সভা, সমাবেশ কিংবা স্লোগানের ইচ্ছা আমার ছিল না। আমি জানি, একজন স্বাধীন, নির্ভয় নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতিই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্য ভীতিকর একটা ব্যাপার। প্রতিবাদ জানাতে তাকে কোনও স্লোগান দিতে হয় না, মাইকিং করতে হয় না। সে নিজের মতো করে চুপচাপ মাথা তুলে একটা জায়গায় দাঁড়ালেই মানুষ ভয় পায়, অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এই দৃশ্যমান উপস্থিতিই আমার প্রতিবাদের ভাষা। সেই উপস্থিতিটুকু নিয়েই শান্তিপূর্ণভাবে আমি অপরাধস্থলে হাজিরা দিতে চেয়েছিলাম।
প্রতিবাদের এই প্রকাশ অবশ্য নতুন কিছু নয়। এর আগে টিএসসিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপন চলাকালে ঘটে যাওয়া যৌন সহিংসতার প্রতিবাদে ২০১৫ সালে এমন একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম, যার নাম ছিল ‘আরেক বৈশাখ’। সেবার আমরা ঘটনার দশ দিন পরে অনেকে মিলে বৈশাখী সাজে সেজে টিএসসিতে গেছিলাম বাংলা নববর্ষকে নতুন করে বরণ করতে। আমরা মানে মেয়ে নেটওয়ার্কের সদস্য ও তাদের বন্ধুরা। তার ধারাবাহিকতায় পরের বছর ঢাকার নিমতলী গেটের সামনের রাস্তায় বসে নারীরা মিলে যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে স্লোগান লিখেছিল রিকশার গায়ে। আর এ বছর ২ এপ্রিলে লতা সমাদ্দার টিপ পরার কারণে একজন পুলিশ কর্মকর্তার আক্রমণের শিকার হলে তার প্রতিবাদে পরদিন আমরা ক’জন টিপ পরে দাঁড়িয়েছিলাম সেজান পয়েন্টে। কোনও স্লোগান নয়, প্ল্যাকার্ড নয়। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা। আমরা এগুলো করি। একে আমরা বলি রিক্লেইমিং পাবলিক স্পেস– জনপরিসরের অধিকার নতুন করে দাবি করা। ভাবনার সূত্র একটাই – এই জনপরিসর আমারও, আমি আপনার সমান স্বাধীনতা ও মর্যাদার দাবিদার, আমি আমার মতো করেই উপস্থিত হবো, আমি অদৃশ্য হবো না, আমি কী পরবো আর কী পরবো না তা আমি ঠিক করবো। নরসিংদীতে সেই একই ভাবনা নিয়ে আমরা যাওয়ার পরিকল্পনা করেছি।
ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে, মেয়ে নেটওয়ার্কের বিভিন্ন গ্রুপে এবং চেনাজানা বিভিন্ন নারীবাদী প্ল্যাটফর্মে জানাই যে ২৭ মে সকালে আমি নরসিংদী রেলস্টেশনে যাবো, জায়গাটা ঘুরে দেখবো, কেউ চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারেন। আগ্রহীদের বলি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিস্তারিত জেনে নিতে। ইচ্ছা করেই কাউকে আলাদা করে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, বরং আগ্রহীদের বলেছি মেসেজ দিতে। ২৪ তারিখের মধ্যে যারা মেসেজ দিয়েছেন তাদের জন্য টিকিট জোগাড় করেছি। ২৪ তারিখের পরে যারা যোগাযোগ করেছেন তাদের আমাদের যাত্রার তথ্য জানিয়ে দিয়েছি, যাতে তারা নিজের মতো করে এসে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন।
এখানে আমার কাজ ছিল আহ্বান জানানো, সমন্বয় ও যোগাযোগ করা। ইচ্ছা করে কাউকে আলাদা করে আমন্ত্রণ জানাইনি। যারা নিজের আগ্রহে, নিজের চেষ্টায় এসেছেন তাদের নিয়ে গেছি। কারণ, আমি বিশ্বাস করি পরিবর্তনে সবার দায়বদ্ধতা আছে। এই দায় যারা স্বীকার করেন তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে খুব দ্রুত এবার নরসিংদী যাওয়ার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন হয়েছে।
