ঢাকা ০১:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

অন্যের মৃত্যুর কারণ যেন আপনি না হন

  • আপডেট সময় : ১১:০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই ২০২১
  • ১১১ বার পড়া হয়েছে

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ : তারপর আজ থেকে পথ ফাঁকা। কেমন তা দেখতে? দর্শনার্থীরা জড়ো হবেন। অলিতে গলিতে। সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে মূলপথে। মাস্ক? থাকবে, নাও থাকতে পারে। কারণ তারা তো বেরোবেন ফাঁকা পথ দেখতে। গলিতে। তারপর অজান্তেই পথের ফাঁকা গলিয়ে পৌঁছে যাবেন মূল সড়কে।
পর্যটন কেন্দ্রগুলোর দুয়ার বন্ধ। বিনোদন কেন্দ্র, সে কোথায়? না থাকুক, তাও বন্ধ। পার্ক বন্ধ। মানুষ যাবে কোথায়—হাপিত্যেসকারীরা জড়ো হবে পর্দা ফেলা চায়ের দোকানে। করোনা আসবে না। ঝোলানো আছে পর্দা । ঠিক সংযমের মাসের মতো।
পর্দার আড়ালে পর্দা খুলবে মুখের। দুধের ঘন চা চলবে গণকাপে। একই নিকোটিনের নিতম্বে ফুঁকবে হতাশা। পুড়িয়ে দেবে বিষণ্নতা, বিধিনিষেধের পায়তারা। ‘এ কী, এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? করোনার ভয় নেই? মাস্কটা কোথায়? জানেন না লকডাউন?’
প্রশ্নগুলোকে শাকের আঁটির মতো এক করে বাঁধা হবে কেবল একটি সুতোয়, ‘গরিবের করোনা নাই।’
তারপর এই ‘গরিবের করোনা নাই’ শ্রেণির মানুষগুলো আবার হাসপাতালের দুয়ারে গিয়ে হাঁপাবে। হাঁপরের মতো ওঠানামা করবে সেই বুক। ‘বাতাস, আমাকে একটু বাতাস দে বাপ’। ছেলে ছুটবে বাবার জন্য বাতাস আনতে। ডানে যাবে বাতাস আনতে। বাঁয়ে যাবে। আকাশ ফুড়ে বাতাস আনতে চাইবে। মাটি চৌচির করবে বাতাসের জন্য হাহাকারে। হাসপাতালের এ মাথা থেকে ওমাথা। কত বাতাস, অথচ একটুও বাতাস নেই! ছেলে বাতাস নিয়ে ফেরার আগেই একটা সর্পিল নল পৌঁছবে বাবার শিওরে।
‘কে বাবা তুমি? দাও একটু বাতাস দাও।’ সাদা কাফনের মতো বর্মমোড়া কারো হাত থেকে নলটা বাবা নিজেই পুড়ে দেবেন নাকে। ‘আহ্ বাতাস। ’
ওদিকে ছেলে, চায়ের দোকানে পর্দা তুলে যে বলেছিল, ‘গরিবের করোনা নাই’, এখন যে বাবার জন্য বাতাস চেয়ে হাসপাতালের প্রতিটি দুয়ারে হানা দিচ্ছে, একসময় সে বলে উঠবে, ‘গরিবের জন্য চিকিৎসা নাই।’
অথচ তাদের কেউ, জানবে না, বড়লোকের ড্রয়িংরুমে রাখা পত্রিকায় ভাঁজে একটা খবর চাপা পড়ে আছে। ‘হাসপাতালে শয্যা নেই।’ উপশিরোনাম- ‘আইসিইউর জন্য হাহাকার। অক্সিজেন মজুদ নেই পর্যাপ্ত।’ কেউ প্রশ্ন করবে না সেই ‘গরিবের করোনা নাই’ বিষয়ক তাত্ত্বিকের কাছে, তাহলে হাসপাতালগুলো সব বড়লোকের দখলে? গরিবরা তাহলে কবি মারজুক রাসেলের মতো ‘হাওয়া দেখে, বাতাস খেয়ে’ বেড়াচ্ছে, বেড়াবে?

