নিজস্ব প্রতিবেদক : স্কুলে ভর্তি হয়ে অনলাইন ক্লাসেই কেটে গেছে দুই বছর, অবশেষে পরিচয় ঘটল ক্লাস রুম, স্কুল বেঞ্চ, ব্ল্যাক বোর্ডে আর বন্ধুদের সঙ্গে।
করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দীর্ঘ দুই বছর বন্ধ থাকার পর প্রাক-প্রাথমিকের শিশুরাও ক্লাসে ফিরেছে। প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে দুই দিন রবি ও মঙ্গলবার ক্লাস করবে তারা।
গতকাল মঙ্গলবার প্রথম দিনের ক্লাসে অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যেই ছিল আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল, তবে কারও কারও মধ্যে কিছুটা জড়তা, কিছুটা ভীতি কাজ করেছে। কেউ কেউ মায়ের হাত ছাড়তেই চাইছিল না। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে শিশুদের হাত জীবাণুমুক্ত করে মাস্ক পরিয়ে স্কুলে প্রবেশ করাতে দেখা যায়।
মিরপুর-১২ নম্বরের লিটল ফ্লাওয়ার্স প্রিপারেটরি স্কুলের প্রিপারেটরি-টু ক্লাসের শিক্ষার্থী আরিয়া জামান মাস্ক না পরেই স্কুলে প্রবেশ করতে গেলে ফটকে তাকে আটকে দেওয়া হয়। পরে তার মা তাকে মাস্ক পরিয়ে দেন।
আরিয়ার মা তামান্না হক বলেন, “সরকার স্কুল খুলে দেওয়ায় বাচ্চাদের অনেক উপকার হবে। ওরা তো লেখা ভুলতেই বসেছিল। এখন প্র্যাকটিস হবে। আবার সবকিছু শিখে ফেলবে।”
সরাসরি ক্লাস শুরু হওয়ায় খুশি হলেও শিশুদের স্বাস্থ্যবিধি পালন নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন এই অভিভাবক।
“ওরা তো মাস্ক পরে থাকতে চায় না, ওরা এতোকিছু আসলে বোঝে না। টিকাও তো নেয়নি। এজন্য একটু টেনশন হচ্ছে।”
২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে প্লে, নার্সারি, কেজির শিশুরা আর সরাসরি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করতে পারেনি। দেড় বছর পর গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও টিকা না পাওয়ায় ও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে এতোদিন প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা হয়নি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের ক্লাস শুরু সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের কেজি শ্রেণির শিক্ষার্থী সাফির আহমেদ মঙ্গলবারই প্রথম সরাসরি শ্রেণিকক্ষে বসে ক্লাস করল। এর আগে বিভিন্ন কাজে বাবা-মায়ের সাথে স্কুলে এলেও ক্লাসে বসার অনুভূতি একেবারেই অন্যরকম।
সাফির বললো, “অনেক ভালো লেগেছে আজকে। টিচারদের সাথে, বন্ধুদের সাথে বসে ক্লাস করেছি। একসাথে পড়েছি, টিফিন করেছি। মজা হয়েছে অনেক।”
অনলাইনে ক্লাস কেমন লাগত জানতে চাইলে ছয় বছর বয়সী এই শিশু জানায়, অনলাইনে কারও সাথেই ভালভাবে কথা বলা যেত না। ভালো লাগত না তার। সাফিরের মা শাহরিন বুশরা প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাস শুরু হওয়ায় স্বস্তি পেয়েছেন।
“প্রতিদিনই শুধু জিজ্ঞেস করত, কবে ওদের ক্লাস শুরু হবে। প্রাথমিকের ক্লাস শুরুর পর থেকে বাচ্চাদের দেখছে স্কুলে যেতে। তখন থেকে টিচারদের শুধু ফোন করতে বলে যে, ওদের স্কুল খুলছে না কেন? আজকে স্কুলে গিয়ে ভীষণ খুশি।
“আসলে বাচ্চারা বাসায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। ওরাও স্বাভাবিকভাবে স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতে চায়। আমরাও চাই স্কুল স্বাভাবিকভাবে চলুক।”
মিরপুর স্বর্ণকলী মর্ডার্ন স্কুলের সহকারী শিক্ষক মাহবুবা আক্তার বলেন, প্রথমদিন শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি কিছুটা কম রয়েছে। তবে কয়েকদিন পরেই তা বাড়বে বলে আশা তার।
“অনলাইনে ক্লাস করার সময়ও স্কুলে আসতে চাইত ওরা। আর আজকে স্কুলে এসে ভীষণ খুশি। পড়ছে, খেলছে- খুব এনজয় করছে।” এই স্কুলের প্রিপারেটরি টু এর শিক্ষার্থী আয়েশা খানের মা সাবা খান চান স্কুল পুরোপুরি খুলে দেওয়া হোক।
“এতদিন তো স্কুল বন্ধ ছিল। স্কুল খোলায় এখন বাচ্চাকে পাঠালাম। আর কতদিন বন্ধ থাকবে? এভাবে চলতে থাকলে তো ক্ষতি হবে বাচ্চাদেরই।”
মিরপুরের কিডজ ক্যাম্পাস স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজিয়া সুলতানা জানান, মহামারীতে তাদের শিক্ষার্থী অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে নিয়মিত স্কুল চালু থাকলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
“আমাদের নার্সারি, প্লে- এই ক্লাসগুলোতেই বাচ্চা বেশি। আজ ক্লাসে এসে ওরা খুব আনন্দ পেয়েছে। তবে লেখাটায় ওদের কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। নিয়মিত ক্লাস করলে সেটা আশা করি কেটে যাবে।”
প্রথম ক্লাসে এসে উচ্ছ্বসিত প্লে-র শিক্ষার্থী আকিফা আক্তার বললো, “অনেক সুন্দর লাগছে ক্লাস। এখানে ভালো লাগছে।”
তবে দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকায় শিশুদের সামাজিক শিক্ষায় কিছুটা বিঘœ ঘটেছে বলে মনে করছেন শিক্ষক-অভিভাবকরা। ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের প্রিপারেটরি-ওয়ান এর শিক্ষার্থী ফেরদৌস আহমেদের মা লিপি বলেন, “ওদের মধ্যে অনেক উচ্ছ্বাস। কিন্তু প্রথম তো, স্কুলে একটু ভয়ও পাচ্ছে, একটু কান্নাকাটিও করছে। ছাড়তে চাচ্ছে না। সবার সাথে মিশতে কিছুটা দ্বিধা করছে। “অনলাইনে ক্লাস হত। কিন্তু অনলাইনে বাচ্চারা তো সেভাবে বোঝে না। টিচাররা খুব চেষ্টা করেছেন।”
অপেক্ষা শেষে ক্লাসরুমে ফিরলো ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