ঢাকা ০৪:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫

অতি মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট

  • আপডেট সময় : ০২:৪০:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ মে ২০২২
  • ১০৫ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ভোজ্য তেলের বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতায় হতাশা প্রকাশ করে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারের ‘বিশ্বাসের সুযোগ’ নিয়েছেন; বেশি লাভের আশায় পণ্য ধরে রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছেন।
“আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম এটাই আমাদের ব্যর্থতা। বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মিল মালিকরা কথা রাখলেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে।”
গতকাল সোমবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে টিপু মুনশি যখন সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন, তখনও ঢাকা ও চট্টগ্রামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান চলছিল। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বাজারে একটি দোকানে ‘গোপনে মজুদ করে রাখা’ ১৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেলের সন্ধান পেয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তিনটি দোকানকে তারা জরিমানা করেছেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করায়। এ মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় রান্নায় ব্যবহৃত সয়াবিন তেল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সায় নিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করেন মিল মালিকরা। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বাড়তি লাভের জন্য ব্যবসায়ীরা ১০ দিনে ৪০ হাজার টনের মতো সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুদ করেছেন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ধারণা। তেল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে টিপু মুনশি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের যেসব ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে চিহ্নিত। যখন যেখানে প্রয়োজন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু তারা সংখ্যায় লাখের ওপরে। এটা একটা সমস্যা।”
ব্যবসায়ীদের এই মজুদদারিতে বাণিজ্যমন্ত্রীর আস্থা নড়ে গেলেও দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে তার দ্বিমত নেই।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “সত্য যতই কঠিন হোক, তা মেনে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিন। পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের এখনকার দামও বিবেচনায় নিতে হবে।”
গত ফেব্রুয়ারি মাসে তেলের দাম নির্ধারণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির ফলে রোজার মধ্যেই আরেকবার দাম পরিবর্তন করা ‘প্রয়োজন ছিল’ বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
তবে রোজায় যাতে মানুষের কষ্ট না হয়, সেজন্য তিনি মিল মালিকদের অনুরোধ করে দাম বৃদ্ধি ‘কিছুটা বিলম্বিত’ করেছিলেন বলে জানান।
মন্ত্রী বলেন, “এখনতো দেখছি রোজার ভিতর একবার দাম বৃদ্ধি করাই ভালো ছিল। মিল মালিকরা মেনে নিলেও খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ঠিকই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঈদের পরে তেলের দাম বাড়বে, এটা সবাই অনুমান করতে পারছিলেন।” তেলের উচ্চমূল্যে দরিদ্র মানুষ যাতে চাপে না পড়ে, সেজন্য সরকার টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করবে। আগামী জুন মাসে টিসিবি এসব পণ্য সরবরাহ করবে।
৪০ হাজার টন সয়াবিন তেল মজুদদারদের ঘরে, ধারণা ভোক্তা অধিদপ্তরের : দেশে সয়াবিন তেল থাকলেও ঈদের আগে-পরে দোকানে তা না আসায় ১০ দিনে ৪০ হাজার টনের মতো সয়াবিন তেল মজুদ হয়েছে বলে ধারণা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত রোববার সারাদেশে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন দোকান-গুদাম থেকে মজুদ করা সয়াবিন তেল উদ্ধারের পর সার্বিক চিত্র সম্পর্কে এমন একটি ধারণা দেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, একদিকে মিল থেকে তেলের সরবরাহ ও অন্যদিকে ভোক্তারা তেলের নাগাল না পাওয়া সাপ্লাই চেইনের অন্তত ১০ দিনের তেল মজুদ হয়েছে। দৈনিক ৫ হাজার টন চাহিদা বিবেচনায় প্রায় ৪০ হাজার টন তেল মজুদ করা হতে পরে। বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বেশ কয়েকবার মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্ত হয়েছিলেন ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিল মালিকরা। তবে নতুন করে তা বাড়াতে রাজি হয়নি সরকার।
