ক্রীড়া ডেস্ক : গ্যালারির গুটিকয় সমর্থক জিম্বাবুয়ের পতাকা হাতে বিজয় সঙ্গীত গাওয়া শুরু করেছেন তখন। পাশেই জিম্বাবুয়ের ডাগআউট, সেখানে ক্রিকেটার ও স্টাফদের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। প্রয়োজন কেবল ১ রান! মিচেল স্টার্কের বল কাভারে ঠেলেই ব্যাটসম্যান ব্র্যাড ইভান্সের আনন্দ চিৎকার, উইকেটে তার সঙ্গী রেজিস চাকাভার মুখেও বিশ্বজয়ের হাসি। ওই শটে ধরা দিল ইতিহাস গড়া জয়। পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াকে তাদের মাঠেই হারিয়ে দিল জিম্বাবুয়ে। আগের ম্যাচেই ৯৬ রানে গুটিয়ে যাওয়া জিম্বাবুয়ে ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতল ৩ উইকেটে। তিন সংস্করণ মিলিয়েই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ায় জিম্বাবুয়ের প্রথম জয় এটি। টাউন্সভিলে শনিবার ঐতিহাসিক এই জয়ের ভিত গড়ে দেন জিম্বাবুয়ের বোলাররা। পেসাররা শুরুতে অস্ট্রেলিয়াকে চাপে ফেলার পর পার্ট টাইম লেগ স্পিনার রায়ার্ন বার্ল বিস্ময় উপহার দেন স্রেফ ৩ ওভারে ১০ রানে ৫ উইকেট নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপ গুটিয়ে যায় ১৪১ রানেই। ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার স্রোতের বিপরীতে খেলে একাই করেন ৯৬ বলে ৯৪! ছোট সেই রান তাড়া সহজ হয়নি জিম্বাবুয়ের জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত স্নায়ুর চাপকে জয় করে তারা লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ১১ ওভার বাকি রেখে। ৩৭ রানের অপরাজিত ইনিংসে দলকে শেষের বৈতরণী পার করান অধিনায়ক রেজিস চাকাভা।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ে হেরেছিল কিছুটা লড়াই করে, দ্বিতীয় ম্যাচে পাত্তাই পায়নি তারা। শেষ ম্যাচেও পরিষ্কার ফেবারিট হয়ে মাঠে নামে অস্ট্রেলিয়া। সিরিজ জিতে গেলেও একাদশে কোনো পরিবর্তন না এনে শেষ ম্যাচে পূর্ণশক্তির দল নিয়েই নামে অ্যারন ফিঞ্চের দল, হয়তো আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগের পয়েন্টের কারণে। কিন্তু এ দিন শুরু থেকেই অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরে জিম্বাবুয়ে। প্রথম ৪ ওভারে দুই বাউন্ডারির পরও রান আসে স্রেফ ৯। পঞ্চম ওভারে রিচার্ড এনগারাভা আরও একবার ফিরিয়ে দেন ফিঞ্চকে (৫)। সিরিজের তিন ম্যাচে এনগারাভার ২২ বল খেলে স্রেফ ৬ রান করে ৩ বারই আউট হলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। পরের ওভারেই ভিক্টর নিয়াউচির ভেদরে ঢোকা বল ছেড়ে দিয়ে এলবিডব্লিউ হন তিনে নামা স্টিভেন স্মিথ (১)। ৬ ওভার শেষে অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল ২ উইকেটে ১০। এরপর ওয়ার্নারের পাল্টা আক্রমণ। এনগারাভার ওভারে তিনটি বাউন্ডারি মারেন তিনি, নিয়াউচির ওভারে দুটি। কিন্তু আরেক পাশে অ্যালেক্স কেয়ারিকে (৪) ফিরিয়ে দেন ব্র্যাড ইভান্স। এরপর এই ধারাই চলতে থাকে। এক পাশ থেকে দ্রুত রান তুলতে থাকেন ওয়ার্নার। আরেক পাশে পড়তে থাকে দ্রুত উইকেট! মার্কাস স্টয়নিস ও ক্যামেরন গ্রিনও টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ।
