ঢাকা ০২:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫

অধিক মুনাফার লোভে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার

  • আপডেট সময় : ০৩:১৯:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১
  • ১১৮ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে দেশের শ্রমজীবী শিশুরা। আইনের সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও লাগামহীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বল্পমূল্যে শ্রম কিনতে লঙ্ঘন করা হচ্ছে শিশুদের মানবাধিকার।
যেকোনও দুর্ঘটনায় শিশুদেরই ক্ষতি হচ্ছে বেশি। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একটি জুস কারখানার অগ্নিকা-ে ব্যাপক হারে শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে আইনের কার্যকারিতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় গত ৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় আগুনের সূত্রপাত হয়। কারখানার ছয় তলা ভবনটিতে তখন চারশ’র বেশি কর্মী কাজ করছিলেন। কারখানায় কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, কাগজসহ প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সব ফ্লোরে। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই শিশু বলে জানা গেছে।
স্বল্পমূল্যে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে অধিক মুনাফার লক্ষ্য নিয়েই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মালিকরা শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত করছেন বলে মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন ‘সমাজের প্রতি যুবর উদ্যোগ’ এর সভাপতি অ্যাডভোকেট ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের আইনে সুস্পষ্টভাবে শিশুদের পূর্ণ বিকাশ সাধন, মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না করা, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত না করার বিধান রয়েছে। দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তথা পরবর্তী প্রজন্ম যেন আগামী দিনের জন্য গড়ে উঠেতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেসব কারণে শিশু শ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘জাতীয় শিশু জরিপ-২০১৩’ অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত আছে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেশের ১৩ লাখ শিশু। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের সার্বিক শ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শিশুশ্রমকে রোধ করা নিয়ে বিদ্যমান জাতীয় সিদ্ধান্ত ও আইনের ব্যবহার সম্পর্কে অ্যাডভোকেট তানজিলা রাহমান বলেন, ‘দেশে শিশু শ্রম রোধে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত ও আইন গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, জাতীয় শিশুশ্রম নির্মূল নীতি-২০১০, জাতীয় শিশুশ্রম কর্মপরিকল্পনা-২০১২ ও ২০১৬, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আইন, মানবপাচার রোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা কর্মসূচি-২০১৫ ও ২০১৭, জাতীয় শিক্ষানীতি এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা-২০১৬ ও ২০২০। এছাড়া আরও কিছু নীতিমালা রয়েছে, যা শিশুশ্রম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যথেষ্ট। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে শিশুশ্রম রোধে এবং শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করতে একত্রিত হয়েছিল। অথচ এত আইন, বিধিবিধান থাকার পরও সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম আইন অনুসারে ১৪ বছর পূর্ণ করেছে, কিন্তু ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নয় এবং শিশু আইন অনুসারে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নয়, এমন বয়সীদের শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এসব শিশুদের মোট ৩৮ প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমরা জেনেছি, নারায়ণগঞ্জের অগ্নিকা-ের ঘটনায় যেখানে ড্রাম ও বস্তা ভর্তি কেমিক্যাল পাওয়া গেছে, সেখানে কর্মরত শিশুদের অনেকেরই বয়স ছিল ১৪ বছরের নিচে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি সেখানে নিহত-আহত শিশুদের বিষয়ে মোটেই দায় এড়াতে পারে না।’

আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকা প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দেশে শিশুশ্রমের বিষয়ে ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইনে শিশুদের সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য বেশকিছু নীতিমালা রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপট ও যুগের চাহিদা অনুযায়ী, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সে আইনটি সংশোধীত হয় এবং আইনটির তৃতীয় অধ্যায়ে শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়। একই আইনে ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে কোনোপ্রকার শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আইন অনুসারে ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের লঘু দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে স্বাস্থ্যগত সনদ গ্রহণ করা সাপেক্ষে শিশুরা শ্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। অথচ আইনের এসব বিধান কার্যকর না করার কারণে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে গিয়ে শিশুদের হতাহত হয়ে বারবার সংবাদের শিরোনাম হতে হচ্ছে।’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