উল্টো তেলের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে দাম কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টাও সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। পাশাপাশি রোজা চলাকালীন সময়ে দাম না বাড়ালেও ঈদের পর বাজার পর্যালোচনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এই মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় দেশের রান্নার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সয়াবিন তেল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সায় নিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করেন মিল মালিকরা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “যেই তেল লিটার ১৬০ টাকা বিক্রি করার কথা, এখন ভোক্তাদের জিম্মি করে, বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সেটা ৪০ টাকা বেশি মুনাফা করবেন। এতে করে বাজার থেকে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা মজুদদারদের পকেটে চলে যাবে বলে প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে।” তবে এটা কোনো প্রামাণ্য হিসাব নয় বলে মানলেও তিনি বলেন, “তবে এধরনের ঘটনা যে ঘটছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
গত রোববার চট্টগ্রামের ষোলশহরে এক দোকানের গুদামে এক হাজার লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল খুঁজে পায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এমন উদ্ধার আরও কয়েকটি স্থানে ঘটেছে।
সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে লিটার ২০০ টাকার কাছাকাছি গেছে ঈদের পর। দোকানিরা আগে কেনা তেল বাড়তি দামে বিক্রি করছে কি না, তা দেখতে রোববার কারওয়ান বাজারে অভিযানে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে লিটার ২০০ টাকার কাছাকাছি গেছে ঈদের পর। দোকানিরা আগে কেনা তেল বাড়তি দামে বিক্রি করছে কি না, তা দেখতে রোববার কারওয়ান বাজারে অভিযানে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
ভোক্তা অধিকারের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার টন থেকে পাঁচ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা রয়েছে এবং তা মিল পর্যায় থেকে পূরণও করা হয়। ঈদের সময় যখন বাজারে তেলের সঙ্কট তখনও মিল থেকে তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল। ২৮ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল ইদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ার সময়ও বিভিন্ন কোম্পানির মিল থেকে তেল সরবরাহ করার তথ্য পাওয়া গেছে।
অধিদপ্তরের মনিটরিং সেল থেকে জানান হয়, ঈদের ছুটি শুরুর পরও ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ৭৮৮ টন সয়াবিন তেল ও ১৬৪১ টন পাম তেল সরবরাহ করেছে সিটি গ্রুপের (তীর ব্র্যান্ড) মিল। এমনকি ঈদের বন্ধের সময়ও ৩০ এপ্রিল থেকে ৪ মে এই পাঁচ দিনে ৯৪৩ টন সয়াবিন ও ৩৯২ টন পাম তেল বিপণন করা হয়েছে। একইভাবে মেঘনা গ্রুপের মিল থেকে ৭ মে তারিখে ২৫৪ টন সয়াবিন তেল সরবরাহ করা হয়েছে। মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা খুব সহজেই এমনটি হতে দেব না। বাজার বাজারের গতিতে চলবে। পাশাপাশি কেউ যাতে পুরোনো দামের তেল নিয়ে কারসাজি করে অতি মুনাফা করতে না পারে তা ধরতে নানা ধরনের মেকানিজম করছি।”
আইন অনুযায়ী একজন ব্যবসায়ী কতটুকু তেল বা অন্যান্য পণ্য মজুদ করতে পারবেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এটা কোনো সংখ্যার হিসাব নয়। কোন পরিস্থিতিতে কার কাছে পণ্য রয়েছে। সেই পণ্য সে বিক্রি না করে ধরে রেখেছে কিনা? বিক্রি করার সময় পাকা রশিদ দিচ্ছে কিনা? এসব কিছু দেখেই আমরা অনিয়ম চিহ্নিত করব।”
রোববার ঢাকার কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজারে অভিযান শেষে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকার জেলা কার্যালয়ের প্রধান আব্দুল জব্বার মন্ডল জানান, প্রতিটি দোকানেই নতুন দরের সয়াবিন তেলের বোতল শোভা পাচ্ছে। সয়াবিন তেলের সঙ্কট কেটে গেছে।
“একটি দোকানে আগের দামের তেল নতুন দামে বিক্রি করতে দেখে আমরা জরিমানা করেছি।”
সকালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ভার্চুয়াল বৈঠকে সংস্থাটির ৬৪ জেলা ও বিভাগীয় শহরের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়। সেই বৈঠক থেকে প্রতিটি জেলায় তালিকাভূক্ত ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে থাকা মজুদ ও কয়েক দিনের বিক্রির তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি, গ্লোব অয়েল ও বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মাঠের চিত্র মিলিয়ে দেখবো। যেখানেই তথ্যের গরমিল দেখা যাবে সেখানেই অভিযান চালানো হবে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি অভিযানে বেশ কিছু পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার অসাধু ব্যবসার বিয়ষটি চিহ্নিত হয়েছি।”
