ঢাকা ০৯:৫১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

অবজ্ঞা ও উপহাসসৃষ্ট রাজনৈতিক উত্তাপ ঠেকাবে কে?

  • আপডেট সময় : ০৯:১৮:১৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ অক্টোবর ২০২২
  • ৮৪ বার পড়া হয়েছে

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম : তিন অলস ব্যক্তি ঘুমিয়েছে একঘরে। সেই ঘরে আগুন লেগেছিল কিন্তু তারা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। প্রথমজন হঠাৎ জেগে ঘরের মধ্যে আলো দেখে বলল, আজ সূর্যটা এত তাড়াতাড়ি উঠলো কেন রে? দ্বিতীয়জন গায়ে কিছু একটার তাপ অনুভব করলে চেঁচিয়ে উঠে বলল, এই কাঁথাটা এত গরম কেন রে? তৃতীয়জন বলল, তোরা চুপ কর তো, আমার ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। জানিস না বিদ্যুৎ নাই, তাই ফ্যানটা ঘুরছে না। সেজন্য গরম লাগছে রে।
বাস্তবতা হলো সূর্য তখনো ওঠেনি, ফ্যানও ঘুরছিল। কিন্তু বিছানা ছেড়ে কেউ আর উঠলো না। অতি আলসেমির কারণে শেষ পর্যন্ত তিনজনই আগুনে দগ্ধ হলো। এটা একটা প্রাচীন গল্পের কথা। অলস ব্যক্তিদের অবহেলা ও কোন বড় জিনিসকে নিজের ভালো না লাগলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উপহাস করা এবং নিজের ও অপরের বিপদ ডেকে আনার পথ প্রশস্ত করে দেওয়ার উপমা।
সেদিন কয়েকটি জেলায় স্থলপথে অঘোষিত হরতাল হয়ে গেলো। পরিবহন সমিতির ওপর দায় দেওয়া হলেও সেটা ছিল শাসক দলের ইঙ্গিতের হরতাল। ময়মনসিংহ বিভাগে বিএনপির সম্মেলনের দিন হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়াই কিশোরগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার বাস চলাচল বন্ধ। পায়ে হেঁটে সমাবেশে আসতে থাকা লোকজনের ওপর পথে পথে বাধা। অগত্যা জলপথে নৌকায়, লঞ্চে, ট্রলারে করে সমাবেশে হাজির হলো হাজার হাজার সমর্থক।

এর আগে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠের জনসভায় লাখো জনতার উপস্থিতিকে জব্বারের বলি খেলায় উপস্থিত কিছু দর্শকের উপমা টেনে কৌতুক করতে ভুলেননি অনেকে। যারা টিপ্পনী কেটে প্রশান্তি লাভ করার চেষ্ট করছেন তারা যদি অন বা অফলাইনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাঠ করতেন বা দেখতেন তারা এমন তাচ্ছিল্য করতে উদ্যত হতেন না। তাদের অবস্থা হচ্ছে, ‘রোম পুড়ছে তবুও নিরো বাঁশি বাজাচ্ছে’-র মতো।

এত বড় সম্মেলন হচ্ছে তার জন্য দায়ী তারাই। কারণ, মৃতপ্রায় বিএনপিকে তাচ্ছিল্য করে পিন করতে করতে তারা ক্ষেপিয়ে তুলেছে কয়েক বছর ধরে। অনবরত খোঁচা খেতে খেতে বিএনপি সংগঠিত হয়ে উঠেছে। এখন তারা প্রকাশ্যে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করছে না। তারা বলছে আর জেল-জুলুমকে ভয়-ডর করবে না। মরণকেও আর পাত্তা দিতে চায় না। তারা পণ করেছে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার। তাদের সহযোগীরাও এতদিন আমতা আমতা করে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ করে সময় পার করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। কিন্তু তারাও বেশ সরব হয়েছে একই দাবি আদায়ের জন্য।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে সরকার সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দ্বী সহ্য করতে পারে না। প্রতিটি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে চায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে হামলা ও হয়রানিমূলক মামলার শিকার হতে হয়। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে।’ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের সমালোচনা করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা ইভিএমে নির্বাচনের বিরোধিতা করছি। কারণ ইভিএমে ঘোষিত ফলাফল চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয় না। কোনো প্রার্থী সংক্ষুব্ধ হলে, কোনো প্রমাণ নিয়ে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। … যারা ইভিএম পরিচালনা করেন তারা তো নিরপেক্ষ নয়।’