হ্যাঁ, হাহাকার আছে। সত্যিকারের গরিবের হাহাকার। বিধিনিষেধে দোকানের ঝাঁপ খুলবে না। ফুটপাত সাজবে না পসরায়। পরিবহনের ঘোড়াদৌড়ের চালক-সহকারীরা অলস কাটাবে সময়। তাদের কে খাওয়াবে? কে পরাবে তাদের? কে দেখবে? এই প্রশ্নগুলোই আদতে গরিবের। প্রকৃত নিরন্নের। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’—কথাটা তো এখনো আছে বইয়ের পাতায়। এখনো লেখা হয়। তারা আছেনও। তাদের কথাও ভাবতে হবে। কে ভাববে? রাষ্ট্র। হ্যাঁ, ভাবতে হবে। সঙ্গে কাজও।
কলকারখানার চাকা ঘুরবে। স্বাস্থ্যেরবিধি মেনে। বিদেশিদের জন্য যারা সুঁইয়ে সুতো লাগাচ্ছেন দিনরাত, তারাও বসে থাকবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। অবহেলা যেন না হয়, দেখতে হবে সেটাও। কারণ এই অবহেলার দায় এখন দিচ্ছে দেশ, দেশের মানুষ।
ওই যে, ‘আমাদের করোনা হয় না’, ‘করোনা বলেতে কিছু নেই’, ‘গরিবের করোনা নেই’ শ্রেণি—তাদের জন্য ধুকছে প্রায় ১৭ কোটির দেশ। সীমান্ত দিয়ে গরু-চোরাচালানের মতো ঢুকে যাওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও কম দায়ী নয়। সীমান্তের মানুষগুলো তার খেসারত তো এখন দিচ্ছেই।
খেয়াল রাখুন, যেন এই সাত দিনের বারণ তিন সাতে গিয়ে না ঠেকে। মনে রাখুন, করোনা সবাইকে আঘাত করছে, সুযোগ পেলে করবেও। আপনি হয়তো কোনো কারণে পার পেয়ে গেছেন, যাচ্ছেন, হয়তো যাবেনও; তাই বলে করোনা নেই—এমন আত্মঘাতী কথা বলবেন না। আত্মহত্যার প্ররোচণা কিংবা অঘটনে মৃত্যুর জন্য দায়ীদের যদি আইনে শাস্তি হয়, তাহলে আপনি কেন বাদ যাবেন?
লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

অন্যের মৃত্যুর কারণ যেন আপনি না হন

আপডেট সময় : ১১:০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই ২০২১

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ : তারপর আজ থেকে পথ ফাঁকা। কেমন তা দেখতে? দর্শনার্থীরা জড়ো হবেন। অলিতে গলিতে। সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে মূলপথে। মাস্ক? থাকবে, নাও থাকতে পারে। কারণ তারা তো বেরোবেন ফাঁকা পথ দেখতে। গলিতে। তারপর অজান্তেই পথের ফাঁকা গলিয়ে পৌঁছে যাবেন মূল সড়কে।
পর্যটন কেন্দ্রগুলোর দুয়ার বন্ধ। বিনোদন কেন্দ্র, সে কোথায়? না থাকুক, তাও বন্ধ। পার্ক বন্ধ। মানুষ যাবে কোথায়—হাপিত্যেসকারীরা জড়ো হবে পর্দা ফেলা চায়ের দোকানে। করোনা আসবে না। ঝোলানো আছে পর্দা । ঠিক সংযমের মাসের মতো।
পর্দার আড়ালে পর্দা খুলবে মুখের। দুধের ঘন চা চলবে গণকাপে। একই নিকোটিনের নিতম্বে ফুঁকবে হতাশা। পুড়িয়ে দেবে বিষণ্নতা, বিধিনিষেধের পায়তারা। ‘এ কী, এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? করোনার ভয় নেই? মাস্কটা কোথায়? জানেন না লকডাউন?’
প্রশ্নগুলোকে শাকের আঁটির মতো এক করে বাঁধা হবে কেবল একটি সুতোয়, ‘গরিবের করোনা নাই।’
তারপর এই ‘গরিবের করোনা নাই’ শ্রেণির মানুষগুলো আবার হাসপাতালের দুয়ারে গিয়ে হাঁপাবে। হাঁপরের মতো ওঠানামা করবে সেই বুক। ‘বাতাস, আমাকে একটু বাতাস দে বাপ’। ছেলে ছুটবে বাবার জন্য বাতাস আনতে। ডানে যাবে বাতাস আনতে। বাঁয়ে যাবে। আকাশ ফুড়ে বাতাস আনতে চাইবে। মাটি চৌচির করবে বাতাসের জন্য হাহাকারে। হাসপাতালের এ মাথা থেকে ওমাথা। কত বাতাস, অথচ একটুও বাতাস নেই! ছেলে বাতাস নিয়ে ফেরার আগেই একটা সর্পিল নল পৌঁছবে বাবার শিওরে।
‘কে বাবা তুমি? দাও একটু বাতাস দাও।’ সাদা কাফনের মতো বর্মমোড়া কারো হাত থেকে নলটা বাবা নিজেই পুড়ে দেবেন নাকে। ‘আহ্ বাতাস। ’
ওদিকে ছেলে, চায়ের দোকানে পর্দা তুলে যে বলেছিল, ‘গরিবের করোনা নাই’, এখন যে বাবার জন্য বাতাস চেয়ে হাসপাতালের প্রতিটি দুয়ারে হানা দিচ্ছে, একসময় সে বলে উঠবে, ‘গরিবের জন্য চিকিৎসা নাই।’
অথচ তাদের কেউ, জানবে না, বড়লোকের ড্রয়িংরুমে রাখা পত্রিকায় ভাঁজে একটা খবর চাপা পড়ে আছে। ‘হাসপাতালে শয্যা নেই।’ উপশিরোনাম- ‘আইসিইউর জন্য হাহাকার। অক্সিজেন মজুদ নেই পর্যাপ্ত।’ কেউ প্রশ্ন করবে না সেই ‘গরিবের করোনা নাই’ বিষয়ক তাত্ত্বিকের কাছে, তাহলে হাসপাতালগুলো সব বড়লোকের দখলে? গরিবরা তাহলে কবি মারজুক রাসেলের মতো ‘হাওয়া দেখে, বাতাস খেয়ে’ বেড়াচ্ছে, বেড়াবে?