বেশি দামে বেচতে মজুদ, ধরা পড়ে জরিমানা : চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মুদি দোকানি সিরাজ সওদাগর বেশি লাভের আশায় ১৫ হাজার টন সয়াবিন তেল মজুদ করেছিলেন। রোজার মধ্যে পুরনো দামে কেনা সেই তেল এখন দাম বাড়ার পর তিনি নতুন দরে বিক্রি শুরু করেছিলেন। কিন্তু গতকাল সোমবার ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ধরা পড়ার পর তাকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছে। তবে তিনি যদি এই তেল নতুন দরে বিক্রি করতে পারতেন, তাহলে তার কমপক্ষে ৬ লাখ টাকা লাভ হত। কেননা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৪০ টাকা বেড়েছে।
এক কোটি পরিবার পাবে ১১০ টাকা মূল্যে সয়াবিন তেল : দেশের এক কোটি পরিবারকে দেওয়া হবে ১১০ টাকা দরে সয়াবিন তেল। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) আগামী জুন থেকে ন্যায্যমূল্যে এ তেল বিক্রি করবে কার্ডধারীদের কাছে। গত রোববার (৮ মে) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এ তথ্য জানান। বাণিজ্য সচিব বলেন, আগামী জুন থেকে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের কাছে ১১০ টাকা দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করা হবে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে সরাসরি সয়াবিন তেল আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। এই বিষয়ে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যেই সয়াবিন তেল কেনার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। সম্প্রতি সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ৩৮ টাকা বেড়ে ১৯৮ টাকা হওয়ায় এবং চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ না থাকায় সরকার সর্বনি¤œ মূল্যে এই তেল সরবরাহ নিশ্চিতের চেষ্টা করছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

অতি মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট

আপডেট সময় : ০২:৪০:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ মে ২০২২

নিজস্ব প্রতিবেদক : ভোজ্য তেলের বাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতায় হতাশা প্রকাশ করে বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরকারের ‘বিশ্বাসের সুযোগ’ নিয়েছেন; বেশি লাভের আশায় পণ্য ধরে রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি করেছেন।
“আমরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করেছিলাম এটাই আমাদের ব্যর্থতা। বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখেছি মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। মিল মালিকরা কথা রাখলেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে।”
গতকাল সোমবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে টিপু মুনশি যখন সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন, তখনও ঢাকা ও চট্টগ্রামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান চলছিল। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বাজারে একটি দোকানে ‘গোপনে মজুদ করে রাখা’ ১৫ হাজার লিটার সয়াবিন তেলের সন্ধান পেয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। আর ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে তিনটি দোকানকে তারা জরিমানা করেছেন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করায়। এ মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় রান্নায় ব্যবহৃত সয়াবিন তেল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সায় নিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করেন মিল মালিকরা। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
বাড়তি লাভের জন্য ব্যবসায়ীরা ১০ দিনে ৪০ হাজার টনের মতো সয়াবিন তেল অবৈধভাবে মজুদ করেছেন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ধারণা। তেল মজুদকারীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে টিপু মুনশি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের যেসব ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছেন, তারা ইতোমধ্যে চিহ্নিত। যখন যেখানে প্রয়োজন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু তারা সংখ্যায় লাখের ওপরে। এটা একটা সমস্যা।”
