নিজস্ব প্রতিবেদক : বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে দেশে অনলাইনে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’সহ বিভিন্ন জুয়া পরিচালনার অভিযোগে রাজধানীতে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গত রোববার রাতে মহাখালী ও উত্তরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তারের কথা জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।গ্রেপ্তাররা হলেন- জামিলুর রশিদ (৩১), সায়মন হোসেন (২৯), মো. রিদোয়ান আহমেদ (২৯), মো. রাকিবুল আলম (২৯), মো. মুনতাকিম আহমেদ (৩৭), ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ (৩২)। তাদের মধ্যে জামিলুর রশিদ এই অনলাইন জুয়া চক্রের ‘হোতা’ জানিয়ে র্যাব বলছে, পাঁচ বছর আগে দুটি গেম ডেভেলপ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছিলেন তিনি। পাশের দেশের একটি কোম্পানির জুয়ার অ্যাপ ‘তিন পাত্তি গোল্ড’ বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেন জামিলুর। আর এর জন্য তিনি বাংলাদেশে ‘উল্কা গেমস লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানি খোলেন।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে গতকাল সোমবার কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে কমান্ডার মঈন বলেন, গেম ডেভেলপমেন্টের নামে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠানোর তথ্য পায় র্যাব। পরে র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম নজরদারি বৃদ্ধি করে।
“ওই চক্রের হোতা উল্কা গেমস লিমিটেডের সিইও জামিলুর রশিদ। ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশের একটি প্রতিষ্ঠান ‘মুনফ্রগ ল্যাব’ এর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালে মুনফ্রগের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লাখের বেশি টাকার বেতনে যুক্ত হন তিনি।” র্যাব জানায়, মুনফ্রগ ল্যাবের অনলাইন জুয়া অ্যাপ তিন পাত্তি গোল্ডের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেলে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিলুর ‘উল্কা গেমস প্রা. লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। “দেশে গেম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে আইনি বৈধতা পায়।”
মঈন বলেন, “গেম ডেভেলপমেন্ট না করে তারা ‘তিন পাত্তি গোল্ডসহ’ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাঠানোর কার্যক্রম চালায়।”
‘তিন পাত্তি গোল্ড’ : তিন পাত্তি গোল্ড মূলত একটি অ্যাপ যা মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলা যায়। র্যাব জানায়, এই অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের হাতে। এটি ছাড়াও ‘রাখি’, ‘আন্দর বাহার’ ও ‘পোকার’ নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে। মঈন বলেন, তিন পাত্তি গোল্ডে রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে খেলার জন্য কিছু ‘চিপস’ ফ্রি দেওয়া হয়। সেগুলো শেষ হয়ে গেলে গেম খেলতে টাকা দিয়ে চিপস কিনতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চিপস কেনার লেনদেন হত।
এভাবে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন ‘বট প্লেয়ার’ বা কম্পিউটারের স্বয়ংক্রিয় প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশে এই তিন পাত্তি গোল্ডের চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর ও এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব ডিস্ট্রিবিউটরদের আবার সাব ডিস্ট্রিবিউটরও রয়েছে। বর্তমানে ‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ প্রায় ৯ লাখ নিয়মিত গেমার রয়েছেন এবং প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি হয় বলে জানাচ্ছে র্যাব।
মঈন বলেন, “ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে চিপস ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চিপস বিক্রির টাকা ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়।
“বর্তমানে উল্কা গেমস এর চারটি অ্যাকাউন্টে ৮০ কোটির বেশি টাকা রয়েছে। গত দুই বছর তারা মুনফ্রগ ল্যাবকে ব্যাংকের মাধ্যমে ২৯ কোটি টাকা পাঠিয়েছে।”
র্যাব জানায়, উল্কা গেমসের মোট ৩৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন ও অফিস পরিচালনায় প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বার্ষিক বেতনের ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ হারে বোনাসও দেওয়া হয়। এ কোম্পানি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের বাইরে অনলাইন জুয়ার অর্থ পাঠিয়ে আসছিল।
গেম ডেভেলপমেন্টের নামে জুয়া : সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জামিলুর রশিদ ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে বিদেশ থেকে ২০১২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। মোবাইল গেমে আসক্তি থাকায় ২০১৫ সাল থেকে গেমস তৈরির কাজ শুরু করেন। “হিরোজ অব ৭১ ও মুক্তি ক্যাম্প নামে ২০১৭ সালে দুটি গেম নির্মাণের জন্য তিনি সরকারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার অনুদানও পেয়েছিলেন। ওই বছরই মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। ২০১৮ সালে দেড় লাখ টাকা বেতনে গেম ডিজাইন কনসালটেন্ট ও বাংলাদেশে নিযুক্ত মুনফ্রগের কর্মকর্তা হিসাবে যুক্ত হন।”
২০১৯ সালে উল্কা গেমস প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানির সিইও হিসাবে জামিলুর রশিদ মুনফ্রগ থেকে মাসে ৪ লাখ টাকা পেতেন বলে তথ্য দিয়েছে র্যাব। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, জামিলুরের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে বিপুল অর্থ, একটি দামি গাড়ি এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্ল্যাট ও জমির তথ্য মিলেছে র্যাবের অনুসন্ধানে।