আহমেদ ফাইয়াজ: গল্পের বই। নাম দশ বিষ। অন্য রকম একটা ব্যাপার আছে। আর দশটা গল্পের বই থেকে দশ বিষ-এর মেজাজ অনেকটাই ভিন্ন। এই বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে এক ডজন গল্প। সূচিপত্রে এক ডজন। কার্যত আরও বেশি। ‘বিশ শব্দের বিষ’ নামের অতি ক্ষুদ্র গল্পগুলোর মধ্যে পাঠক পাবেন হরেক রকম চিন্তার সূত্র। দু’তিনটি বাক্য, কখনো বা সংলাপ; যা দীর্ঘ কোনো কাহিনির ইঙ্গিত বহন করে। এগুলোকে বলা যায় টিপ অফ দ্য আইসবার্গ। পাশ্চাত্যে এধরণের গল্পের বহুল চর্চা রয়েছে। ইংরেজিতে এই ধরনের গল্পকে বলা হয় ফ্ল্যাশ ফিকশন বা মাইক্রো ফিকশন। বাংলায় অণুগল্প।
‘দশ বিষ’ বইয়ের ফ্ল্যাশ ফিকশনের পরিণতি রহস্যময়।বিদঘুটে কখনো বিষময়। এসব গল্পে মনোবিকলনের বিচিত্র প্রকাশ কৌতূহলী পাঠককে ভাবিত করে। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক- ‘১. গাছ কেটে তৈরি সিংহের রাজপ্রাসাদ। পশুপাখিরা এসে বললো, মহারাজ বন তো উজাড়। থাকবো কোথায়, খাবো কি?’
‘সিংহ: অকৃতজ্ঞ, উন্নয়নবিরোধী! সবগুলোকে খাঁচায় পুরবো!’ নবপরিণীতা যুঁইকে কথাবলা ময়না উপহার আবিরের। অফিসফেরত আবিরকে ময়নাÑ সুমন এসেছিলো।
‘পাখির মুখে প্রেমিকের নাম শুনে স্তব্ধ যুঁই।’ এই ধরনের অতি ক্ষুদ্র গল্পের ভেতর লুকিয়ে থাকে বড় কোনো কাহিনি। পাঠক নিজের মতো করে সেই লুকোনো গল্পটা খুঁজেন। পাঠককে ভাবিয়ে তুলতে পারার মধ্যেই ফ্ল্যাশ ফিকশনের সার্থকতা। সেই বিচারে বিশ শব্দের বিষ নামের গল্পগুলো সার্থক। গল্পগুলোর মধ্যে সমকালীন উপাদান যুক্ত করা হয়েছে বেশ একটা মুনশিয়ানার সাথে।
গ্রন্থভুক্ত অন্য এগারটি গল্পে যে সব নারী ও পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লোকাতীত ঘটনার সাথে যুক্ত। এনজিওর কাজে ভোলায় গিয়ে করোনার লকডাউনে আটকা পড়ে একজন। ঝড় এলে সমুদ্রে নৌকা ডুবে যায়। দেখা পায় আজিজ মাস্টারের। স্ত্রী-পুত্র ও সহকর্মী সবুর লঞ্চ নিয়ে ভোলার সেই জনমানবশূন্য চরের কাছাকাছি এলে লোকটি স্ত্রী ও পুত্রের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে। কিন্তু ওরা শুনতে পায় না। লোকটি হাত নাড়ে। কিন্তু যারা খুঁজতে এসেছে, তারা দেখতে পায় না। খুব কাছাকাছি। তবুও স্ত্রী, সন্তান কিংবা সহকর্মী সবুর কেউ -ই লোকটিকে দেখতে পাচ্ছে না! কিন্তু কেন? এই কেন’র গা ছমছম করা উত্তর পাঠক পেয়ে যাবেন গল্পের শেষে। গল্পকার গোলাম কিবরিয়া পাঠককে অনায়াসে নিয়ে যান লোকান্তরে।
টুশি নামের তরুণীটি গাড়ির ভেতর হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে মরলো কেমন করে? আরিফ ওকে খুন করেছে নাকি আরিফকে একটু আগে খুনির অপবাদ দেওয়ায় ওর অভিশাপ লেগেছে। এরকমই এক রহস্যময়তা তৈরি করেছেন লেখক অভিশাপ গল্পে। চুল গল্পে পাঠক আবিস্কার করবেন কন্যাস্নেহে কাতর এক পিতাকে। ক্যানসারের কারণে চুল পড়ে যাওয়া শিশুকন্যার মন ভালো করে দেওয়ার জন্যে পিতা মঞ্জুরও চুল কামিয়ে টাকমাথা হয়ে গেলেন। গল্প এটুকুই। কিন্তু গল্পকার কুশলতার সাথে পাঠককে ধরে রাখেন অনেক ক্ষণ। আরেকটি উদাহরণ দিয়ে ইতি টানবো এই আলোচনার। দুনিয়ায় অনেক কিছুই ঘটে, যা যুক্তিকে হার মানায়। বিদেশ প্রবাসী বড় ডাক্তার মুকাদ্দেস হেরে যান গ্রামের হতদরিদ্র সহপাঠী মুমিন ওঝার কাছে। বুজরুকিতে বিরক্ত মুমিন ওজার স্ত্রীও। ফিজিশিয়ান মুকাদ্দেস বহু বছর পরে সহপাঠীকে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হলেও মুমিন ওঝার বুজরুকিতে বিশ্বাস করেন না। মুমিন ওঝা সসংকোচে পকেট থেকে যষ্টিমূল বের করে ভয়ে ভয়ে বলে, এর রস খেলে পলিন হয়তো হাঁটতে পারবে। মনে মনে হাসলেন মুকাদ্দেস। তবু বাল্যবন্ধু কষ্ট পাবে ভেবে যষ্টিমূলটা রেখে দিলেন। আশ্চর্য সেই দাওয়াইয়ে ঠিকই সুস্থ হয়ে গেলো ডাক্তার মুকাদ্দেসের পঙ্গু কন্যা পলিন।
অতিপ্রাকৃত গল্পে লেখকের বর্ণনাভঙ্গি সাবলীল। অমনোযোগী পাঠককেও টেনে নিয়ে যায় অনায়াসে। ঝকেঝকে ছাপা। মনোরম প্রচ্ছদ দৃষ্টি কাড়ে সহজেই।
দশ বিষ
লেখক: গোলাম কিবরিয়া
প্রকাশক: রতন চন্দ্র পাল, গ্রন্থ কুটির, বাংলাবাজার, ঢাকা
প্রচ্ছদ: নভিয়া নভেলী
মূল্য: ৩২০ টাকা
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