এখন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার আবশ্যকতার যুগ চলমান। এ কথা বলার অবকাশ নেই যে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহা রয়েছে। যে বা যারা এই বিষয়ে অনাগ্রহ দেখাবে তারা প্রাচীনতম পদ্ধতিতে হালচাষ করার যুগেই থাকবেন বটে। এতে ক্ষতির পরিমাণ বলতে গেলে হাজারবার ‘নাউজুবিল্লাহ’ পড়েও কূল পাওয়া যাবে না।
ই-রিটার্ন বা অনলাইন রিটার্ন দেওয়ার পদ্ধতি বিগত ৫ বছরের আলোচ্য বিষয় হলেও এর অগ্রগতি যেন কিছু হয়নি। রাজস্ব বিভাগের সম্প্রতি উদ্যোগগুলো করদাতার জন্য সহায়ক হয়ে উঠছে। এটা ইতিবাচক দিক।
উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হলো অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের জন্য সিস্টেম ওপেন করে দেওয়া। এই সিস্টেম ব্যবহার করে অনেক করদাতা ঘরে বসেই তার আয়-ব্যয়, সম্পত্তির হিসাব দিয়ে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, রিটার্ন কপি, প্রাপ্তি স্বীকার, ট্যাক্স সার্টিফিকেট ইত্যাদি তিনি নিমিষেই প্রিন্ট করে নিতে পারেন। এই উদ্যোগের প্রশংসা করতে গিয়ে অর্থ উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন, ‘ট্যাক্স অফিসারের চেহারা না দেখলে করদাতা একটু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।’ এ জন্য আমরা নিরীহ করদাতারা শুকরিয়া আদায়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারি ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
একটু পর্যালোচনা করে দেখি এই সিস্টেম কি সত্যিই খুশি হবার মতো উপাদান রয়েছে কি না? প্রযুক্তির ব্যবহারে নাগরিক সচেতন হলে সময়ের সদ্ব্যবহার হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রযুক্তির ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাগুলো প্রদান করার জন্য স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে একটা অ্যাডমিন সেকশন আছে। এনবিআরের ক্ষেত্রেও অনলাইন সিস্টেম পরিচালনার অ্যাডমিন আছে। অ্যাডমিন পরিচালিত হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনায়। আমাদের কাছে প্রশ্ন জাগল, এনবিআরের অনলাইন অ্যাডমিন কি করদাতাদের জন্য সহায়ক সিস্টেমটির ব্যবহার করদাতার হাতে দিতে পেরেছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে। অনলাইন রিটার্ন সিস্টেমে দুই ধরনের রিটার্ন দাখিলের সুবিধা রাখা হয়েছে। প্রথমটি সিঙ্গেল পাতার বা এক পাতার রিটার্ন। দ্বিতীয়টি রেগুলার রিটার্ন বা বিস্তারিত বা বহু পাতার রিটার্ন।
অনলাইনে এই সিস্টেমে রিটার্ন দেওয়ার জন্য প্রথমে মোবাইল নম্বর ও ইটিআইএন ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। কিন্তু অনেক করদাতার এই রেজিস্ট্রেশন পর্যন্তই যেতে পারছেন না। রিটার্ন দেবেন কীভাবে? এটা বড় ত্রুটি হলো মোবাইল নম্বরে বায়োমেট্রিক সমস্যা। করদাতা যে নম্বর দিয়ে ইটিআইএন ওপেন করেছেন ঠিক ওই নম্বর ব্যবহার না করলে ই-রিটার্ন রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না। ফলে বহু করদাতা বিপাকে পড়েন ই-রিটার্ন জমা করার ক্ষেত্রে। এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান মহোদয় নিজেও এই সমস্যার কারণে তার নিজের রিটার্ন জমা দিতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন-২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
এখন দেখি যারা রেজিস্ট্রেশন করে ই-রিটার্ন জমা দেবেন তাদের অবস্থা কী?
সিঙ্গেল পাতা বা এক পাতার রিটার্ন দাখিল করতে পারবে শর্ত সাপেক্ষে কতিপয় করদাতা। যেমনÑ করযোগ্য আয় অনূর্ধ্ব ৫ লাখ টাকা, নিট সম্পত্তির পরিমাণ অনূর্ধ্ব ৫০ লাখ টাকা, গণকর্মচারী নন, মোটরযানের মালিক নন, সিটি করপোরেশনে গৃহসম্পত্তির মালিক নন, বিদেশে সম্পত্তির মালিক নন, কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ননÑ এমন করদাতারা এক পাতার রিটার্ন দিতে পারবেন। অর্থাৎ এই শ্রেণির করদাতারা সিঙ্গেল পাতার রিটার্ন দাখিলের জন্য উপযুক্ত করদাতা হবেন। এর বাইরের করদাতারা সিঙ্গেল পাতায় রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না। তাহলে এই সিঙ্গেল পাতায় রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে সুবিধাগুলো দেখা যাকÑ
১. করদাতা ঘরে বসে রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন;
২. সহজে প্রাপ্তি স্বীকার ও সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছেন;
৩. কোনো সংযুক্তি দিতে হচ্ছে না;
৪. করদাতা তথ্যগুলো নিজের মতো করে দিতে পারেন ইত্যাদি নানাবিধ সুবিধা।
এখন দেখা যাক এই সিঙ্গেল পাতার রিটার্ন দাখিলে কোনো অসুবিধা আছে কি না।
১. এই সিস্টেমে করদাতাকে কোনো তথ্য-প্রমাণ দিতে হয় না বলে যে কোনো করদাতা তার আয় গোপন করার সুযোগ থাকে। তা এনবিআরের পক্ষে বের করা অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল ব্যাপার।