ব্যবসায়ীদের এই মজুদদারিতে বাণিজ্যমন্ত্রীর আস্থা নড়ে গেলেও দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়ে তার দ্বিমত নেই।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “সত্য যতই কঠিন হোক, তা মেনে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিন। পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের এখনকার দামও বিবেচনায় নিতে হবে।”
গত ফেব্রুয়ারি মাসে তেলের দাম নির্ধারণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির ফলে রোজার মধ্যেই আরেকবার দাম পরিবর্তন করা ‘প্রয়োজন ছিল’ বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী।
তবে রোজায় যাতে মানুষের কষ্ট না হয়, সেজন্য তিনি মিল মালিকদের অনুরোধ করে দাম বৃদ্ধি ‘কিছুটা বিলম্বিত’ করেছিলেন বলে জানান।
মন্ত্রী বলেন, “এখনতো দেখছি রোজার ভিতর একবার দাম বৃদ্ধি করাই ভালো ছিল। মিল মালিকরা মেনে নিলেও খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা ঠিকই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঈদের পরে তেলের দাম বাড়বে, এটা সবাই অনুমান করতে পারছিলেন।” তেলের উচ্চমূল্যে দরিদ্র মানুষ যাতে চাপে না পড়ে, সেজন্য সরকার টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে এক কোটি দরিদ্র পরিবারকে সাশ্রয়ী মূল্যে ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করবে। আগামী জুন মাসে টিসিবি এসব পণ্য সরবরাহ করবে।
৪০ হাজার টন সয়াবিন তেল মজুদদারদের ঘরে, ধারণা ভোক্তা অধিদপ্তরের : দেশে সয়াবিন তেল থাকলেও ঈদের আগে-পরে দোকানে তা না আসায় ১০ দিনে ৪০ হাজার টনের মতো সয়াবিন তেল মজুদ হয়েছে বলে ধারণা করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গত রোববার সারাদেশে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন দোকান-গুদাম থেকে মজুদ করা সয়াবিন তেল উদ্ধারের পর সার্বিক চিত্র সম্পর্কে এমন একটি ধারণা দেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, একদিকে মিল থেকে তেলের সরবরাহ ও অন্যদিকে ভোক্তারা তেলের নাগাল না পাওয়া সাপ্লাই চেইনের অন্তত ১০ দিনের তেল মজুদ হয়েছে। দৈনিক ৫ হাজার টন চাহিদা বিবেচনায় প্রায় ৪০ হাজার টন তেল মজুদ করা হতে পরে। বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে বেশ কয়েকবার মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্ত হয়েছিলেন ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী মিল মালিকরা। তবে নতুন করে তা বাড়াতে রাজি হয়নি সরকার।
উল্টো তেলের উপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে দাম কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টাও সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। পাশাপাশি রোজা চলাকালীন সময়ে দাম না বাড়ালেও ঈদের পর বাজার পর্যালোচনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে এই মাসের শুরুতে ঈদের আগে খুচরা বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় দেশের রান্নার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সয়াবিন তেল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সায় নিয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ২০০ টাকার কাছাকাছি নির্ধারণ করেন মিল মালিকরা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “যেই তেল লিটার ১৬০ টাকা বিক্রি করার কথা, এখন ভোক্তাদের জিম্মি করে, বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা সেটা ৪০ টাকা বেশি মুনাফা করবেন। এতে করে বাজার থেকে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা মজুদদারদের পকেটে চলে যাবে বলে প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে।” তবে এটা কোনো প্রামাণ্য হিসাব নয় বলে মানলেও তিনি বলেন, “তবে এধরনের ঘটনা যে ঘটছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
গত রোববার চট্টগ্রামের ষোলশহরে এক দোকানের গুদামে এক হাজার লিটার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল খুঁজে পায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এমন উদ্ধার আরও কয়েকটি স্থানে ঘটেছে।
সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে লিটার ২০০ টাকার কাছাকাছি গেছে ঈদের পর। দোকানিরা আগে কেনা তেল বাড়তি দামে বিক্রি করছে কি না, তা দেখতে রোববার কারওয়ান বাজারে অভিযানে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে লিটার ২০০ টাকার কাছাকাছি গেছে ঈদের পর। দোকানিরা আগে কেনা তেল বাড়তি দামে বিক্রি করছে কি না, তা দেখতে রোববার কারওয়ান বাজারে অভিযানে যায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
