নিজস্ব প্রতিবেদক: তিন কর্মদিবস পেরিয়ে গেলেও স্থগিত হওয়া ‘সাহিত্য পুরস্কার’ দেওয়ার বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি বাংলা একাডেমি। এর মধ্যেই পুরস্কার সংক্রান্ত দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জুরি বোর্ডের সদস্য মোরশেদ শফিউল হাসান।
পুরস্কারের প্রথম ঘোষিত তালিকায় যাদের নাম ছিল, তাদের মধ্যে কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ ইতোমধ্যে পুরস্কার প্রত্যাখানের ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে বাংলা একাডেমি নতুন তালিকা তৈরিতে কিছুটা বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বছর আটেক আগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন মোরশেদ শফিউল হাসান। এবারের পুরস্কার কমিটিতে জুরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি। পুরস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে এখন ‘গৌরবের পরিবর্তে বিব্রত’ বোধ করছেন বলে তিনি জানালেন।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) সকালে সংবাদমাধ্যমকে মোরশেদ বলেন, জুরি সদস্য হিসেবে আমার যে দায়িত্ব ছিল, তা পালন করেছি। যোগ্য একাধিকজনের মাঝ থেকে আমরা সবাইকে হয়তো পুরস্কার দিতে পারিনি। কিন্তু যাদের পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়েছে, তারা কেউ অযোগ্য নন। যোগ্যদের হাতেই পুরস্কার গেছে।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’ ঘোষণা করা হয়। পরে পুরস্কারের তালিকায় থাকা কারও কারও সম্পর্কে ‘কিছু অভিযোগ’ আসায় শনিবার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার স্থগিত করা হয়।
তিন কর্মদিবসের মধ্যে পুনর্বিবেচনার পর তালিকাটি পুনঃপ্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি। মঙ্গলবার সেই তিন কর্মদিবস শেষ হলেও পুরস্কার সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি এ পুরস্কারের প্রবর্তক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি।
পুরস্কার স্থগিতের বিষয়ে বাংলা একাডেমির ভাষ্য ছিল, উদ্ভূত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং পুরস্কার-তালিকাভুক্ত কারও কারও সম্পর্কে কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় পূর্বঘোষিত ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’ পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন দেখা দেয়।
পুরস্কারের ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে জানতে চাইলে একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বুধবার (২৯ জানুয়ারি) সকালে সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, আমরা আসলে বইমেলা সংক্রান্ত ব্যস্ততার কারণে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) পুরস্কার নিয়ে সভাটা করতে পারিনি। আজকে এই সভা হবে, তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে পারব।
এবার দশজনকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পুরস্কারের ঘোষিত তালিকায় কবিতায় মাসুদ খান, কথাসাহিত্যে সেলিম মোরশেদ, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ/গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, শিশুসাহিত্যে ফারুক নওয়াজ, অনুবাদে জি এইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ হাননান এবং ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদের নাম ছিল।
পুরস্কার তালিকায় কোনো নারী লেখক না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে এটিকে ‘বিস্ময়কর’ বলে মন্তব্য করে গত ২৪ জানুয়ারি ফেসবুকে পোস্ট দেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এ পুরস্কারের জন্য ‘মনোনয়ন প্রক্রিয়া সংস্কারের সময় এসেছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এর পরদিন তা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলা একাডেমি। সংস্কৃতি উপদেষ্টা পুরস্কার স্থগিতের খবর ফেসবুক পোস্টে জানান। পুরস্কার স্থগিতে উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ রয়েছে বলেও ফেসবুকে লেখেন কেউ কেউ।
সংস্কৃতি উপদেষ্টার ফেসবুক পোস্টের প্রসঙ্গ টেনে মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, বিগত সরকারের আমলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন, সেভাবে এখন থেকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদানের বেলায়ও লেখকের বিষয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং তার অতীত রাজনৈতিক পরিচয় বা কার্যক্রম বিবেচনায় আনতে হবে, এমন ধারণা আমাদের কারো চিন্তায় আসেনি। আসা উচিত ছিল হয়ত!
সামাজিক মাধ্যমে সংস্কৃতি উপদেষ্টার পরপর দুটি পোস্ট পড়ার পরই প্রথম আমি এ বিষয়ে সচেতন হই এবং পুরস্কার পুনর্বিবেচনার কথা ওঠার পর আত্মসম্মানবোধ থেকে এবং নিজের বিচারবুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে এই প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নিই।
পুরস্কার পদ্ধতি সংস্কারের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে অন্যদের কী অভিমত জানি না, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, একাডেমির বর্তমান পুরস্কার নীতিমালা বা প্রচলিত পদ্ধতি যদি সঠিক না হয়, তা যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তবে সেসবের সংস্কার করে তবেই এবার পুরস্কার দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারত। এর জন্য এক বছর না হয় পুরস্কার কার্যক্রম স্থগিত থাকত। ইতোপূর্বে দু-একবার তো মনে হয় এমন ব্যাপার ঘটেছে যে কাউকেই সে বছর কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাতে কি প্রতিষ্ঠান হিসেবে একাডেমির মান-সম্মানের কোনো হানি ঘটেছে?
অতীতে বিভিন্ন সময় বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষণার পর পুরস্কারপ্রাপ্তদের দুয়েকজনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এবারে যা ঘটলো তাকে ‘অদৃষ্টপূর্ব’ বলে মন্তব্য করেন মোরশেদ শফিউল হাসান। তিনি বলেন, এর মধ্য দিয়ে কেবল পুরস্কারের মান বা ওজনই ক্ষুণ্ন হলো না, ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনসম্মুখে একাডেমির ভাবমূর্তিও ম্লান হলো, যা পুনরুদ্ধার করা সহজ হবে বলে মনে হয় না।
তার ভাষ্য, এভাবে কারো কোনো পুরস্কার প্রত্যাহার করে সে পুরস্কারটিই যদি ‘পুনর্বিবেচনা’র পর অন্য কাউকে দেওয়া হয়, নিজ ক্ষেত্রে তিনি যতই কৃতী বা যোগ্য হন, সে পুরস্কারটি গ্রহণ করতে তার কি আত্মসম্মানে বাধবে না? তিনি কি কিছুমাত্র লজ্জিত হবেন না? বছর আটেক আগে আমি নিজে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলাম এটা ভেবে আমি নিজেই যেখানে আজ গৌরবের পরিবর্তে কিছুটা হলেও বিব্রত বোধ করছি।
১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার দেওয়ার কথা রয়েছে।