বাংলাদেশের কনিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক বলেছেন, ‘দেশে এখনো অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রতিনিধিত্বশীল ও অর্থবহ নির্বাচনের স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যারাই ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতায় থাকতে নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছে। … নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য সুনির্দিষ্ট কতগুলো বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়েছে।’

এতকিছু বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, তবুও শাসকদল মনে হয় খুবই আত্মবিশ্বাসী। একটি ছাপানো পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, অতি আত্মবিশ্বাস রাজনীতিতে ভালো নয়। রাজনীতির ঢেউ সকাল-বিকেলে ওঠানামা করে।

তবুও একজন বাঁকা হাসি হেসে মুখস্থ কথা বলেন। শিখিয়ে দেওয়া মুখস্থ কথার ধরন একই, প্রতিদিন অনুরূপ বাক্যচয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভারত বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা, গুজব, মাঠে নামলে কার কত শক্তি দেখা যাবে- ইত্যাদি মুখস্থ করা কথা। আবার কোনো বড় ঘটনা বা সভার সাধারণত: কোনটা ফ্লপ আর কোনটা হাউসফুল সেটা দর্শকরা বিচার করে থাকেন। একই দলের একজন ফ্লপ বললে অন্যজন সেটাকে তা মনে করেন না। কোনো কাজের জন্য মানুষ নিয়োগ বা ভাড়া করতে অবশ্যই টাকা লাগে। লাখ লাখ মানুষকে কি ভাড়া করা যায়? কোনো অনুমোদিত জনসভায় ভাড়াকৃত লাখ লাখ মানুষকে কি করে সন্ত্রাসী বলা যায়? তাহলে দেশে এত মানুষ সন্ত্রাসী হলে দেশ চলে কি করে?

তাদের অনবরত অতিকথনের ফলে বিএনপি এখন অনেক সংগঠিত হয়ে বজ্রকঠিন শপথ নিয়েছে। তাদের প্রতিহিংসা ও অনবরত তাচ্ছিল্যপনার জবাব দিতে বিএনপি একত্রিত হয়েছে। খুলনা সমাবেশের বহু আগে পরিবহন সমিতির ঘাড়ে চাপিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করা হলেও খুলনার নেতারা বলছেন, মন চাইলে পায়ে হেঁটেও দিল্লি বা মক্কা যাওয়া যায়। কোনো জনসভায় যাওয়ার জন্য এমন কঠিন পণ আগে কখনও শোনা যায়নি।

অন্যদিকে হঠাৎ করে সরকারি চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক অবসরের নামে তোলপাড় শুরু করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন এসব কিছুই হঠকারিতার শামিল এবং বিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে মানুষের ভোটধিকারের বিষয়টি। এখনও মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজ হাতে দিতে চায়। মেশিনের বোতাম টিপে নয়। ভোট মেশিনে মানুষের বড় সন্দেহ, বড় ভয়। কারণ মেশিনের পেছনের মানুষগুলো ডাকাত। সেটা কমিশনের লোকজনই বলে দিয়েছে। তারা ওদের ঘৃণ্যকাজ করতে দেখেছে, সেজন্য সম্প্রতি ভোট বাতিল করে সেটা প্রচারও করেছে।

চোরের থাপইতরা বড় ধড়িবাজ। চোরের থাপইত বা চোরের সোর্স ব্যবহার করে নিজের সুনাম বাড়ে না। চোর কারও বন্ধু হতে পারে না। কারণ চোরের বন্ধুকেও চোরের কর্মকা-ের জন্য অপমান ও শাস্তি পেতে প্রস্তুত থাকতে হয়। শুঁটকি মাছকে সাতবার ধৌত করে রান্না করলেও শুঁটকির গন্ধ দূর করা যায় না। তাই তো বলা হয়, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।