মেয়ে নেটওয়ার্ক অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নারীবাদী গ্রাসরুটস অরগানাইজিং প্ল্যাটফর্ম। গত ১১ বছর ধরে হাজার হাজার নারী এখানে যুক্ত হয়েছেন এবং নিজেদের গল্প ও কাজের মধ্য দিয়ে সাম্যের জন্য তারা একযোগে কাজ করছেন। অগ্নিযাত্রা এই গল্পগুলো তুলে ধরার একটি প্রকল্প। পুরুষতন্ত্রে নারীর আগুনে মোড়ানো পথের গল্পগুলো এই প্রকল্প তুলে আনে। আমাদের ঢাকা-নরসিংদী যাত্রা ছিল সেটার ধারাবাহিকতায় একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা, যেটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়িয়ে নানান ব্যক্তি ও সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। নরসিংদীর অগ্নিযাত্রায় আমার সঙ্গে ছিলেন স্মিতা, নুভা, এ্যানি, আনোয়ার, অর্ণব, মম, অপরাজিতা, সুরভী, সামিহা, সানজানা, লক্ষ্মী, অন্তরা, মিশু, প্রমি, জিসা, নিশা, বিজু, ইফফাত ও নীল। পরিচয়ে আমরা অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক, শিল্পী, সংগঠক, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আলোকচিত্রী, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, প্রকৌশলী, শিক্ষক এবং আরও অনেক কিছু। সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মানুষ এবং নারীবাদী।
২৭ মে সকালে এগারোসিন্ধুর প্রভাতী ট্রেনের বগি ঙ’র অর্ধেকটা জুড়ে ছিলাম আমরা বিশজন। সংখ্যার নিশ্চয়ই একটা শক্তি আছে। আমরা বিশজন দেখতে বিশ রকম, পোশাকে আর চলনেবলনে বগিতে উপস্থিত অন্যদের থেকে আলাদা। সহযাত্রীদের চাপা কৌতূহল ছাপিয়ে আমরা আনন্দে এবং স্বাচ্ছন্দ্যেই ছিলাম। হয়তো সংখ্যার জোরেই। মাত্র নয় দিন আগে নরসিংদী রেলস্টেশনে যেই তরুণী রক্ষণশীল পোশাক না পরার কারণে আক্রান্ত ও অপমানিত হলেন তার কথা মনে হচ্ছিল। মেয়েটা একা পড়ে গেছিল সেদিন। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো যে মানুষগুলো শকুনের মতো আক্রমণ করেছিল কিংবা নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল তারা সেদিন সংখ্যায় বড় ছিল। তাই সংখ্যার ওপর ভরসা করতে পারি না।
আমাদের ট্রেনে বোরকা পরা দুজন নারী একজন শিশুকে নিয়ে ভুল সময়ে চলে এসেছিলেন। ফলে সিট পাচ্ছিলেন না। আমাদের দুটো সিট তাদের ছেড়ে দেওয়ায় খুশি হয়ে ধন্যবাদ দিলেন। এই সৌজন্য বা সহাবস্থান অপ্রত্যাশিত নয়। তাও বাস্তবতা বারবার প্রশ্ন জাগায় মনে- আমরা কেউ যদি একা হতাম, তাহলে ক্ষমতার সমীকরণটা কেমন হতো? এই প্রশ্ন নরসিংদী স্টেশন থেকে ঘুরে এসেও করেছি নিজেকে।