ভোক্তা অধিকারের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার টন থেকে পাঁচ হাজার টন সয়াবিন ও পাম তেলের চাহিদা রয়েছে এবং তা মিল পর্যায় থেকে পূরণও করা হয়। ঈদের সময় যখন বাজারে তেলের সঙ্কট তখনও মিল থেকে তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল। ২৮ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল ইদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ার সময়ও বিভিন্ন কোম্পানির মিল থেকে তেল সরবরাহ করার তথ্য পাওয়া গেছে।
অধিদপ্তরের মনিটরিং সেল থেকে জানান হয়, ঈদের ছুটি শুরুর পরও ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ৭৮৮ টন সয়াবিন তেল ও ১৬৪১ টন পাম তেল সরবরাহ করেছে সিটি গ্রুপের (তীর ব্র্যান্ড) মিল। এমনকি ঈদের বন্ধের সময়ও ৩০ এপ্রিল থেকে ৪ মে এই পাঁচ দিনে ৯৪৩ টন সয়াবিন ও ৩৯২ টন পাম তেল বিপণন করা হয়েছে। একইভাবে মেঘনা গ্রুপের মিল থেকে ৭ মে তারিখে ২৫৪ টন সয়াবিন তেল সরবরাহ করা হয়েছে। মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা খুব সহজেই এমনটি হতে দেব না। বাজার বাজারের গতিতে চলবে। পাশাপাশি কেউ যাতে পুরোনো দামের তেল নিয়ে কারসাজি করে অতি মুনাফা করতে না পারে তা ধরতে নানা ধরনের মেকানিজম করছি।”
আইন অনুযায়ী একজন ব্যবসায়ী কতটুকু তেল বা অন্যান্য পণ্য মজুদ করতে পারবেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এটা কোনো সংখ্যার হিসাব নয়। কোন পরিস্থিতিতে কার কাছে পণ্য রয়েছে। সেই পণ্য সে বিক্রি না করে ধরে রেখেছে কিনা? বিক্রি করার সময় পাকা রশিদ দিচ্ছে কিনা? এসব কিছু দেখেই আমরা অনিয়ম চিহ্নিত করব।”
রোববার ঢাকার কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজারে অভিযান শেষে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকার জেলা কার্যালয়ের প্রধান আব্দুল জব্বার মন্ডল জানান, প্রতিটি দোকানেই নতুন দরের সয়াবিন তেলের বোতল শোভা পাচ্ছে। সয়াবিন তেলের সঙ্কট কেটে গেছে।
“একটি দোকানে আগের দামের তেল নতুন দামে বিক্রি করতে দেখে আমরা জরিমানা করেছি।”
সকালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে ভার্চুয়াল বৈঠকে সংস্থাটির ৬৪ জেলা ও বিভাগীয় শহরের প্রতিনিধিদের যুক্ত করা হয়। সেই বৈঠক থেকে প্রতিটি জেলায় তালিকাভূক্ত ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে থাকা মজুদ ও কয়েক দিনের বিক্রির তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি, গ্লোব অয়েল ও বসুন্ধরা গ্রুপের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মাঠের চিত্র মিলিয়ে দেখবো। যেখানেই তথ্যের গরমিল দেখা যাবে সেখানেই অভিযান চালানো হবে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি অভিযানে বেশ কিছু পাইকারি বিক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতার অসাধু ব্যবসার বিয়ষটি চিহ্নিত হয়েছি।”
বেশি দামে বেচতে মজুদ, ধরা পড়ে জরিমানা : চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মুদি দোকানি সিরাজ সওদাগর বেশি লাভের আশায় ১৫ হাজার টন সয়াবিন তেল মজুদ করেছিলেন। রোজার মধ্যে পুরনো দামে কেনা সেই তেল এখন দাম বাড়ার পর তিনি নতুন দরে বিক্রি শুরু করেছিলেন। কিন্তু গতকাল সোমবার ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে ধরা পড়ার পর তাকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা গুণতে হয়েছে। তবে তিনি যদি এই তেল নতুন দরে বিক্রি করতে পারতেন, তাহলে তার কমপক্ষে ৬ লাখ টাকা লাভ হত। কেননা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৪০ টাকা বেড়েছে।
এক কোটি পরিবার পাবে ১১০ টাকা মূল্যে সয়াবিন তেল : দেশের এক কোটি পরিবারকে দেওয়া হবে ১১০ টাকা দরে সয়াবিন তেল। সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) আগামী জুন থেকে ন্যায্যমূল্যে এ তেল বিক্রি করবে কার্ডধারীদের কাছে। গত রোববার (৮ মে) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ এ তথ্য জানান। বাণিজ্য সচিব বলেন, আগামী জুন থেকে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের কাছে ১১০ টাকা দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করা হবে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে সরাসরি সয়াবিন তেল আমদানির পরিকল্পনা নিয়েছে। এই বিষয়ে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যেই সয়াবিন তেল কেনার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। সম্প্রতি সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ৩৮ টাকা বেড়ে ১৯৮ টাকা হওয়ায় এবং চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ না থাকায় সরকার সর্বনি¤œ মূল্যে এই তেল সরবরাহ নিশ্চিতের চেষ্টা করছে।