ইভিএম ব্যবহারের জন্য অতি খরচ, অতি ঝামেলা, অতি বিপদের আশঙ্কা, অতি সন্দেহ রয়েছে সিংহভাগ ভোটারের মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইভিএম নয়- প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা চাই। ভোট চলাকালীন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা ও সিসি ক্যামেরা চালু থাকলে পুরো ভোটের সময়টা ভিডিও করা যাবে। তাহলে কোন প্রার্থী অভিযোগ করলে ভিডিও দেখে তার যথার্থতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। কারণ ইভিএম মেশিনের মেমোরি সরানো নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ইতোমধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে। যার কোনো সদুত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। এত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও বৃহৎ জনমত উপেক্ষা করে ইভিএম দিয়ে ভোট নিতে চাওয়ার অতি জেদ সবার মনে আরও অতি গভীর সন্দেহের উদ্রেক করে তুলছে।

মানুষের মনের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে ক্রমাগত উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দায়সারা বক্তব্য দেওয়ার ফলে অনেকের মন-মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে উন্নয়নের ভোট পাওয়ার সুযোগ অতিকথন ও অনৈতিকতার হাতছানির আড়ালে চুপসে যাচ্ছে। তাই তো সাধারণ মানুষ এখন মুখস্থটা মানে না, কারও কটূক্তি, অহেতুক অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যটাও ধরে ফেলে। ধীরে ধীরে এসব অতিকথন, অবজ্ঞা ও উপহাসসৃষ্ট উত্তাপ চারদিকে আন্দোলনে রূপ নিয়ে মহীরুহ হয়ে গেছে সেটা অনুভূত হতে দেরি হচ্ছে কেন? সেই উপলব্ধিটা ওসব ঘুমন্ত ‘আলসিয়া’-দের মধ্যে জরুরি বোধোদয় হিসেবে জাগ্রত না হলে বেশি তাপে ঝলসানোর পর আর কবে, কখন সম্বিত ফিরে আসবে বলে মনে হয়?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

অবজ্ঞা ও উপহাসসৃষ্ট রাজনৈতিক উত্তাপ ঠেকাবে কে?

আপডেট সময় : ০৯:১৮:১৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ অক্টোবর ২০২২

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম : তিন অলস ব্যক্তি ঘুমিয়েছে একঘরে। সেই ঘরে আগুন লেগেছিল কিন্তু তারা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। প্রথমজন হঠাৎ জেগে ঘরের মধ্যে আলো দেখে বলল, আজ সূর্যটা এত তাড়াতাড়ি উঠলো কেন রে? দ্বিতীয়জন গায়ে কিছু একটার তাপ অনুভব করলে চেঁচিয়ে উঠে বলল, এই কাঁথাটা এত গরম কেন রে? তৃতীয়জন বলল, তোরা চুপ কর তো, আমার ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। জানিস না বিদ্যুৎ নাই, তাই ফ্যানটা ঘুরছে না। সেজন্য গরম লাগছে রে।
বাস্তবতা হলো সূর্য তখনো ওঠেনি, ফ্যানও ঘুরছিল। কিন্তু বিছানা ছেড়ে কেউ আর উঠলো না। অতি আলসেমির কারণে শেষ পর্যন্ত তিনজনই আগুনে দগ্ধ হলো। এটা একটা প্রাচীন গল্পের কথা। অলস ব্যক্তিদের অবহেলা ও কোন বড় জিনিসকে নিজের ভালো না লাগলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উপহাস করা এবং নিজের ও অপরের বিপদ ডেকে আনার পথ প্রশস্ত করে দেওয়ার উপমা।
সেদিন কয়েকটি জেলায় স্থলপথে অঘোষিত হরতাল হয়ে গেলো। পরিবহন সমিতির ওপর দায় দেওয়া হলেও সেটা ছিল শাসক দলের ইঙ্গিতের হরতাল। ময়মনসিংহ বিভাগে বিএনপির সম্মেলনের দিন হঠাৎ কোনো ঘোষণা ছাড়াই কিশোরগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার বাস চলাচল বন্ধ। পায়ে হেঁটে সমাবেশে আসতে থাকা লোকজনের ওপর পথে পথে বাধা। অগত্যা জলপথে নৌকায়, লঞ্চে, ট্রলারে করে সমাবেশে হাজির হলো হাজার হাজার সমর্থক।