৭২ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন ওয়ার্নার ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। এই দুজনের ব্যাটিংয়ের সময়ই প্রথমবার একটু চাপে মনে হয় জিম্বাবুয়েকে। তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব বার্লের। জুটি ভাঙার জন্য এই পার্ট টাইম লেগ স্পিনারকে বোলিংয়ে আনেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক। ফল আসে দ্রুতই। বার্লের তৃতীয় বলেই স্লগ করতে গিয়ে ম্যাক্সওয়েল ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ১৯ রান করে। থেমে যায় ৫২ বলে ৫৭ রানের জুটি। এক বল পরই বার্লের ফুল টসে সহজ ক্যাচ দেন অ্যাশটন অ্যাগার। নিজের পরের ওভারে বার্ল ফিরিয়ে দেন মূল বাধা হয়ে থাকা ডেভিড ওয়ার্নারকেও। ছক্কায় সেঞ্চুরি ছোঁয়ার চেষ্টায় স্লগ সুইপ করে মিড উইকেটে ধরা পড়েন ওয়ার্নার। দলের ১৩৫ রানের মধ্যে এই ওপেনারের একার রানই তখনই ৯৪! তার ৯৬ বলের ইনিংস গড়া ১২ চার ও ২ ছক্কায়। বার্ল তার তৃতীয় ওভারে মিচেল স্টার্ক ও জশ হেইজেলউডকে ফিরিয়ে শেষ করে দেন অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। ৩ ওভারে ১০ রানে ৫ উইকেট। ওয়ানডে ইতিহাসে আর কোনো বোলার এক ম্যাচে ৩ ওভারে ৫ উইকেট পাননি। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে আগের ৮৩ ম্যাচে ৪ উইকেটই পেয়েছিলেন তিনি স্রেফ একবার। জয়ের আশা নিয়ে রান তাড়ায় নেমে জিম্বাবুয়ের শুরুটা হয় বেশ ভালো। টাডিওয়ানাশে মারুমানি ও টাকুডজোয়ানাশে কাইটানো ৮ ওভারে ৩৭রান তুলে ফেলেন। এরপরই হেইজেলউড নাড়িয়ে দেন জিম্বাবুয়েকে। কাইটানো ফিরিয়ে (১৯) জুটি ভাঙার পর এই পেসার পরপর দুই বলে ফেরান ওয়েসলি মাধেভেরে (২) ও অভিজ্ঞ শন উইলিয়ামসকে (০)। ওয়ানডেতে উইকেটের সেঞ্চুরিও পূর্ণ হয় তার।
বড় ভরসা সিকান্দার রাজা ৮ রান করে আউট হন মার্কাস স্টয়নিসকে পুল খেলে। এক প্রান্ত আগলে রাখা মারুমানিকে (৩৫) যখন থামান ক্যামেরন গ্রিন, অস্ট্রেলিয়ার সম্ভাবনা তখন ভালোমতোই জেগে ওঠে। জিম্বাবুয়ের রান ৫ উইকেটে ৭৭। অধিনায়ক চাকাভা সেখান থেকেই হাল ধরেন শক্ত হাতে। টনি মুনিয়োঙ্গার (১৭) সঙ্গে তার ৩৮ রানের জুটিতে চাপ কেটে যায় অনেকটা। বোলিংয়ের পর নিজের আসল কাজ ব্যাটিংয়েও কিছুটা অবদান রাখেন বার্ল। শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি, তবে একটি করে চারও ছক্কা মেরে তিনি দলকে এগিয়ে নেন জয়ের কাছে। বার্লকে ফিরিয়ে রেকর্ড গড়ে ২০০ উইকটে পা রাখেন মিচেল স্টার্ক। ওয়ানডেতে দ্রুততম ২০০ উইকেটের কীর্তি গড়েন তিনি (১০২ ম্যাচে)। তবে মাইলফলক উদযাপনের সুযোগ কোথায়, জিম্বাবুয়ে তখন জয়ের কাছে! ইভান্সকে নিয়ে বাকি কাজ শেষ করেন চাকাভা। জিম্বাবুয়ের ডাগ আউটে আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন সিকান্দার রাজা। বাঁধনহারা উদযাপনে মাতেন অন্যরাও। আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগে ২১ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের স্রেফ চতুর্থ জয় এটি। ১৫ ম্যাচে ৯ জয় ও ৬ পরাজয়ে ৯০ পয়েন্ট পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান আপাতত সপ্তম।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে জিম্বাবুয়ের ইতিহাস
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