ঢাকা ০৪:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাইকোর্টের বিচারপতিকে ডিম ছোঁড়া গভীর উদ্বেগের

  • আপডেট সময় : ০৭:৫১:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ২৫ বার পড়া হয়েছে

গাজী তারেক আজিজ

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। গত ২৭ নভেম্বর বুধবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন চলাকালীন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের বেঞ্চে কয়েকজন আইনজীবী বিচারকদের উদ্দেশে ডিম ছুঁড়ে মারেন। উক্ত ঘটনা শুধু নিন্দনীয়ই নয় ন্যক্কারজনকও বটে। যে ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ স্তম্ভিত, হতভম্ব ও বিস্মিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ওই বিচারপতিদের করা মন্তব্যের জেরে আইনজীবীরা এ ঘটনা ঘটান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। ঘটনার পর মাননীয় বিচারপতিদ্বয় এজলাস ছেড়ে যান।
বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় বলেও জানা গেছে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এজলাসে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে তা কারও জন্যই সুখকর তো নয়ই উপরন্তু কষ্ট ও বেদনাদায়ক। অতীতে নিম্ন আদালতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোলের কথাও আমরা জানি। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারকের উদ্দেশে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা এই প্রথম। ঘটনা জানাজানি হলে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারার ঘটনা শুধু একজন বিচারকের ওপর নয়, এটা পুরো বিচার বিভাগের উপর আঘাত।’ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে এ ঘটনা।’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারার সঙ্গে জড়িতদের তদন্ত সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির বক্তব্য আরো স্পষ্ট এবং তড়িৎ পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল।
বৈঠকে পরিকল্পনা করে ডিম ছোঁড়ার অভিযোগ করছেন বিজ্ঞ আইনজীবীদের অনেকেই। তার মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আগে থেকে পরিকল্পনা করে এভাবে আদালতের প্রতি অবমাননা করা বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপের শামিল। আমরা চাই, এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আগেও কিন্তু আদালত অবমাননার ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বুধবারের ঘটনায় আমরা কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেখিনি। এমনকি আইন উপদেষ্টাও কোনো কথা বলেননি। তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর মনে করছেন নিজেকে। যে ঘটনাটি ঘটে গেল, যারা এটা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য। এটা তো খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকলে। ভবিষ্যতে এই ঘটনা কাউকে উৎসাহিত করতে পারে। এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। একটা কোর্টে এটা হওয়া মানে পুরো জুডিশিয়ারিতেই হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে। উচ্চ আদালতের একটা বেঞ্চে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো যেনতেন ব্যাপার নয়। আমরা আশা করেছিলাম, শুধু বিবৃতি নয়; কোনো একটা ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন প্রধান বিচারপতি। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিচার করতে গিয়ে তিনি কোনো রায়ে কী লিখেছেন সে কারণে যদি অপদস্থ হতে হয়, তাহলে কোনো বিচারকই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বা মন্তব্য লিখতে পারবেন না।’
এর থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি? এই কথা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, সকল আইনজীবীকে হতবাক করেছে এহেন কাণ্ড। যা অতীতের সকল পর্যায়ের ঘৃণিত কাজকেও নিমিষেই ছাপিয়ে গেছে। আইনজীবী কর্তৃক এরূপ কাজ এর আগে কখনও শোনা যায়নি। অন্তত আমার জানা মতে তো নয়ই! সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এ পর্যন্ত কোনো বক্তব্য বিবৃতি না দিলেও ঘটনাকে হালকা করে দেখার যে সুযোগ নেই সেটা বেশ ভালো করেই জানান দিয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। তিনি ইতোমধ্যে দেশের সকল আদালত ও বিচারকের নিরাপত্তায় জোর দিতে নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন।