এর আগে চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড মাঠের জনসভায় লাখো জনতার উপস্থিতিকে জব্বারের বলি খেলায় উপস্থিত কিছু দর্শকের উপমা টেনে কৌতুক করতে ভুলেননি অনেকে। যারা টিপ্পনী কেটে প্রশান্তি লাভ করার চেষ্ট করছেন তারা যদি অন বা অফলাইনের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাঠ করতেন বা দেখতেন তারা এমন তাচ্ছিল্য করতে উদ্যত হতেন না। তাদের অবস্থা হচ্ছে, ‘রোম পুড়ছে তবুও নিরো বাঁশি বাজাচ্ছে’-র মতো।

এত বড় সম্মেলন হচ্ছে তার জন্য দায়ী তারাই। কারণ, মৃতপ্রায় বিএনপিকে তাচ্ছিল্য করে পিন করতে করতে তারা ক্ষেপিয়ে তুলেছে কয়েক বছর ধরে। অনবরত খোঁচা খেতে খেতে বিএনপি সংগঠিত হয়ে উঠেছে। এখন তারা প্রকাশ্যে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে দ্বিধা করছে না। তারা বলছে আর জেল-জুলুমকে ভয়-ডর করবে না। মরণকেও আর পাত্তা দিতে চায় না। তারা পণ করেছে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার। তাদের সহযোগীরাও এতদিন আমতা আমতা করে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ করে সময় পার করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। কিন্তু তারাও বেশ সরব হয়েছে একই দাবি আদায়ের জন্য।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনে সরকার সমর্থকরা প্রতিদ্বন্দ্বী সহ্য করতে পারে না। প্রতিটি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে চায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে হামলা ও হয়রানিমূলক মামলার শিকার হতে হয়। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে।’ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণের সমালোচনা করে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা ইভিএমে নির্বাচনের বিরোধিতা করছি। কারণ ইভিএমে ঘোষিত ফলাফল চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয় না। কোনো প্রার্থী সংক্ষুব্ধ হলে, কোনো প্রমাণ নিয়ে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। … যারা ইভিএম পরিচালনা করেন তারা তো নিরপেক্ষ নয়।’

বাংলাদেশের কনিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক বলেছেন, ‘দেশে এখনো অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রতিনিধিত্বশীল ও অর্থবহ নির্বাচনের স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যারাই ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতায় থাকতে নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছে। … নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য সুনির্দিষ্ট কতগুলো বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়েছে।’

এতকিছু বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, তবুও শাসকদল মনে হয় খুবই আত্মবিশ্বাসী। একটি ছাপানো পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, অতি আত্মবিশ্বাস রাজনীতিতে ভালো নয়। রাজনীতির ঢেউ সকাল-বিকেলে ওঠানামা করে।

তবুও একজন বাঁকা হাসি হেসে মুখস্থ কথা বলেন। শিখিয়ে দেওয়া মুখস্থ কথার ধরন একই, প্রতিদিন অনুরূপ বাক্যচয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভারত বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা, গুজব, মাঠে নামলে কার কত শক্তি দেখা যাবে- ইত্যাদি মুখস্থ করা কথা। আবার কোনো বড় ঘটনা বা সভার সাধারণত: কোনটা ফ্লপ আর কোনটা হাউসফুল সেটা দর্শকরা বিচার করে থাকেন। একই দলের একজন ফ্লপ বললে অন্যজন সেটাকে তা মনে করেন না। কোনো কাজের জন্য মানুষ নিয়োগ বা ভাড়া করতে অবশ্যই টাকা লাগে। লাখ লাখ মানুষকে কি ভাড়া করা যায়? কোনো অনুমোদিত জনসভায় ভাড়াকৃত লাখ লাখ মানুষকে কি করে সন্ত্রাসী বলা যায়? তাহলে দেশে এত মানুষ সন্ত্রাসী হলে দেশ চলে কি করে?

