শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে দেখভালকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান হলো পরিবেশ অধিদপ্তর। তারা রাজধানীতে দূষণের বিস্তৃতি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি জানে। আর এ বিস্তৃতি রোধে গবেষণাও এবং প্রয়োজনীয় বিধিমালা সংশোধনের কাজ করছে বলে জানিয়েছে। ক্যাপস গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটির করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের এলাকায় ৪৫টি স্থান। গবেষণায় তাইওয়ানের তৈরি স্বয়ংক্রিয় শব্দের মাত্রা পরিমাপক যন্ত্র অটোমেটিক সাউন্ড লেভেল মিটার ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
গবেষণায় যে ফলাফল পাওয়া গেছে: শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শ মান (সর্বোচ্চ সীমা) ৬০ ডেসিবেল। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো নিউমার্কেট মোড়, নয়া পল্টন মোড় এবং প্রেসক্লাব মোড়। সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ১০০ দশমিক ৬৫ ডেসিবেল, ৯২ দশমিক ২২ ডেসিবেল এবং ৯০ দশমিক শূন্য ৩ ডেসিবেল। দক্ষিণ সিটির সড়কের সংযোগস্থলে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া জায়গাগুলো হলো আবুল হোটেল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় এবং জিরো পয়েন্ট মোড়। এই তিন এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ২৭ ডেসিবেল, ৭৭ দশমিক ৯২ ডেসিবেল এবং ৭৭ দশমিক ৬০ ডেসিবেল।
গবেষণায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড মোড়, শিয়া মসজিদ মোড় এবং মাসকট প্লাজা মোড়। এসব স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৯৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবেল, ৯৩ দশমিক শূন্য ৫ ডেসিবেল এবং ৯০ দশমিক ২৭ ডেসিবেল। উত্তর সিটির যেসব সড়কের সংযোগস্থলে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে সেগুলো হলো মিরপুর বেড়িবাঁধ মোড়, রবীন্দ্র সরণি মোড় এবং গুলশান-২ মোড়। এসব স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল, ৭৫ দশমিক ২৫ ডেসিবেল এবং ৭৬ দশমিক শূন্য ১ ডেসিবেল।
ঢাকায় শব্দদূষণের ক্ষেত্রে যেসব উৎসের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো সাধারণত যানবাহন চলাচলের শব্দ (হর্ন, ইঞ্জিন, চাকার ঘর্ষণ ও কম্পনের শব্দ), নির্মাণকাজ যেমন ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন ও টাইলস কাটার মেশিন থেকে শব্দ, ভবন ভাঙার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, সামাজিক নানা অনুষ্ঠানের মাইকিংয়ের শব্দ।
এর আগে ২০১৭ সালে ক্যাপস শব্দদূষণ নিয়ে একটি গবেষণা করেছিল। সর্বশেষ করল গত জানুয়ারি মাসে। দুই গবেষণার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আগের চেয়ে দূষণ তো বেড়েছেই। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো ঢাকার শব্দদূষণের সময়ের বিস্তৃতি বেড়েছে। এর উদাহরণ দিতে গিয়ে কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ২০১৭ সালে দেখা গেছে, ঢাকায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ থাকত দিনের ১২ ঘণ্টা। এখন সেটি ১৪ ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে।
ঢাকার চারটি এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের ১০০ সদস্যের ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, তাঁদের ২০ শতাংশ মারাত্মক বধিরতার সমস্যায় ভুগছেন
কামরুজ্জামান মজুমদার বলছিলেন, ‘ঢাকা দূষণের উৎসগুলো কী, এখন তা পরিষ্কার। কিন্তু এগুলো রোধে এখন কার্যকর পদক্ষেপ দরকার। আর তা যত দ্রুত সম্ভব, তা করা দরকার। কারণ, শব্দদূষণের কারণে আমরা জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছি। এটি সত্যি নীরব ঘাতক।’
শব্দদূষণে যেসব ক্ষতি: একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, বধিরতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কম ঘুম হওয়া, হৃদ্রোগ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘœ হওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। স্বল্পমেয়াদি শব্দদূষণ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি শব্দদূষণ শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার ফলে বিরক্তি, নেতিবাচকতা, রাগ, ক্লান্তি, চাপা উত্তেজনা, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, সামাজিক কর্মকা- পরিহার, ব্যক্তিগত ঝুঁকি বাড়ায় এবং স্মৃতিশক্তি ও নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা হ্রাস পায়। অন্যদিকে উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা, হৃদ্রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শব্দদূষণের ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহের রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে, পরিপাকে বিঘœ ঘটায়, শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রচ- চাপ দেয়।
রাজধানীতে শব্দদূষণের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (নাক কান গলা) মো. হাসানুল হক। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, তাঁর কাছে যেসব রোগী আসে, তাদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি কানের সমস্যা নিয়ে আসে। এদের মধ্যে ৩০ শতাংশ কানে কম শুনতে পায়। মো. হাসানুল হক ২০১৯ সালে ঢাকা শহরের ট্রাফিকদের ওপর করা এক গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। ঢাকার চারটি এলাকার ট্রাফিক পুলিশের ১০০ সদস্যের ওপর পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা যায়, ২০ শতাংশ মারাত্মক বধিরতার সমস্যায় ভুগছেন। এতে এসব ব্যক্তি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ছিলেন। তাঁদের জটিল হৃদ্রোগের আশঙ্কাও করা হয়।
সরকার কী করছে: শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক প্রকল্প’ নামের একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা শহরের শব্দদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যে একটি গবেষণা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক সৈয়দা মাছুমা খানম। তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা)। ঢাকা শহরের দূষণের সময়ের বিস্তৃতি বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটি নিয়ে সৈয়দা মাছুমা খানম বলেন, ‘শব্দদূষণের এ অবস্থার চিত্র পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাতেই পাওয়া গেছে। আমাদের হাতে এখন গবেষণার ফল আছে। কিন্তু আমরা এর নিয়ন্ত্রণে একাধিক কর্মসূচি নিয়েছি। এর প্রথম উদ্যোগ হিসেবে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ সংশোধন হবে। একটি সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে আমাদের কাজে বিআরটিএ এবং ট্রাফিককে যুক্ত করা হবে।’
ঢাকা নগরের শব্দদূষণে প্রধান উৎস যানবাহন। এর তদারকির কাজে আছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ‘বায়ুদূষণ বা শব্দদূষণ রোধে ধারাবাহিক তৎপরতা থাকতে হবে। এর দায়িত্বে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। কিন্তু দূষণ বন্ধে আমাদের সব সময় সচেষ্ট থাকা সম্ভব হয় না। কারণ, এতে লোকবল লাগে, তাতে আমাদের ঘাটতি আছে।’
অসহনীয় ঢাকার শব্দদূষণ
ট্যাগস :
অসহনীয় ঢাকার শব্দদূষণ
জনপ্রিয় সংবাদ