মো. মাঈন উদ্দীন : শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের অর্থনীতির প্রতিটি সেক্টরে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থপাচারের বহুরুপী চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। ফলে অর্থনীতিতে দেখা দেয় নানা শূন্যতা। এতে অর্থনীতির গতি পরিবর্তন লক্ষণীয়।
অন্যদিকে সরকার আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় জনভোগান্তি বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।
বাড়ছে ব্যবসা খরচ। কমে যাচ্ছে টাকার মান। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে বরং আরও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে ভোক্তার আয় কমায় পণ্য বিক্রি কমে গেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্য খাতে। এর পাশাপাশি শিল্পের খরচ বেড়ে গেছে। শিল্প টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। পণ্যমূল্য বাড়ায় মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। এ প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ব্যবসায়ীসহ সাধারণ জনগণ।
পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করে আইএমএফ এর সঙ্গে। চুক্তি হওয়ার আগে থেকেই সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে শর্ত বাস্তবায়ন শুরু করে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে জনজীবনে। ঋণ গ্রহণের পরও শর্ত বাস্তবায়ন করতে গ্যাস, বিদ্যুৎ, সারসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়তে থাকে। ফলে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। ভোক্তার ভোগান্তি বাড়ে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত তারা আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করে গেছে। এতে পণ্য ও সেবার মূল্য যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি। চড়া মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে মূলত আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করা হলেও মূল্যস্ফীতি কমেনি, উল্টো বেড়েছে। অর্থনৈতিক সংকটও কাটেনি, বরং সংকটের প্রভাব অর্থনীতিতে আরও প্রকট হয়েছে। থামানো যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। আগে ঋণের সুদের হার ছিল সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এখন বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ করা হয়েছে।
কোনো কোনো খাতে আরও বেশি। ডলারের দাম ২০২২ সালের শুরুতে ছিল ৮৬ টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় নেওয়ার সময় এর দাম ছিল ১১৮ টাকা। কিন্তু বাজারে এই দামে ডলার মিলছিল না। আমদানিতে ডলার কিনতে হয়েছে সর্বোচ্চ ১৩০ থেকে ১৩২ টাকা করে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আসতে পারে। এরপর থেকে ঋণের সুদের হার কমানো হবে। জনগণ কিন্তু সংস্কার, সংবিধান সংশোধন এমনকি প্রশাসনের রদবদল যাই হোক না কেন তারা চায় তাদের যেন ভোগান্তি না হয়। ব্যবসা করতে, চাকরি পেতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে ও ন্যায়বিচার পেতে যাতে হয়রানি না হয়।
পতিত স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে জনগণ যেন কাঙিক্ষত সেবা পায়, মানবাধিকার ফিরে পায়। এদিকে আইএমএফের শর্ত পালন করতে ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। এটি কমাতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম বাড়ানোর ফলে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে ভোক্তাকে জীবনযাত্রার মান কমাতে হয়েছে, যা মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। এটা জনগণ কামনা করে না।
বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশ। যেখানে রয়েছে স্থিতিশীল বাজার অর্থনীতি। এই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে রয়েছে মধ্যম হারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, পরিব্যাপ্ত দারিদ্র্য, আয় বণ্টনে অসমতা, শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য বেকারত্ব, জ্বালানী, খাদ্যশস্য এবং মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য আমদানি নির্ভরতা, জাতীয় সঞ্চয়ের নিম্নহার, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমহ্রাসমান নির্ভরতা এবং কৃষি খাতের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সেবা খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জনে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পের মধ্যে অন্যতম। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এসময় পাট রফতানি করে দেশটি অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত।
গত চার-পাঁচ বছরে বৈশ্বিক নানা ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ বাংলাদেশ অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। যেমন: দেশজ অর্থনীতির প্রেক্ষিতে, যেখানে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
অতিমারীর কারণে সরকারি সম্পদের একটি বিরাট অংশ অতিমারী মোকাবেলায় ব্যয়িত হচ্ছিল। ফলে দেশের উৎপাদন খাত ও সামাজিক খাতে সম্পদের ঘাটতি পড়ে যায়।
অন্যদিকে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ অতিমারী বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উদাহরণস্বরূপÑ কোভিড ১৯-এর কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উৎপাদন ও রফতানি উভয়ই ব্যাহত হয়। এসব কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি গতিধারায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। এরপরই এলো ইউক্রেন যুদ্ধ, যা বৈশ্বিক জোগান ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়। ফলে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানির মূল্য বেড়ে যায়। যেহেতু বাংলাদেশ খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানি দুটিই আমদানি করে, ফলে এ দুই সামগ্রীর বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকেও বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বিঘ্নিত হয়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের মোট দেশজ উৎপাদন বা অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি তথ্য নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমানের অবস্থা বোঝা যায় না কিংবা মূল্যায়ন করা যায় না সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত অবস্থা। অর্থনীতিতে নানা সমস্যা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের অর্তনীতিতে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধি প্রবণতা অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষকেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। কারণ পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ের যে তথ্য, ডেটা; এর কয়টি বিশ্বাসযোগ্যতা আছে, তা নিয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। তবে যে যাই বলুন না কেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৫তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯তম; যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়।
বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে ৬.৩ শতাংশ হার ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের ৭ম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারার কথা বলতে গেলে বলতে গেলে তিন ভাগে সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের অর্থনীতি, তার আগের অর্থনীতি ও ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী অর্থনীতি।
বিগত সময়ে স্বপ্ন দেখিয়ে রূপকল্প ঘোষণা করেছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। নানা কথামালার ফুলঝুরি আর পরিসংখ্যান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থনীতির নানা সূচককে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে উন্নত রাষ্ট্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে এমন প্রচার-প্রপাগাণ্ডা ছিল তুঙ্গে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু হাসিনার সরকার অপ্রয়োজনীয় নানা প্রকল্পে উদারহস্তে ঋণ গ্রহণ করে ১০৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণের ভার এ দেশের সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপিয়ে গেছে। অন্যদিকে অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
জনগণ চায় একটি সুষম অর্থনীতি; যেখানে সাধারণ জনগণ স্বস্তি পায়। বিনিয়োগে গতি আসুক, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাক। অর্থনীতির বড় অনিশ্চয়তা এখন উৎপাদন খাতে। নানা রকম উদ্যোগের পরও সবচেয়ে বড় রফতানি শিল্প পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুর রয়ে গেছে। জুলাই মাস থেকে পোশাকশিল্প এলাকা শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা গেছে।
সম্প্রতি পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও তা টেকসই হয়েছে কি না, সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। পোশাকশিল্পের মালিকদের সমিতি জানিয়েছে, তাদের উৎপাদন ও রফতানিতে যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনই কিছু ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।
বর্তমানে অর্থনীতির এহেন হযবরল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সমাধান বের করতে হবে সরকারকে। দুর্নীতি, পুঁজি-লুণ্ঠন এবং পুঁজিপাচারের বিরুদ্ধে অবিলম্বে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে জোর দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হবে, ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভর না করে পুঁজিবাজারকেও এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার