প্রত্যাশা ডেস্ক: ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির একটি হাসপাতাল, সেখানে অস্ত্রোপচারের কক্ষে টেবিলের ওপর তীব্র আলোর নিচে নিস্তেজ শুয়ে আছেন এক নারী। চিকিৎসকেরা তাঁর পিত্তথলি অপসারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার প্রভাবে ওই নারী অচেতন, অনুভূতিহীন এবং সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছেন। অস্ত্রোপচারের কক্ষে মনিটরের হালকা শব্দ আর অস্ত্রোপচারকারী দলের কর্মতৎপরতার খুটখাট আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
অস্ত্রোপচারের টেবিলের ওপর নিস্তেজ পড়ে থাকা রোগীর কানে হেডফোন পরিয়ে দেওয়া, সেখানে মৃদু সুরে বাঁশি বাজছে। অ্যানেসথেসিয়ায় ব্যবহৃত ওষুধের প্রভাবে ওই রোগীর মস্তিষ্কের বড় অংশ নিস্তেজ হয়ে পড়লেও তাঁর শ্রবণশক্তি আংশিকভাবে সক্রিয় আছে।
ওই নারী রোগী যখন জাগবেন, তখন তাঁর সচেতনতা দ্রুত ও স্পষ্টভাবে ফিরে আসবে। কারণ, তাঁকে অ্যানেসথেসিয়ায় কম মাত্রায় ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে। তাঁর তুলনায় যাঁরা সংগীত শোনেননি, তাঁদের বেশি মাত্রায় ওষুধ দিতে হয়।
অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের সময় রোগীদের সংগীত শোনানো হলে তাঁদের অ্যানেসথেসিয়ায় অন্যদের তুলনায় কম মাত্রায় ওষুধ দিলেও চলবে। দিল্লির মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজের নতুন এক সমীক্ষা এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
মিউজিক অ্যান্ড মেডিসিন জার্নালে নতুন এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ পেয়েছে। যা বিবিসিও প্রকাশ করেছে। গবেষণাটি এমন কিছু শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করছে, যেখানে দেখা গেছে, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীকে সংগীত শোনানো হলে তা জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ায় ওষুধের মাত্রা কমাতে এবং সুস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে।
এই গবেষণা ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেকটমি করা রোগীদের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। পিত্তথলি অপসারণের জন্য ব্যবহৃত এটি আধুনিক অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা।
এ ব্যবস্থায় পেট না কেটে বরং ছোট ছিদ্র করে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়, একে ‘কিহোল সার্জারি’ বলে। এ ধরনের অস্ত্রোপচারে খুব বেশি সময় লাগে না, সাধারণ এক ঘণ্টার কম সময়ের প্রয়োজন পড়ে। রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও দ্রুত হয়।
গবেষকেরা কেন সংগীতের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, তা বোঝার জন্য আধুনিক অ্যানেসথেসিয়ার প্রক্রিয়াটি বোঝা জরুরি।
এ নিয়ে অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ফারাহ হুসাইন বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো অস্ত্রোপচারের পর দ্রুত রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া। এ জন্য রোগীদের জাগতে হবে সতেজ মস্তিষ্কে, সতর্ক ও সচেতন অবস্থায় এবং যথাসম্ভব ব্যথামুক্তভাবে। রোগী যত ভালোভাবে ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, শরীরের চাপ তত কম পড়বে।
ফারাহ এ গবেষণায় একজন সনদপ্রাপ্ত ‘মিউজিক থেরাপিস্ট’ হিসেবে কাজ করেছেন। ফারাহ বলেন, অ্যানেসথেসিয়ায় খুবই সতর্কভাবে পাঁচ–ছয়টি ওষুধের সমন্বিত মিশ্রণের প্রয়োজন পড়ে। ওই মিশ্রণ একই সঙ্গে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, ব্যথার অনুভূতি হতে দেয় না, অস্ত্রোপচারের সময়ের কিছু স্মৃতিতে থাকে না এবং পেশিগুলো শিথিল করে দেয়।