আমরা এর আগেও দেখেছি গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। তা ও বিচারালয়ের জন্য ছিল অস্বস্তির। এবং ভালো নজির স্থাপন করেনি। বিগত সরকারের কলঙ্কিত অধ্যায়ের একটি এটি। এতদিন পরেও যে বিষয়টি ঘুরেফিরে আসছে। তাহলে আমরা কি ধরে নেব, অন্তর্বর্তী সরকারও সে পথেই হাঁটছে? যদিও একটু ভিন্নতা রয়েছে এই সরকার নির্বাচিত নয়। তাই বলে কি জবাবদিহি করতে হবে না? যদি তেমনটা ভেবে থাকে তবে হয়তো দায় এড়াতে বলতে পারে এমনটা সরকার কিংবা কোনো সংস্থার কেউ করেনি। তথাপিও সরকারের তরফ থেকে অবশ্যই একটা ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ছিল দেশের জনগণের তথা বিচারপ্রত্যাশী জনগণের। যেহেতু ঘটনাটি ঘটিয়েছে সংশ্লিষ্ট আদালতে প্র্যাকটিসরত কতেক আইনজীবী।
এসব কর্মকাণ্ড দেখে একজন আইনজীবী হিসেবেই মনে প্রশ্ন জাগে, আইনজীবীরা কি পেশাগত মর্যাদার কথা ভুলে যেতে বসেছেন? যদি তা ই না হবে তাহলে রাস্তার মাস্তানদের কাতারে নিজেদের নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন? বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও একটা বিষয় মনে রাখতে হবে রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থেই শুধু ব্যবহার করবে। এর বাইরে আদালতই হচ্ছে পেশাগত উৎকর্ষের জায়গা; যেখানে থেকে বিচারক তথা বিচার বিভাগের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো সমীচীন নয়। কারণ এই আদালতে প্রাকটিস করেই অধিকাংশ আইনজীবী বিচারপতি হয়েছেন। তাই আইনজীবী হিসেবে সে সুযোগ নিশ্চয়ই বেশির ভাগের কাছে প্রত্যাশিত। আবার ন্যাচারাল জাস্টিস বলেও একটা কথা আছে। আপনি যা করবেন তা ঠিক কোনো না কোনো সময় আপনার দিকে তির হয়ে ফিরে আসবে। সে সময় হয়তো আপনার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে কিন্তু কাউকে দেখাতে পারবেন না। বলেও বোঝাতে পারবেন না। শুধু গুমরে কেঁদে চোখ ভেজাবেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন নজিরও আমি দেখেছি।
এই আইনজীবীরা কোনো না কোনো দলের সমর্থক তো বটেই। তবে অতিউৎসাহীও এতে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই। দেশের মানুষের বিচার বিভাগের প্রতি যে মর্যাদা বা সম্মান সেটি সমুন্নত রাখতে হলেও দোষী যদি কোনো আইনজীবী কিংবা নেপথ্যের কেউ থেকে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরি হবে। তা না হলে যে কোনো লোক এহেন আচরণ করে পার পেয়ে যেতে পারে; যা কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। তা ছাড়া ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি আদালত আঙিনায় অভিযুক্ত আসামির সাথে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করা থেকে নিবৃত করা যায়নি; বরং আরো বেড়েই চলেছে। মানুষ রাস্তাঘাট তো দূরে থাক, এখন হাসপাতালেও নিরাপদ নয়।
গত ৩০ নভেম্বর আওয়ামী আমলের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সাথে যা ঘটানো হয়েছে, সেটিও লজ্জার। বিগত সরকারের সময়ে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকেও আদালত অঙ্গনেই রক্তাক্ত করা হয়েছিল। সেটিও ভুলে যাওয়া চলবে না। এই সরকারের সময়ে সাবেক বিচারপতি সামছুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সাথে যা করা হয়েছে তাও ছিল অনভিপ্রেত। আর বিভিন্ন ভার্সিটিতে পিটিয়ে মারার কথা কে না জানে? তোফাজ্জলের সাথে ঘটানো ঘটনায় মানুষ শিউরে উঠেছিল। যা দেখলে মানুষ মূর্ছা যাবার উপক্রম হবে যে কারও!
এভাবে চলতে থাকলে মানুষ অনিরাপদ ভেবে হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে গুপ্তহামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে। যেটা সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও ইঙ্গিত করেছেন। যদি সে পরিস্থিতির উদয় হয় তবে তা-ও যে ভয়াবহ হতে পারে সাম্প্রতিক পাকিস্তান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। আর এই উদাহরণ মোটেই আদর্শিক নয়। আমরা তেমন পরিস্থিতি প্রত্যাশা করি না।
আমরা চাই সরকার শুধু সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করবেন না। নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে মব থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে নির্বিঘ্নে নিরাপদে বাড়ি ফিরবে। অন্তত সে নিশ্চয়তা চাইবার অধিকার আমাদের সকলের রয়েছে; যা সরকারের একচ্ছত্র দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যে বিপ্লব জনআকাঙ্খার কথা বলবার কথা, সেই বিপ্লব পথিমধ্যে মুখ থবড়ে পড়লে তার পরিণতও যে ভয়াবহ হবে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই আদালতের এখতিয়ার হিসেবে এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যেমন জরুরী তেমনি সকল আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বার কাউন্সিলের ভূমিকাও নজিরবিহীন হবে- এমনটাই জনমানুষ প্রত্যাশা করে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