২. আয়ের উৎসাহ সম্পর্কে ভুল তথ্য উপস্থাপনের সুযোগ।
৩. ন্যূনতম কর ফাঁকি দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৪. কোন কোন খাতে করদাতার নিট সম্পত্তি রয়েছে তা নির্ণয় করা যায় না।
৫. সম্পত্তি অর্জনের ক্ষেত্র অস্পষ্টতা থেকে যায়।
৬. একজন করদাতা না বুঝেও ভুল করার সুযোগ থাকে।
৭. অনভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
৮. সম্পত্তি গোপন করার মতো ভুল করতে পারে।
এসব ভুলের কারণে করদাতারা পরবর্তীকালে আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন এবং ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুপারিশ: সিঙ্গেল পাতার রিটার্নের সঙ্গে প্রামাণক দাখিল করার বিধান সংযুক্ত করা যেতে পারে। আয়ের খাত, ট্যাক্স পরিশোধও নিট পরিসম্পদের বিবরণ এবং এই সম্পত্তির একটি বিবরণ সংযুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে সচেতনতামূলক নির্দেশিকা থাকা দরকার, করদাতা ভুল তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করে রিটার্ন দাখিল করলে আইনি কাঠামোয় শাস্তির বিধানগুলো সংযুক্তিতে এমনভাবে থাকবেÑ যাতে ফাইল সাবমিশনের আগে করদাতার সামনে তা নোটিশ আকারে অটো চলে আসে।
রেগুলার রিটার্ন বা নিয়মিত রিটার্ন সিস্টেম: এই সিস্টেমে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করার ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য চিহ্নিত অপশনগুলো টিক চিহ্ন দিতে হয়।
অপশনগুলো সিলেকশন করার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট আয়ের খাতভিত্তিক ফরমেট আসে এবং তথ্যগুলো দিতে হয়।
এই সিস্টেমের সুবিধাগুলো দেখা যাকÑ
১. আয়ের খাতভিত্তিক রিটার্ন দাখিল করা যায়।
২. সম্পত্তির মূল্যসহ তথ্য দেওয়া যায়।
৩. এক বা একাধিক ব্যাংক হিসাব থাকলে তার তথ্য দেওয়া যায়।
৪. সঞ্চয়পত্রসহ সব বিনিয়োগের তথ্যাদি উপস্থাপনের সুযোগ আছে।
৫. সম্পত্তির পাশাপাশি দায়দেনার হিসাবও প্রদান করা যায়।
৬. কর পরিশোধের তথ্য উপস্থাপন। যেমনÑ উৎসে কর, অগ্রিম কর, রিটার্নের সঙ্গে প্রদেয় কর ইত্যাদি তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব।
৭. করদাতার নিট পরিসম্পদের তথ্য উপস্থাপন করার অপশনগুলো আছে। এই সিস্টেমে প্রায় সব তথ্যেও আর্থিক বিবরণী উপস্থাপন করা যাচ্ছে। এই সিস্টেমে রিটার্ন দাখিল করলে করদাতা কিছুটা নিরাপদ বোধ করবেন। কিন্তু এত তথ্য থাকার পরও সিস্টেমটির কিছু ত্রুটি আছে। যেমনÑ
১. এই সিস্টেম ও সংযুক্তির অপশন নেই। ফলে ভুল তথ্য আছে কি না তা যাচাই করা কঠিন হবে।
২. তথ্যগুলো ইংরেজিতে দেওয়া হয়। ফলে অনেক সাধারণ করদাতার তা বুঝতে অসুবিধা হতে পারে;
৩. তথ্য ইংরেজিতে দিলেও রিটার্ন তৈরি হয় বাংলা ফরমেটে। ফলে যারা ইরেজিতে অভ্যস্ত তাদের জন্য বুঝতে অসুবিধা হয়।
৪. করদাতার আয়ের একাধিক খাত থাকলেও তা গোপন থেকে যেতে পারে।
৫. পেশাজীবীদের জন্য আলাদা আয়ের খাত দেখানোর সুযোগ নেই। ফলে বিশাল অংশের করদাতা, বিশেষ করে পেশাজীবীরা অনলাইনে কর রিটার্ন দাখিল করতে বিব্রত বোধ করছেন।
৬. করদাতার নথি সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসগুলো প্রিন্টিং ভার্সন বা নিরাপদ ইলেকট্র্রনিক ভার্সন সংরক্ষণ করছেন কি না তা করদাতারা অবগত নয়। ফলে এই নথিগুলো কোনো কারণে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বেহাত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি করদাতার ব্যক্তিগত তথ্য অনুমতি ছাড়া অন্যের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সুপারিশ:
১. তথ্য প্রদান ও রিটার্ন ফরম বাংলা, ইংরেজি উভয় ফরমেটে থাকা দরকার।
২. করদাতার তথ্যের প্রামাণিকগুলো সংযুক্তির অপশন থাকা প্রয়োজন।
৩. করদাতার তথ্যের নিরাপদ সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
৪. মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সভা করে বায়োমেট্রিক মোবাইল নম্বর ও ই-টিআইএনের সমন্বয়ের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায় তা খতিয়ে দেখা এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আয়কর আইন ২০২৩-এর অংশ ২৪-এ ইলেকট্রনিক কর ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনা জারির বিষয়ে এনবিআর ক্ষমতাপ্রাপ্ত। উপরোক্ত দুই সিস্টেমের কর নথির জন্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে এনবিআর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। একই সঙ্গে করদাতার ইলেকট্র্রনিক কর নথি যথাযথভাবে সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসগুলোকে নির্দেশনা জারি করতে পারে। এতে করদাতারা অনলাইনে কর নথি জমা করতে উৎসাহিত হবে এবং করদাতার তথ্য নিরাপদ ও সংরক্ষিত থাকবে।
মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন: কর আইনজীবী