ল্যাপারোস্কোপির মাধ্যমে পিত্তথলি অপসারণের মতো অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়ায় এখন অবেদনবিদেরা রোগীকে পুরো অচেতন না করে পেটের নির্দিষ্ট অংশের স্নায়ুগুলোকে অবশ করে দেন। এ প্রক্রিয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘রিজওনাল ব্লক’ বলা হয়।
গবেষক দলের প্রধান ও মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজের সাবেক জ্যেষ্ঠ আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা তানভি গোয়েল বলেন, ‘অস্ত্রোপচারে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার সঙ্গে এখন রিজওনাল ব্লকের ব্যবহারও খুব সাধারণ হয়ে গেছে। কয়েক দশক ধরে আমরা এটা করছি।’
তবে যে প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা হোক, শরীর সহজে অস্ত্রোপচারের ধকল নিতে পারে না। এমনকি অ্যানেসথেসিয়ায় অচেতন শরীরও অস্ত্রোপচারের সময় প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন হৃদ্যন্ত্রের গতি বেড়ে যায়, হঠাৎ স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপও দ্রুত বাড়তে থাকে। আধুনিক অস্ত্রোপচার সেবার মূল লক্ষ্যগুলোর একটি হলো শারীরিক এই প্রতিক্রিয়ার মাত্রা কমানো ও নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চিকিৎসক ফারাহ হুসাইন বলেন, অস্ত্রোপচারে সময় শারীরিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় সুস্থ হয়ে ওঠার গতি কমে যেতে পারে এবং বাড়তে পারে প্রদাহ। এ কারণে শারীরিক চাপ সতর্কভাবে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অস্ত্রোপচারের সময়, এমনকি কাটাছেঁড়া শুরুর আগেই রোগীর শরীর প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করতে পারে। যেমন ইন্টিউবেশন বা শ্বাসনালিতে শ্বাসযন্ত্রের নল প্রবেশ প্রক্রিয়া শুরু করার সময়ই রোগী চাপ অনুভব করতে পারেন। জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ায় এটি একটি সাধারণ প্রক্রিয়া।
এটি করার জন্য অবেদনবিদ একটি ল্যারিঙ্গোস্কোপ ব্যবহার করে জিহ্বা ও গলার কোমল তন্তু উঁচু করে, কণ্ঠস্বরের কর্ড স্পষ্টভাবে দেখে শ্বাসযন্ত্রের নলটি রোগীর শ্বাসনালিতে প্রবেশ করানোর পথ নির্দেশ করেন।
মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজের অবেদনবিদ ও নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক সোনিয়া ওয়াধাওয়ান বলেন, জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার সময় ল্যারিঙ্গোস্কোপি ও ইন্টিউবেশনকে সবচেয়ে চাপ সৃষ্টি করা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়।
এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক সোনিয়া আরো বলেন, যদিও রোগী অচেতন এবং তাঁর কিছুই মনে থাকবে না। তবু তাঁর শরীর চাপের প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ ও স্ট্রেস হরমোনেও পরিবর্ত দেখা যায়।
প্রতিনিয়তই চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হচ্ছে। ওষুধও দিন দিন উন্নত হচ্ছে। এখন আর পুরোনো ইথার মাস্ক ব্যবহার করে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয় না। এর পরিবর্তে ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগীর শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
রোগীকে অচেতন করতে উল্লেখযোগ্য ওষুধের মধ্যে একটি হচ্ছে প্রপোফল। যদিও মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর কারণে প্রপোফলের কুখ্যাতি রয়েছে। এরপরও অস্ত্রোপচারের টেবিলে এটি দারুণ কার্যকর। রোগীর দ্রুত পরিষ্কারভাবে চেতনা ফিরতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
তানভি গোয়েল বলেন, ‘মাত্র ১২ সেকেন্ডে প্রপোফল কাজ শুরু করে দেয়। ল্যাপারোস্কোপিক কোলেসিস্টেকটমির মতো স্বল্প সময়ের অস্ত্রোপচারের জন্য আমরা এটিকেই বেছে নিই। কারণ, এতে শ্বাসনালির মাধ্যমে দেওয়া গ্যাসের কারণে হওয়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়ানো যায়।’