হাইকোর্টের বিচারপতিকে ডিম ছোঁড়া গভীর উদ্বেগের

আপডেট সময় : ০৭:৫১:১৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪

গাজী তারেক আজিজ

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। গত ২৭ নভেম্বর বুধবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন চলাকালীন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলামের বেঞ্চে কয়েকজন আইনজীবী বিচারকদের উদ্দেশে ডিম ছুঁড়ে মারেন। উক্ত ঘটনা শুধু নিন্দনীয়ই নয় ন্যক্কারজনকও বটে। যে ঘটনায় পুরো দেশের মানুষ স্তম্ভিত, হতভম্ব ও বিস্মিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ওই বিচারপতিদের করা মন্তব্যের জেরে আইনজীবীরা এ ঘটনা ঘটান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। ঘটনার পর মাননীয় বিচারপতিদ্বয় এজলাস ছেড়ে যান।
বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় বলেও জানা গেছে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এজলাসে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে তা কারও জন্যই সুখকর তো নয়ই উপরন্তু কষ্ট ও বেদনাদায়ক। অতীতে নিম্ন আদালতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বাদী ও বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোলের কথাও আমরা জানি। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারকের উদ্দেশে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা এই প্রথম। ঘটনা জানাজানি হলে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারার ঘটনা শুধু একজন বিচারকের ওপর নয়, এটা পুরো বিচার বিভাগের উপর আঘাত।’ এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে এ ঘটনা।’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারার সঙ্গে জড়িতদের তদন্ত সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বারের সদস্যপদ বাতিল হতে পারে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতির বক্তব্য আরো স্পষ্ট এবং তড়িৎ পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল।
বৈঠকে পরিকল্পনা করে ডিম ছোঁড়ার অভিযোগ করছেন বিজ্ঞ আইনজীবীদের অনেকেই। তার মধ্যে সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আগে থেকে পরিকল্পনা করে এভাবে আদালতের প্রতি অবমাননা করা বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপের শামিল। আমরা চাই, এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আগেও কিন্তু আদালত অবমাননার ঘটনা আমরা দেখেছি। কিন্তু সেইসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বুধবারের ঘটনায় আমরা কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোনো বিবৃতি দেখিনি। এমনকি আইন উপদেষ্টাও কোনো কথা বলেননি। তাদের এ ব্যাপারে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কেউ কেউ রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতাধর মনে করছেন নিজেকে। যে ঘটনাটি ঘটে গেল, যারা এটা করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি, উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য। এটা তো খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকলে। ভবিষ্যতে এই ঘটনা কাউকে উৎসাহিত করতে পারে। এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। একটা কোর্টে এটা হওয়া মানে পুরো জুডিশিয়ারিতেই হয়েছে বলে বিবেচনা করতে হবে। উচ্চ আদালতের একটা বেঞ্চে এই ধরনের ঘটনা ঘটানো যেনতেন ব্যাপার নয়। আমরা আশা করেছিলাম, শুধু বিবৃতি নয়; কোনো একটা ব্যবস্থার মধ্যে যাবেন প্রধান বিচারপতি। আমরা অপেক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিচার করতে গিয়ে তিনি কোনো রায়ে কী লিখেছেন সে কারণে যদি অপদস্থ হতে হয়, তাহলে কোনো বিচারকই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না বা মন্তব্য লিখতে পারবেন না।’
এর থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি? এই কথা থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, সকল আইনজীবীকে হতবাক করেছে এহেন কাণ্ড। যা অতীতের সকল পর্যায়ের ঘৃণিত কাজকেও নিমিষেই ছাপিয়ে গেছে। আইনজীবী কর্তৃক এরূপ কাজ এর আগে কখনও শোনা যায়নি। অন্তত আমার জানা মতে তো নয়ই! সরকারের দায়িত্বশীল কেউ এ পর্যন্ত কোনো বক্তব্য বিবৃতি না দিলেও ঘটনাকে হালকা করে দেখার যে সুযোগ নেই সেটা বেশ ভালো করেই জানান দিয়েছেন মাননীয় প্রধান বিচারপতি। তিনি ইতোমধ্যে দেশের সকল আদালত ও বিচারকের নিরাপত্তায় জোর দিতে নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন।