হ্যাঁ, হাহাকার আছে। সত্যিকারের গরিবের হাহাকার। বিধিনিষেধে দোকানের ঝাঁপ খুলবে না। ফুটপাত সাজবে না পসরায়। পরিবহনের ঘোড়াদৌড়ের চালক-সহকারীরা অলস কাটাবে সময়। তাদের কে খাওয়াবে? কে পরাবে তাদের? কে দেখবে? এই প্রশ্নগুলোই আদতে গরিবের। প্রকৃত নিরন্নের। ‘দিন এনে দিন খাওয়া’—কথাটা তো এখনো আছে বইয়ের পাতায়। এখনো লেখা হয়। তারা আছেনও। তাদের কথাও ভাবতে হবে। কে ভাববে? রাষ্ট্র। হ্যাঁ, ভাবতে হবে। সঙ্গে কাজও।
কলকারখানার চাকা ঘুরবে। স্বাস্থ্যেরবিধি মেনে। বিদেশিদের জন্য যারা সুঁইয়ে সুতো লাগাচ্ছেন দিনরাত, তারাও বসে থাকবেন না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। অবহেলা যেন না হয়, দেখতে হবে সেটাও। কারণ এই অবহেলার দায় এখন দিচ্ছে দেশ, দেশের মানুষ।
ওই যে, ‘আমাদের করোনা হয় না’, ‘করোনা বলেতে কিছু নেই’, ‘গরিবের করোনা নেই’ শ্রেণি—তাদের জন্য ধুকছে প্রায় ১৭ কোটির দেশ। সীমান্ত দিয়ে গরু-চোরাচালানের মতো ঢুকে যাওয়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও কম দায়ী নয়। সীমান্তের মানুষগুলো তার খেসারত তো এখন দিচ্ছেই।
খেয়াল রাখুন, যেন এই সাত দিনের বারণ তিন সাতে গিয়ে না ঠেকে। মনে রাখুন, করোনা সবাইকে আঘাত করছে, সুযোগ পেলে করবেও। আপনি হয়তো কোনো কারণে পার পেয়ে গেছেন, যাচ্ছেন, হয়তো যাবেনও; তাই বলে করোনা নেই—এমন আত্মঘাতী কথা বলবেন না। আত্মহত্যার প্ররোচণা কিংবা অঘটনে মৃত্যুর জন্য দায়ীদের যদি আইনে শাস্তি হয়, তাহলে আপনি কেন বাদ যাবেন?
লেখক: সাংবাদিক ও গল্পকার