সংগীত রোগীদের জন্য প্রপোফল ও ব্যথানাশক ওষুধের প্রয়োজনীয় মাত্রা কমাতে পারে কি না, গবেষকেরা সেটিই জানার চেষ্টা করেছেন। ওষুধের পরিমাণ কম মানে রোগীর দ্রুত চেতনা ফিরবে এবং চেতনা-পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ ও নিশ্বাসের গতি দ্রুত স্থিতিশীল হয়। ফলে রোগীর শরীরে অ্যানেসথেসিয়া-পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়।
এই গবেষণা চালাতে গবেষকেরা প্রথমে আটজন রোগীকে নিয়ে একটি পাইলট গবেষণা পরিচালনা করেন। পরে গবেষকেরা ১১ মাস ধরে মূল পরীক্ষা চালান। এতে ৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক (২০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী) ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের দৈবচয়নের ভিত্তিতে দুই ভাগ করা হয়।
পরে সবাইকে অ্যানেসথেসিয়ায় পাঁচ ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। ওষুধের মধ্যে ছিল, বমি ও বমিভাব রোধকারী ওষুধ, একটি সেডেটিভ, ফেন্টানাইল, প্রপোফল ও একটি পেশি শিথিলকারী ওষুধ।
উভয় দলকে শব্দ প্রতিরোধী হেডফোন পরানো হয়। তবে শুধু একটি গ্রুপ হেডফোনে সংগীত শুনতে পেয়েছিল।
গবেষক ফারাহ হুসাইন বলেন, গবেষক দল রোগীদের মৃদু বাঁশি ও পিয়ানোর মধ্যে একটি বেছে নিতে বলেছিলেন। ফারাহ আরো বলেন, ‘রোগী অচেতন হয়ে পড়ার পরও তাঁর মনের (মস্তিষ্কের) কিছু অংশ সক্রিয় থাকে। যদিও তিনি কী শুনছেন, তা স্পষ্টভাবে মনে রাখতে পারেন না। তবে মনে না থাকলেও অবচেতন অবস্থায় থাকা সচেতনতায় এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
গবেষণা ফল ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ: সংগীত শুনেছেন, এমন রোগীদের বেলায় কম মাত্রায় প্রপোফল ও ফেন্টানাইলের প্রয়োজন হয়েছিল। অপেক্ষাকৃত দ্রুত ও সহজে তাঁদের চেতনা ফিরেছেন, কর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কম ছিল এবং অস্ত্রোপচারের সময় রক্তচাপ অনেক ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে।
গবেষকেরা তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘যেহেতু অ্যানেসথেসিয়ায় অচেতন হয়ে থাকার সময়ও শ্রবণক্ষমতা অক্ষত থাকে। তাই সংগীত তখনো মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ অবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।’
গবেষক ওয়াধাওয়ান বলেন, স্পষ্টতই, সংগীত (শরীরের) অভ্যন্তরীণ ঝড়কে শান্ত করতে সাহায্য করেছে। অচেতন অবস্থায়ও শ্রবণক্ষমতা সক্রিয় থাকে। তাই অচেতন অবস্থায় শোনা সংগীত আপনার হয়তো মনে না-ও থাকতে পারে, কিন্তু মস্তিষ্ক এটি গ্রহণ করে। তবে এ নিয়ে গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান ফারাহ হুসাইন। তিনি বলেন, এটি অস্ত্রোপচার কক্ষকে আরো মানবিক করার একটি উপায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে সংগীত থেরাপির ব্যবহার নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগ, স্ট্রোক-পরবর্তী পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি গুরুতর অসুস্থ রোগীদের যন্ত্রণা কমাতে সংগীতের ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু অ্যানেসথেসিয়ার যান্ত্রিক ও অত্যন্ত প্রযুক্তিনির্ভর জগতে সংগীতের প্রবেশ একটি নীরব পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ, যদি সংগীতের ব্যবহারে ওষুধের ব্যবহার অল্প মাত্রা হলেও কমানো যায় এবং অস্ত্রোপচার–পরবর্তী রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার গতি দ্রুত করা যায়, তবে এটি অস্ত্রোপচার-সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাকে নিশ্চিতভাবেই নতুন রূপ দেবে।
সানা/ওআ/আপ্র/২৫/১১/২০২৫





