আমরা এর আগেও দেখেছি গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল। তা ও বিচারালয়ের জন্য ছিল অস্বস্তির। এবং ভালো নজির স্থাপন করেনি। বিগত সরকারের কলঙ্কিত অধ্যায়ের একটি এটি। এতদিন পরেও যে বিষয়টি ঘুরেফিরে আসছে। তাহলে আমরা কি ধরে নেব, অন্তর্বর্তী সরকারও সে পথেই হাঁটছে? যদিও একটু ভিন্নতা রয়েছে এই সরকার নির্বাচিত নয়। তাই বলে কি জবাবদিহি করতে হবে না? যদি তেমনটা ভেবে থাকে তবে হয়তো দায় এড়াতে বলতে পারে এমনটা সরকার কিংবা কোনো সংস্থার কেউ করেনি। তথাপিও সরকারের তরফ থেকে অবশ্যই একটা ব্যাখ্যা প্রত্যাশিত ছিল দেশের জনগণের তথা বিচারপ্রত্যাশী জনগণের। যেহেতু ঘটনাটি ঘটিয়েছে সংশ্লিষ্ট আদালতে প্র্যাকটিসরত কতেক আইনজীবী।
এসব কর্মকাণ্ড দেখে একজন আইনজীবী হিসেবেই মনে প্রশ্ন জাগে, আইনজীবীরা কি পেশাগত মর্যাদার কথা ভুলে যেতে বসেছেন? যদি তা ই না হবে তাহলে রাস্তার মাস্তানদের কাতারে নিজেদের নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন? বিজ্ঞ আইনজীবীদেরও একটা বিষয় মনে রাখতে হবে রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থেই শুধু ব্যবহার করবে। এর বাইরে আদালতই হচ্ছে পেশাগত উৎকর্ষের জায়গা; যেখানে থেকে বিচারক তথা বিচার বিভাগের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো সমীচীন নয়। কারণ এই আদালতে প্রাকটিস করেই অধিকাংশ আইনজীবী বিচারপতি হয়েছেন। তাই আইনজীবী হিসেবে সে সুযোগ নিশ্চয়ই বেশির ভাগের কাছে প্রত্যাশিত। আবার ন্যাচারাল জাস্টিস বলেও একটা কথা আছে। আপনি যা করবেন তা ঠিক কোনো না কোনো সময় আপনার দিকে তির হয়ে ফিরে আসবে। সে সময় হয়তো আপনার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে কিন্তু কাউকে দেখাতে পারবেন না। বলেও বোঝাতে পারবেন না। শুধু গুমরে কেঁদে চোখ ভেজাবেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে এমন নজিরও আমি দেখেছি।
এই আইনজীবীরা কোনো না কোনো দলের সমর্থক তো বটেই। তবে অতিউৎসাহীও এতে কোনো সন্দেহ থাকার কারণ নেই। দেশের মানুষের বিচার বিভাগের প্রতি যে মর্যাদা বা সম্মান সেটি সমুন্নত রাখতে হলেও দোষী যদি কোনো আইনজীবী কিংবা নেপথ্যের কেউ থেকে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরি হবে। তা না হলে যে কোনো লোক এহেন আচরণ করে পার পেয়ে যেতে পারে; যা কারো কাছেই কাম্য হতে পারে না। তা ছাড়া ইতোমধ্যেই আমরা দেখেছি আদালত আঙিনায় অভিযুক্ত আসামির সাথে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করা থেকে নিবৃত করা যায়নি; বরং আরো বেড়েই চলেছে। মানুষ রাস্তাঘাট তো দূরে থাক, এখন হাসপাতালেও নিরাপদ নয়।
গত ৩০ নভেম্বর আওয়ামী আমলের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সাথে যা ঘটানো হয়েছে, সেটিও লজ্জার। বিগত সরকারের সময়ে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকেও আদালত অঙ্গনেই রক্তাক্ত করা হয়েছিল। সেটিও ভুলে যাওয়া চলবে না। এই সরকারের সময়ে সাবেক বিচারপতি সামছুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সাথে যা করা হয়েছে তাও ছিল অনভিপ্রেত। আর বিভিন্ন ভার্সিটিতে পিটিয়ে মারার কথা কে না জানে? তোফাজ্জলের সাথে ঘটানো ঘটনায় মানুষ শিউরে উঠেছিল। যা দেখলে মানুষ মূর্ছা যাবার উপক্রম হবে যে কারও!
এভাবে চলতে থাকলে মানুষ অনিরাপদ ভেবে হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে গুপ্তহামলায় জড়িয়ে পড়তে পারে। যেটা সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও ইঙ্গিত করেছেন। যদি সে পরিস্থিতির উদয় হয় তবে তা-ও যে ভয়াবহ হতে পারে সাম্প্রতিক পাকিস্তান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। আর এই উদাহরণ মোটেই আদর্শিক নয়। আমরা তেমন পরিস্থিতি প্রত্যাশা করি না।
আমরা চাই সরকার শুধু সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করবেন না। নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে মব থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে নির্বিঘ্নে নিরাপদে বাড়ি ফিরবে। অন্তত সে নিশ্চয়তা চাইবার অধিকার আমাদের সকলের রয়েছে; যা সরকারের একচ্ছত্র দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যে বিপ্লব জনআকাঙ্খার কথা বলবার কথা, সেই বিপ্লব পথিমধ্যে মুখ থবড়ে পড়লে তার পরিণতও যে ভয়াবহ হবে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই আদালতের এখতিয়ার হিসেবে এই ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যেমন জরুরী তেমনি সকল আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে বার কাউন্সিলের ভূমিকাও নজিরবিহীন হবে- এমনটাই জনমানুষ প্রত্যাশা করে।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