অধিক মুনাফার লোভে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার

আপডেট সময় : ০৩:১৯:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ জুলাই ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক: শারীরিক ও মানসিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে দেশের শ্রমজীবী শিশুরা। আইনের সুস্পষ্ট বিধান থাকার পরও লাগামহীনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বল্পমূল্যে শ্রম কিনতে লঙ্ঘন করা হচ্ছে শিশুদের মানবাধিকার।
যেকোনও দুর্ঘটনায় শিশুদেরই ক্ষতি হচ্ছে বেশি। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একটি জুস কারখানার অগ্নিকা-ে ব্যাপক হারে শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে আইনের কার্যকারিতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের সেজান জুস কারখানায় গত ৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় আগুনের সূত্রপাত হয়। কারখানার ছয় তলা ভবনটিতে তখন চারশ’র বেশি কর্মী কাজ করছিলেন। কারখানায় কেমিক্যাল, প্লাস্টিক, কাগজসহ প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সব ফ্লোরে। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই শিশু বলে জানা গেছে।
স্বল্পমূল্যে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে অধিক মুনাফার লক্ষ্য নিয়েই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মালিকরা শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত করছেন বলে মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন ‘সমাজের প্রতি যুবর উদ্যোগ’ এর সভাপতি অ্যাডভোকেট ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশের আইনে সুস্পষ্টভাবে শিশুদের পূর্ণ বিকাশ সাধন, মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না করা, শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত না করার বিধান রয়েছে। দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তথা পরবর্তী প্রজন্ম যেন আগামী দিনের জন্য গড়ে উঠেতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেসব কারণে শিশু শ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘জাতীয় শিশু জরিপ-২০১৩’ অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন শ্রমে নিয়োজিত আছে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে দেশের ১৩ লাখ শিশু। তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের সার্বিক শ্রম এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শিশুশ্রমকে রোধ করা নিয়ে বিদ্যমান জাতীয় সিদ্ধান্ত ও আইনের ব্যবহার সম্পর্কে অ্যাডভোকেট তানজিলা রাহমান বলেন, ‘দেশে শিশু শ্রম রোধে বেশ কিছু রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত ও আইন গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, জাতীয় শিশুশ্রম নির্মূল নীতি-২০১০, জাতীয় শিশুশ্রম কর্মপরিকল্পনা-২০১২ ও ২০১৬, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ আইন, মানবপাচার রোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা কর্মসূচি-২০১৫ ও ২০১৭, জাতীয় শিক্ষানীতি এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা-২০১৬ ও ২০২০। এছাড়া আরও কিছু নীতিমালা রয়েছে, যা শিশুশ্রম রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যথেষ্ট। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে শিশুশ্রম রোধে এবং শিশুদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করতে একত্রিত হয়েছিল। অথচ এত আইন, বিধিবিধান থাকার পরও সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম আইন অনুসারে ১৪ বছর পূর্ণ করেছে, কিন্তু ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নয় এবং শিশু আইন অনুসারে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে নয়, এমন বয়সীদের শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এসব শিশুদের মোট ৩৮ প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না বলেও এতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমরা জেনেছি, নারায়ণগঞ্জের অগ্নিকা-ের ঘটনায় যেখানে ড্রাম ও বস্তা ভর্তি কেমিক্যাল পাওয়া গেছে, সেখানে কর্মরত শিশুদের অনেকেরই বয়স ছিল ১৪ বছরের নিচে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি সেখানে নিহত-আহত শিশুদের বিষয়ে মোটেই দায় এড়াতে পারে না।’

আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকা প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘দেশে শিশুশ্রমের বিষয়ে ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রম আইনে শিশুদের সুরক্ষা ও কল্যাণের জন্য বেশকিছু নীতিমালা রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রেক্ষাপট ও যুগের চাহিদা অনুযায়ী, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে সে আইনটি সংশোধীত হয় এবং আইনটির তৃতীয় অধ্যায়ে শিশুশ্রমকে নিষিদ্ধ করা হয়। একই আইনে ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে কোনোপ্রকার শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আইন অনুসারে ১৪ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সী শিশুদের লঘু দায়িত্ব অর্পণ করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে স্বাস্থ্যগত সনদ গ্রহণ করা সাপেক্ষে শিশুরা শ্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। অথচ আইনের এসব বিধান কার্যকর না করার কারণে দেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে গিয়ে শিশুদের হতাহত হয়ে বারবার সংবাদের শিরোনাম হতে হচ্ছে।’