নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করে ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সমাবেশে তোলা দাবিটি এবার সরাসরি সরকার প্রধানের কাছেই তুলে ধরল তারা। গতকাল শনিবার বিকালে সংলাপের থেকে বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা একটা রোড ম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন কবে নির্বাচন করবে সে ব্যাপারে একটা রোড ম্যাপ দিতে বলেছি।” বেলা আড়াইটা থেকে এক ঘণ্টা ফখরুলের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করেন। সংলাপে ছয় সদস্যের বিএনপির প্রতিনিধি দলের ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। এক ঘণ্টা বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়। বিএনপি মহাসচিব বলেন, “বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন সংস্কার কমিশনে না যায়, সে কথা আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি। আমরা ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের ‘ভুয়া ভোটে’ নির্বাচিত সকল ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করতে বলেছি। “২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যেসব প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং কমিশনারসহ ছিল, তাদেরকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ নির্বাচন করার অভিযোগে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার কথা বলেছি।” ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর মির্জা ফখরুল বিভিন্ন দলের নেতাদেরকে নিয়ে প্রথমে সেনাপ্রধান ও পরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি সংবিধান ভেঙে দেবেন এবং ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তবে রাষ্ট্রপতি সংবিধান ভেঙে দিলেও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে কিছু বলেননি। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি জনগণকে ধৈর্য ধরার কথা বলেন। পাশাপাশি নির্বাচনের জন্য তার প্রত্যাশিত সময়সীমা তুলে ধরে তিনি বলেন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’ ঘটা উচিত। তবে গত ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। “সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমতে উপনীত হওয়া এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ বলা হবে।” ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ব্রিফিংয়ে দাবি করেছেন সেনাপ্রধানের বক্তব্য ‘ব্যক্তিগত মত’। তিনি বলেন, “এটা রাষ্ট্র মেরামতের একটা কাজ। কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে রাজনৈতিক কনসালটেশন এবং এরপর বাংলাদেশের জনগণ, সমাজ, অন্যসব স্টেকহোল্ডার যখন সেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, তখন ইলেকশনের দিকে যাওয়া হবে। “এটা কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।” মির্জা ফখরুল গত ২৪ অগাস্ট থেকেই বিভিন্ন সমাবেশ ও সেমিনারে নির্বাচন দেওয়ার দাবি করে আসছিলেন। ‘কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারে’ বিশ্বাস নেই জানিয়ে নির্বাচন নিয়ে অতি দ্রুত সংলাপ দাবি করেন তিনি। সম্প্রতি তিনি এমনও বলেছেন. দ্রুত নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রে ফিরতে দেরি হলে ‘অন্য ব্যবস্থা’ চেপে বসবে।
ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ শেষে বিএনপি নেতা বলেন, “উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদেরকে বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান উনাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার।” বিএনপির দাবির বিষয়ে তিনি কী বলেছেন জানতে চাইলে জবাব আসে, “বিষয়গুলো অত্যন্ত সহযোগিতার সঙ্গে তারা দেখছেন। তারা মনে করেন আমাদের দাবিগুলো জনগণের দাবি, আমাদের দাবিগুলো তাদেরও দাবি।”
সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দাবি
তত্ত্বাবধায়ক সরকার অসাংবিধানিক উল্লেখ করে রায় দেওয়ার কারণে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ অভিযোগ আনার দাবিও জানিয়েছে বিএনপি। ফখরুলের অভিযোগ, বিচারপতি খায়রুলই ‘সংবিধান ধ্বংস ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের ‘মূল হোতা’। বিচার বিভাগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমরা বলেছি যে, হাই কোর্ট বিভাগে এখন পর্যন্ত পরিবর্তন হয়নি। হাই কোর্ট বিভাগে বেশিরভাগ নিয়োগই ছিল ‘দলীয় ভিত্তিতে’ এবং প্রায় ৩০ জন বিচারক বহাল তৈবিয়তে কাজ করছেন এখনও। এদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি। কিছু বিচারককে ‘দলকানা’ আখ্যা দিয়ে ফখরুল বলেন, “তাদের অপসারণের কথা বলেছি। একই সঙ্গে অতি দ্রুত পিপি ও জিপি নতুনভাবে নিয়োগ দেয়ার কথা বলেছি।” প্রশাসনে ‘ফ্যাসিবাদের অনেক দোসর’ কর্মরত আছেন অভিযোগ করে তাদেরকে অপসারণ, ডিসি নিয়োগে নতুন ফিট লিস্ট এবং যেসব ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের নিযোগ বাতিল, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের দাবি তোলার কথাও জানান বিএনপি মহাসচিব। ফখরুল বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দুই একজন আছেন যারা বিপ্লব-গণঅভ্যুত্থানের যে মূল স্পিরিট তাকে ব্যাহত করছে তাদেরকে সরানো কথা বলেছি। “আমরা গত ১৫ বছর ধরে পদোন্নতির বঞ্চিত সরকারি কর্মকর্তাদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি নিশ্চিত করার জন্য বলে এসেছি।”
‘দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে কীভাবে’
সাবেক মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন উল্লেখ করে বিএনপি নেতা বলেন, “কীভাবে পালিয়ে যাচ্ছে, কার সহযোগিতায় পালাচ্ছে, এই বিষয়গুলো দেখার জন্য বলেছি। “আজকে ‘পতিত স্বৈরাচার’ শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। ভারতে থেকে তাকে কেন্দ্র করে, তার মাধ্যমে যে সমস্ত ক্যাম্পেইন চলছে, যে সমস্ত ‘অপপ্রচার’ চলছে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে ভারতের সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য এবং তাকে ( শেখ হাসিনা) ওই অবস্থা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছি; তারা যেন ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে।”
যাদেরকে দুর্নীতি ও হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে বিএনপি নেতা বলেন, “এটা খুব উদ্বেগজনক। এই বিষয়টা আমরা দেখার জন্য বলেছি।“২০০৭ সালে থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে সকল মিথ্যা, ‘গায়েবি’ মামলা প্রত্যাহারের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা ও প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলেছি।” পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টির পেছনে কারা আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ‘গুম-খুনের’ সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিও জানান বিএনপি নেতা। “জাতিসংঘের একটি দল এসেছে বাংলাদেশে। সেই দলকে যারা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে জড়িত আছেন তারা জাতিসংঘের টিমকে সেইভাবে সহযোগিতা করছে না। বিষয় আমরা বলেছি।”
‘দুর্গা পূজা নিয়ে সুপরিকল্পিত উসকানি’
দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র সনাতনী ‘কিছু মানুষ’ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জনগণকে উসকে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ফখরুল। তিনি বলেন, “হিন্দু কমিউনিটির ওপর নির্যাতন হচ্ছে, ইত্যাদি কথা বলছে যা সর্বৈব মিথ্যা। এটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের ‘সুদূর পরিকল্পনা’। এই কথাগুলো গুরুত্বের সাথে বলেছি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।” অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর তৃতীয় দফা সংলাপ এটি। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট সংলাপ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মতবিনিময় করেন ইউনূস। এর আগে বেলা আড়াইটায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বসে বিএনপির প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাউদ্দিন আহমেদ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তার দুই দফা সংলাপ হয়। এটি তৃতীয় দফা সংলাপ।