প্রত্যাশা ডেস্ক: পাকিস্তানকে একটি ‘হটলাইন’ বার্তা পাঠিয়ে অস্ত্রবিরতি সমঝোতার লঙ্ঘন নিয়ে সতর্ক করে ভারতের সামরিক বাহিনী বলেছে, যদি এর পুনরাবৃত্তি হয় তবে নয়া দিল্লি জবাব দেবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রোববার (১১ মে) বার্তাটি পাঠানো হয়। তবে অস্ত্রবিরতির কোনো লঙ্ঘনের কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র।
নড়বড়ে একটি অস্ত্রবিরতির ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পর ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন্স (ডিজিএমও) এই সমঝোতা নিয়ে কথা বলেছেন, জানিয়েছে রয়টার্স।
উভয়পক্ষ গত শনিবার (১০ মে) রাতে অস্ত্রবিরতির প্রাথমিক লঙ্ঘনের জন্য এক অপরকে দায়ী করে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার পর অস্ত্রবিরতি ঠিকঠাকভাবে চলছে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনী অস্ত্রবিরতির কোনো লঙ্ঘন করেনি।’ রোববার ইসলামাবাদের এই সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
গত বুধবার থেকে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশ টানা চারদিন ধরে তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত থাকার পর শনিবার বিকালে হঠাৎ করেই অস্ত্রবিরতির ঘোষণা আসে। তিন দশকের মধ্যে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে তীব্র লড়াই। তারা পরস্পরের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ও ড্রোনযোগে হামলা চালায়। এসব পাল্টাপাল্টি হামলায় প্রায় ৭০ জন নিহত হন।
লড়াই উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, এমনটি বোধ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আর যুদ্ধ থামাতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতা অস্ত্রবিরতি সমঝোতায় সহায়তা করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প শনিবার দুই দেশের মধ্যে এই অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়ে জানান, ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় এটি সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু অস্ত্রবিরতি শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভারত শাসিত কাশ্মিরে গোলাবর্ষিত হতে দেখা যায়। চারদিনের যুদ্ধের অধিকাংশ সময় এই অঞ্চলটিই কেন্দ্রে ছিল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, বাসিন্দারা ও রয়টার্সের প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ব্ল্যাকআউটের মধ্যে সীমান্তের কাছের শহরগুলিতে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা যায়। অস্ত্রবিরতির কথা উল্লেখ করে ভারতের ডিজিএমও লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজিব ঘাই বলেন, ‘অনেক সময় এই ধরনের সমঝোতাগুলো ফলপ্রসূ হতে, ঘটনাস্থলে স্পষ্ট হতে সময় নেয়। (ভারতীয়) সশস্ত্র বাহিনী (গতকাল) অতি অতি উচ্চ সতর্কাবস্থায় ছিল আর এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে।’
তিনি জানান, ভারতের সেনা প্রধান বাহিনীর কমান্ডারদের তারা যেটা ভালো মনে করবেন সেভাবে সীমান্তের অপর পাশ থেকে আসা ‘যে কোনো ধরনের লঙ্ঘনের’ মোকাবেলা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জানান, তার সমমর্যাদার পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা শনিবার বিকালে তাকে ফোন করে দুই দেশের ‘শত্রুতা বন্ধের’ প্রস্তাব দেন এবং জরুরিভিত্তিতে অস্ত্রবিরতির অনুরোধ জানান।
অপরদিকে পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র জানান, ৬ ও ৭ মে-র মধ্যে পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালানোর ও আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের হস্তক্ষেপের পর ভারতের আগের জানানো অনুরোধে ১০ মে সাড়া দেয় পাকিস্তান। শনিবার রাতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অস্ত্রবিরতি সমঝোতার প্রতি তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে এটি লঙ্ঘনের জন্য ভারতকে দায়ী করেছিল।
অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানে শতাধিক জঙ্গি হত্যার দাবি, কথা বলেননি রাফাল নিয়ে: কাশ্মিরের পহেলগামে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে চালানো ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ অন্তত ১০০ জনের বেশি জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী। রোববার দিল্লিতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানান, ৭ মে রাতে পাকিস্তানে ৯টি নির্দিষ্ট ‘সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্র’ লক্ষ্য করে ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা চালায়। তবে ভারতীয় রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাকিস্তানের দাবির বিষয়ে তারা কিছু জানাননি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা দাবি করেন, এই অভিযানে ‘শুধু জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করেই’ হামলা চালানো হয়েছে। পাশাপাশি বেসামরিক স্থাপনায় যেন ক্ষয়ক্ষতি না হয়, সে বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে বলে জানান তারা।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই, এয়ার মার্শাল অবদেশ কুমার ভারতি, ভাইস অ্যাডমিরাল এএন প্রমোদ ও মেজর জেনারেল সন্দীপ এস শারদা সম্মিলিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এয়ার মার্শাল ভারতি বলেন, পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বিমানঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার এবং সামরিক অবকাঠামোতে সমন্বিত, পরিকল্পিত ও মাপজোক করে হামলা চালানো হয়। এই বার্তা দেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য-ভারত আর আগ্রাসন সহ্য করবে না। তিনি জানান, ৭ মে মধ্যরাতে পাকিস্তানের লাহোর অঞ্চলের একটি নজরদারি রাডার সাইট ধ্বংস করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিমান হামলায় অংশ নেওয়া ভারতীয় বাহিনীর সব পাইলট ‘নিরাপদে বাড়ি ফিরেছেন’। তবে দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাকিস্তানের দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সেনা কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, এখনও সংঘর্ষ চলছে। এই মুহূর্তে কোনো মন্তব্য করা শত্রুপক্ষকে সুবিধা দিতে পারে। আমরা আমাদের লক্ষ্য পূরণ করেছি, আর সব পাইলট নিরাপদে ফিরে এসেছেন।
ব্রিফিংয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই জানান, আমাদের পাঁচ সহযোদ্ধা জীবন দিয়েছেন এই অভিযানে। তাদের আত্মত্যাগ দেশের জন্য গর্বের এবং চিরস্মরণীয় থাকবে। একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তানের গোলাগুলির জবাবে ৩৫ থেকে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য নিহত হয়েছে।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতীয় শহরগুলোর ওপর ঢেউ আকারে ড্রোন ও মানবহীন আকাশযান দিয়ে হামলার চেষ্টা করে বলে দাবি করেন এয়ার মার্শাল ভারতি। ৮ ও ৯ মে রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু করে টানা ড্রোন হামলা চালানো হয়, যা ভারতের বিভিন্ন শহরের আকাশে প্রতিহত করা হয়। ভারত দাবি করেছে, এসব ড্রোন হামলায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তিনি জানান, আমরা প্রস্তুত ছিলাম এবং আমাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সজাগ ছিল। কোনো লক্ষ্যবস্তুতে শত্রুপক্ষ পৌঁছাতে পারেনি। ভরতি আরো বলেন, ড্রোন হামলার সময় পাকিস্তান লাহোর থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করেনি, যা অত্যন্ত ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’। ফলে ভারতকে হামলার সময় ‘চূড়ান্ত সতর্কতা’ অবলম্বন করতে হয়েছে।