- সুখদেব কুমার সানা
চার মাসের দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে গতকাল মঙ্গলবার (৬ মে) দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে গুলশানের ফিরোজা ভবনে ফিরে এলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকদিন ধরেই গুঞ্জন ছিল- তিনি আর ফিরবেন না, হয়তো দেশের মাটিতে আর রাজনীতি করবেন না। সেই সব গুজব, সন্দেহ আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রীতিমতো রাজকীয় প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। হাজার হাজার নেতাকর্মী ও লাখো জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হলেন তিন তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া।
চিকিৎসা শেষে রাজকীয় মর্যাদায় তিনি দেশে ফেরেন কাতারের আমিরের দেওয়া একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে। বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে হাজার হাজার নেতাকর্মী জড়ো হন তাকে শুভেচ্ছা জানাতে। বহু মানুষ সকালে রওয়ানা দিয়ে দুপুরে এসে দাঁড়ান ফিরোজার সামনের রাস্তায়। কারো হাতে ছিল ফুল, কেউ আবার এনেছিলেন নেত্রীর ছবি। কান্নাভেজা চোখে অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ‘আমাদের মা ফিরে এসেছেন’, ‘খালেদা জিয়া মানেই বাংলাদেশ’। মানুষের চোখে যেন আনন্দ অশ্রু!
কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী থামাতে পারেনি জনআবেগ: ফিরোজার সামনের রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী ছিল। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবের সদস্যরা তৎপর থাকলেও নেতাকর্মীদের আবেগ থামানো যায়নি। হেঁটে হেঁটে কেউ এসেছেন টঙ্গী থেকে, কেউ বা নারায়ণগঞ্জ থেকে, অনেকে বরিশাল থেকে, খুলনা থেকে, এভাবে সারা দেশ থেকেই কমবেশি মানুষ এসেছেন তাদের প্রিয় নেত্রীকে দেখতে। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিলেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে। দুপুরে গুলশান-বনানী এলাকাজুড়ে মানুষের জট লেগে গিয়েছিল।
ভালোবাসার জনস্রোত: দেশে ফিরেই নেতাকর্মী ও সাধারণ জনতার ভালোবাসায় সিক্ত হন খালেদা জিয়া। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবনে ফিরতে রাস্তার দুই পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা হাতে তাকে অভিবাদন জানান লাখো নেতাকর্মী। গাড়ি বহরের পেছনে মোটরসাইকেল বা হেঁটে না আসার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, জনস্রোতের কারণে তা ঠেকানো যায়নি। বিশেষ করে গুলশানে প্রবেশের পর দলীয় চেয়ারপারসনের প্রতি ভালোবাসায় অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। স্লোগান দিতে দিতে নেমে পড়েন মূল সড়কে। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। বিএনপির নেতাকর্মী ছাড়াও আশপাশের উঁচু ভবনের বাসিন্দারাও হাত নেড়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিজেদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান।
এর আগে মঙ্গলবার (৬ মে) সকাল সাড়ে ১০টা ৩৮ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে খালদা জিয়াকে বহনকারী বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকতা সেরে গুলশানের পথে রওনা দেন তিনি। দলীয়প্রধানকে বরণে অনেকে সকাল থেকেই বিমানবন্দর থেকে গুলশান-২ এর ৮০ নম্বর সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধ অবস্থান নেন। জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি প্রদর্শন করেন অনেকেই। স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় পৌঁছে বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়িবহর। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে তার সফরসঙ্গীদের ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গুজব ছিল, ফিরবেন না: বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশ যাত্রার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন ছিল, এটাই সম্ভবত তার শেষ বিদায়। অনেকেই বলেছিলেন, খালেদা জিয়া ‘মাইনাস টু’র শিকার হয়েছেন। তিনি আর ফিরবেন না। তবে এই প্রত্যাবর্তনে গুজবের অবসান হলো। নেতাকর্মীরা বলছেন, ‘গণতন্ত্র আবার আশার আলো দেখছে।’ এদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলগমীর বলেছেন, গণতন্ত্র উত্তরণের এই সময়ে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
জিয়ার বাবুর্চির হাতে বিশেষ রান্না: দীর্ঘদিন পর দুই পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফেরার উপলক্ষ্যে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনে আয়োজন করা হয় বিশেষ ভোজের।
গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বাবুর্চি এই বিশেষ ভোজের আয়োজন করেছেন। জিয়াউর রহমান স্যারের সময় থেকে যিনি রান্না করতেন, তিনিই আজ রান্না করেছেন। তবে, শায়রুল কবির খান বিশেষ ভোজের মেন্যু সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, বিশেষ কোনো রান্না আছে কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না।
ঘটনাক্রম: উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরদিন ৮ জানুয়ারি হিথ্রো বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বড় ছেলে তারেক রহমান ও পরিবারের সদস্যরা। সেখান থেকে সরাসরি দ্য লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন তিনি। ১৭ দিন চিকিৎসার পর বড় ছেলের বাসায় উঠেন। পরবর্তীতে সেখানেই তার চিকিৎসা কার্যক্রম চলে।
সোমবার (৫ মে) স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৪টায় কাতারের আমিরের দেওয়া রয়্যাল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। তার সাথে দেশে এসেছেন দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামীলা রহমান সিঁথি এবং চিকিৎসক ও মেডিকেল বোর্ডের সদস্যসহ ১৩ জন।