তাদের অনবরত অতিকথনের ফলে বিএনপি এখন অনেক সংগঠিত হয়ে বজ্রকঠিন শপথ নিয়েছে। তাদের প্রতিহিংসা ও অনবরত তাচ্ছিল্যপনার জবাব দিতে বিএনপি একত্রিত হয়েছে। খুলনা সমাবেশের বহু আগে পরিবহন সমিতির ঘাড়ে চাপিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করা হলেও খুলনার নেতারা বলছেন, মন চাইলে পায়ে হেঁটেও দিল্লি বা মক্কা যাওয়া যায়। কোনো জনসভায় যাওয়ার জন্য এমন কঠিন পণ আগে কখনও শোনা যায়নি।

অন্যদিকে হঠাৎ করে সরকারি চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক অবসরের নামে তোলপাড় শুরু করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন এসব কিছুই হঠকারিতার শামিল এবং বিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে মানুষের ভোটধিকারের বিষয়টি। এখনও মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট নিজ হাতে দিতে চায়। মেশিনের বোতাম টিপে নয়। ভোট মেশিনে মানুষের বড় সন্দেহ, বড় ভয়। কারণ মেশিনের পেছনের মানুষগুলো ডাকাত। সেটা কমিশনের লোকজনই বলে দিয়েছে। তারা ওদের ঘৃণ্যকাজ করতে দেখেছে, সেজন্য সম্প্রতি ভোট বাতিল করে সেটা প্রচারও করেছে।

চোরের থাপইতরা বড় ধড়িবাজ। চোরের থাপইত বা চোরের সোর্স ব্যবহার করে নিজের সুনাম বাড়ে না। চোর কারও বন্ধু হতে পারে না। কারণ চোরের বন্ধুকেও চোরের কর্মকা-ের জন্য অপমান ও শাস্তি পেতে প্রস্তুত থাকতে হয়। শুঁটকি মাছকে সাতবার ধৌত করে রান্না করলেও শুঁটকির গন্ধ দূর করা যায় না। তাই তো বলা হয়, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।

ইভিএম ব্যবহারের জন্য অতি খরচ, অতি ঝামেলা, অতি বিপদের আশঙ্কা, অতি সন্দেহ রয়েছে সিংহভাগ ভোটারের মধ্যে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইভিএম নয়- প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা চাই। ভোট চলাকালীন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা ও সিসি ক্যামেরা চালু থাকলে পুরো ভোটের সময়টা ভিডিও করা যাবে। তাহলে কোন প্রার্থী অভিযোগ করলে ভিডিও দেখে তার যথার্থতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। কারণ ইভিএম মেশিনের মেমোরি সরানো নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ইতোমধ্যে অভিযোগ করা হয়েছে। যার কোনো সদুত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। এত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেও বৃহৎ জনমত উপেক্ষা করে ইভিএম দিয়ে ভোট নিতে চাওয়ার অতি জেদ সবার মনে আরও অতি গভীর সন্দেহের উদ্রেক করে তুলছে।

মানুষের মনের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে ক্রমাগত উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দায়সারা বক্তব্য দেওয়ার ফলে অনেকের মন-মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এভাবে উন্নয়নের ভোট পাওয়ার সুযোগ অতিকথন ও অনৈতিকতার হাতছানির আড়ালে চুপসে যাচ্ছে। তাই তো সাধারণ মানুষ এখন মুখস্থটা মানে না, কারও কটূক্তি, অহেতুক অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যটাও ধরে ফেলে। ধীরে ধীরে এসব অতিকথন, অবজ্ঞা ও উপহাসসৃষ্ট উত্তাপ চারদিকে আন্দোলনে রূপ নিয়ে মহীরুহ হয়ে গেছে সেটা অনুভূত হতে দেরি হচ্ছে কেন? সেই উপলব্ধিটা ওসব ঘুমন্ত ‘আলসিয়া’-দের মধ্যে জরুরি বোধোদয় হিসেবে জাগ্রত না হলে বেশি তাপে ঝলসানোর পর আর কবে, কখন সম্বিত ফিরে আসবে বলে মনে হয়?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।