কেন গেলাম নরসিংদীতে? সেই মেয়েটার জন্য গেছি। কারণ, মেয়েটার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। কাল যদি আমি এমন নৃশংস ভিড়ের মধ্যে একা পড়ে যাই, আমি চাইবো কেউ আমার পাশে দাঁড়াক। তাই নিজের জন্যই হয়তো গেছি নরসিংদীতে। নরসিংদী রেলস্টেশনে আমরা চার ঘণ্টা ছিলাম। আমরা ঘুরে বেরিয়েছি, আড্ডা দিয়েছি, খাওয়াদাওয়া করেছি, উপস্থিত জনসাধারণের সাথে গল্প করেছি, উপস্থিত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করেছি। সত্যি বলতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের আর সব জায়গায় সাধারণ মানুষের যে কৌতূহল আর প্রশ্নে আমি অভ্যস্ত, নরসিংদীতে সেটাই দেখেছি। তবে আমরা একসাথে অনেকে ছিলাম বলে হয়তো একটু বেশিই সতর্ক আর আন্তরিক ছিল সবাই। একা গেলে অভিজ্ঞতাটা ভিন্ন হতেই পারতো।
নরসিংদী স্টেশনে ১৮ মে-তে যা ঘটেছে তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মার্জিয়া আক্তার কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি নন। নারীবিদ্বেষ কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতার শেকড় পুরুষতন্ত্রে। মার্জিয়া এই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ। তার আক্রমণ, তার সঙ্গীদের সংঘবদ্ধ যোগদান আমাদের সমাজকাঠামোর দীর্ঘদিনের লালিত ও চর্চিত অভ্যাস ও শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ। এই কাঠামোটি মূলত পুরুষতন্ত্র। পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। পুরুষতন্ত্রের কোনও জেন্ডার নেই। ভুলে গেলে চলবে না যে ১৮ মে-তে প্রথম আক্রমণকারী কিন্তু ছিলেন একজন নারী। নারী মাত্রই নারীবাদী নন এবং পুরুষও পুরুষতন্ত্রের বলি হতে পারেন, হচ্ছেন। নারী, পুরুষ এবং অন্য সকল জেন্ডারের মানুষের এখানে মানবিকভাবে, সচেতনভাবে হাত মেলানো এবং পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করা আমরা জরুরি মনে করি। আমি মনে করি না দলবেঁধে অহিংস অবস্থান জানান দেওয়া একমাত্র সমাধান কিংবা আদৌ কোনও সমাধান। আমাদের যাত্রা ও অবস্থান একটা পদক্ষেপ ছিল মাত্র। একটিমাত্র পদক্ষেপে পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ ও শ্রমসাপেক্ষ ব্যাপার। পরিবর্তন চাইলে সমস্যা স্বীকার করতে হবে, সমস্যার শেকড়ে পৌঁছাতে হবে, সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।
আগামীতে আবারও কি এভাবে প্রতিবাদ করতে চাই?
না, চাই না। আগামীতে আমি নিজের শর্তে আরামে, শান্তিতে, নিরাপদে জনপরিসরে বিচরণ করতে চাই। আবারও অপরাধ ঘটলে আমি চাইবো আপনি গিয়ে দাঁড়াবেন, প্রতিবাদ করবেন– কষ্টের জবাব আনন্দ দিয়ে দেবেন, ভয়ের জবাব সাহস দিয়ে দেবেন, কদর্যতার জবাব দেবেন নান্দনিকতা দিয়ে, ঘৃণার জবাব দেবেন ভালোবাসা দিয়ে। একটা সুন্দর, ন্যায্য ভবিষ্যৎ তৈরিতে সবার দায় আছে, সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আমি চাইবো পরেরবার যে যার সুন্দর ভাবনা অনলাইনের দেয়ালে সীমাবদ্ধ না রেখে তা পথে পথে ছড়িয়ে দেবেন, প্রতিবাদ প্রকাশ করতে নয় দিন অপেক্ষা করবেন না। শ্রীজাতের কবিতার চারটা পঙ্ক্তি আমার খুব প্রিয়। মানুষ থেকেই মানুষ আসে, বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়, আমিও মানুষ, তুমিও মানুষ, তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
লেখক: নারীবাদী সংগঠক ও ফোরসাইট স্ট্র্যাটেজিস্ট, অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ; আহ্ববায়ক ও সমন্বয়ক, অহিংস অগ্নিযাত্রা