তাহমিদা ফাতেমা চৌধুরী : ছোটবেলায় বড় ভাইয়া-আপুদের দেখে কলেজজীবন নিয়ে আমিও নানা স্বপ্ন দেখতাম। বাসার পাশেই মুরারিচাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ), তাই এই ক্যাম্পাসে পড়ার ইচ্ছাটা বহু পুরোনো। কিন্তু সেই স্বপ্নের কলেজে পা রাখার ছয় মাস না পেরোতেই এল করোনার আঘাত। ভীষণ অনিশ্চয়তায় আমার অল্প কদিনের কলেজজীবনের স্মৃতিও ঝাপসা হতে শুরু করল। এখন মনে হয়, সে বহুদিন আগের কথা।
তারপর একদিন জানতে পারলাম, পৃথিবী পুরোপুরি সুস্থ না হলেও এখন আমরা বাইরে বেরোতে পারব। ঘোষণা এল—আমাদের কলেজও নাকি খুলবে। খুলছে, খুলবে…করে করে কাটল আরও কয়েক মাস। অবশেষে দীর্ঘ দেড় বছর পর কলেজে ফিরে দেখা হলো পুরোনো মুখগুলো। সাধারণত কলেজজীবন হয় দুই বছরের। আমরা বোধ হয় সাকল্যে সাত মাসও পাইনি। তাই বন্ধুর সংখ্যা তুলনামূলক কম।
তবু সবাই মিলে ঠিক করলাম—শুরুটা যেমনই হোক, শেষটা আমরা সুন্দর করব। দেখতে দেখতে কলেজকে বিদায় দেওয়ার সময় চলে এল। এদিকে সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। টেস্ট পরীক্ষাও শুরু হয়ে গেল, তাই হাতে সময় খুব কম। আমরা ঠিক করলাম, যেদিন টেস্ট পরীক্ষা শেষ হবে, সেদিনই করব কলেজের বিদায়ী অনুষ্ঠান। আমরা যারা মুরারিচাঁদ কলেজে পড়ি, গর্ব করে নিজেদের বলি মুরারিয়ান। মুরারিয়ানদের ইতিহাসে আমরাই প্রথম ব্যাচ—যারা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে কোভিডের টিকা নিয়েছি, বিদায় অনুষ্ঠান করেছি, ফ্ল্যাশ মব করেছি, নাচ–গান করেছি, আর দিন শেষে গোপনে লুকিয়েছি চোখের জল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো—এই একটা দিন আমরা স্মরণীয় করে রেখেছি একই সঙ্গে ভীষণ আনন্দ, আবার ভীষণ দুঃখ নিয়ে।
বিদায়ী অনুষ্ঠানের দিনে ছোটখাটো নানা মজার বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সবাই মিলে করা ফ্ল্যাশ মবটি। পড়ালেখার নানা ব্যস্ততার মধ্যেও মাত্র দেড় দিনের প্রস্তুতিতে আমরা সফলভাবে ফ্ল্যাশ মবটা করতে পেরেছি। মাত্রই রসায়ন পরীক্ষা দিয়ে বেরোনো ক্লান্ত মানুষগুলোর অসীম উদ্যম আর ইচ্ছাই আয়োজনটিকে সুন্দর করেছে। সেদিনের প্রতিটি বিষয়ই ছিল চমকপ্রদ। নিজের প্রিয় ক্যাম্পাসের সাজানো–গোছানো সৌন্দর্য দেখে বারবার মুগ্ধ হচ্ছিলাম। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে একজন আরেকজনের টি–শার্টে আঁকিবুঁকি করা—সবই ছিল উৎসবমুখর। এত আনন্দ বোধ হয় এই কারণেই যে এই আনন্দে মাখা সুন্দর স্মৃতিই আজীবন আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে। এত আনন্দ, আবেগ, ভালোবাসা মাখা সময়টা কেন এত সংক্ষিপ্ত হলো, তা নিয়ে আক্ষেপও রয়ে গেল। তবে এই অল্প সময়ে বন্ধুত্বটা আরও গভীর হয়েছে, দীর্ঘদিনের দূরত্বের পরও একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
আমাদের কলেজের শিক্ষকদের কথা না বললেই নয়। বিশেষত আমাদের বাংলা শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম স্যার, উপাধ্যক্ষ পান্না রাণী রায়, অধ্যক্ষ মো. সালেহ আহমদ স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই হয়। আমরা যখন যা করতে চেয়েছি, তাঁরা ছায়ার মতো পাশে থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন, আগলে রেখেছেন। অগ্রজেরাও নিজেদের জায়গা থেকে পাশে থেকেছেন।
কলেজজীবনের শেষে এসে যে শিক্ষা আমি পেয়েছি, তার মধ্যে একটি হলো—জীবন কখনো থেমে থাকে না। অনেক ঝড়–ঝঞ্ঝা আসবে, তবু জীবনের একেকটা অধ্যায়ে নতুন নতুন সম্পর্কগুলোই তো আমাদের সম্বল। কলেজজীবন পেরিয়ে আমরা সামনে চলে যাব, কিন্তু এই বন্ধুত্ব থাকবে। শিক্ষকদের স্নেহ, ভালোবাসা, আশীর্বাদ আমাদের সঙ্গে থাকবে।
ভালো থাকুক প্রিয় মানুষগুলো, প্রিয় ক্যাম্পাস। বহুদিন পর আবার যখন দেখা হবে, আমরা হয়তো ‘কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’ ভেবে স্মৃতিকাতর হব। গোপনে হয়তো আবার চোখের জল মুছব।
লেখক: শিক্ষার্থী, মুরারিচাঁদ কলেজ, সিলেট
অল্প দিনের কলেজজীবন, গল্প তবু কম নয়
ট্যাগস :
অল্প দিনের কলেজজীবন
জনপ্রিয় সংবাদ