ক্যাম্পাস ও ক্যারিয়ার ডেস্ক: বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের তিন চতুর্থাংশই হতাশায় ভুগছেন বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। শুক্রবার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে সমীক্ষার ফল তুলে ধরে। হতাশার উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে- ক্লান্তি, ওজন কমে যাওয়া, কোনো কিছু উপভোগ না করা, ঘুমের ধরনের পরিবর্তন, আত্মহত্যার চিন্তা, কাজে মনোযোগ দিতে না পারা ইত্যাদি। আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ’ শীর্ষক এ সমীক্ষায় দেশের সরকারি-বেসরকারি ৮৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ১ হাজার ৫৭০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সমীক্ষাটি পরিচালনা করা হয়।
বেশি ভুগছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা: হতাশা অনুভব করার হার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশি বলে সমীক্ষার ফলে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩.৪ শতাংশ শিক্ষার্থীই হতাশার উপসর্গগুলোর মুখোমুখি হয়েছেন। বাকি ১৬.৬ শতাংশ বলেছেন, তাদের মাঝে হতাশার উপসর্গ দেখা যায়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশার চিত্র তুলনামূলক কম। ৭৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা হতাশার উপসর্গগুলো অনুভব করেছেন। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা এই ধরনের উপসর্গের মধ্য দিয়ে গেছেন।
যেসব কারণ সামনে আসছে: সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করার কারণে হতাশায় ভোগার কথা বলেছেন ১৬.২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া পড়াশোনা নিয়ে ৯.৪ শতাংশ, হল বা আবাসিক পরিবেশ নিয়ে ৯ শতাংশ এবং সহপাঠী বা শিক্ষকের বুলিংয়ের কারণে ৫.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী দুশ্চিন্তায় ভোগার কথা বলেছেন। আর সবগুলো কারণেই হতাশাগ্রস্ত- এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১.৬ শতাংশ। আরো ৩.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য কারণে হতাশায় ভুগছেন।
নিপীড়ন: সহপাঠী, সিনিয়র কিংবা শিক্ষকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন ৩১.১ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৫.৯ শতাংশ, র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৩.৪ শতাংশ এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১.৮ শতাংশ। আর ৬৮.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা কোনো ধরনের হয়রানির শিকার হননি।
হয়রানিতে এগিয়ে সহপাঠী ও সিনিয়ররা: বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহপাঠী বা সিনিয়রের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন ৮৫.৫ শতাংশ। শিক্ষকের মাধ্যমে ৭.৬ শতাংশ, স্টাফের মাধ্যমে ১.২ শতাংশ এবং অন্যদের মাধ্যমে ৫.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হয়েছেন। হয়রানির ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে ৪২.৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর, মোটামুটি প্রভাব পড়েছে ৪৮.৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর এবং কোনো প্রভাব পড়েনি ৮.৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে অসন্তোষ: বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পরিবেশ নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট- এই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল সবার কাছেই। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে পুরোপুরি অসন্তুষ্ট ৩৩.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, মোটামুটি সন্তুষ্ট ৫৮.১ শতাংশ এবং পুরোপুরি সন্তুষ্ট মাত্র ৮.৪ শতাংশ।
মন খুলে কথা বলার মতো শিক্ষক কম: সমীক্ষায় ৫৯.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা মন খুলে কথা বলার মত কোনো শিক্ষক পান না। এর মাঝে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না এবং ৩৭.১ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা খুব সহজে নিজ বিভাগের শিক্ষকদের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫৮.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং ৪১.২ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভাগের অন্য সদস্যদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
হলের পরিবেশও প্রভাব ফেলছে: বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেকেই হল বা ডরমিটরিতে অবস্থান করে। হলে থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার পরিবেশও একজন শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। হলের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ৩৯.৩ শতাংশ বলেছেন, তারা পুরোপুরি অসন্তুষ্ট। সন্তুষ্টির কথা বলেছেন মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা বলেছেন, তারা মোটামুটি সন্তুষ্ট। অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে ৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী থাকার পরিবেশকে দায়ী করেছেন। অনুন্নত খাবারকে দায়ী করেছেন ৭.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। রিডিং রুম বা গ্রন্থাগারের সংকট মনে করছেন ৩.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং সবগুলো কারণকেই দায়ী করছেন ৬৮.২ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া ১০.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা অন্যান্য কারণকে অসন্তুষ্টির জন্য দায়ী করছেন। ৭০.১ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, হলের পরিবেশ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিদেশমুখী প্রবণতা: সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের ক্যারিয়ার ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সেখানে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। জরিপে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ৩১.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, ২৯.৭ শতাংশ শিক্ষার্থী চান সরকারি চাকরি করতে, ৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যবসা বা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, মাত্র ৭.১ শতাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারি চাকরি করতে চান। বাকি ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা ক্যারিয়ার ভাবনা এখনো ঠিক করেননি।
আছে আত্মহত্যার ভাবনাও: প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতা এবং প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পারা থেকেই আত্মহত্যার চিন্তা মস্তিষ্কে বাসা বাঁধে। আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক দল শিক্ষার্থীদের কাছে আত্মহত্যা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন রেখেছিল। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন ৫.৯ শতাংশ, আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে, কিন্তু চেষ্টা করেননি-এমন শিক্ষার্থীর হার ৩৯.২ শতাংশ। আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে এবং উপকরণও জোগাড় করেছেন-এমন শিক্ষার্থীর হার ৭.৩ শতাংশ এবং কখনো মাথায় আত্মহত্যা চিন্তা আসেনি ৪৭.৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর।
ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় বিপদ: জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫২.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তাদের মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। আত্মহত্যা ভাবনার পেছনে বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে, যার মধ্যে প্রধানত ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাকে দায়ী করেছেন তারা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশায়, ১৬.২ শতাংশ বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমানের ফলে, ৯.৭ শতাংশ প্রেমঘটিত বিষয়ে, ৯ শতাংশ অর্থনৈতিক সমস্যাগ্রস্ত হয়ে, অন্যরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করায় ৪.৩ শতাংশ এবং ৩০.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অন্যান্য বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করার চিন্তা এসেছে বলে জানিয়েছেন।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা: জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয় কি না। এ প্রশ্নের উত্তরে ৩৮.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী হ্যাঁ সূচক এবং ৩৫.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী না সূচক উত্তর দিয়েছেন। এছাড়া ২৬.২ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছেন, তারা এ সম্পর্কে কিছু জানেন না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আঁচল ফাউন্ডেশন কিছু প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে আছে-
* ক্যাম্পাসে কাউন্সেলিং ইউনিটের ব্যবস্থা করা;
* ক্যাম্পাসে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা;
* ক্যাম্পাসে কেউ যেন বুলিং এর শিকার না হয় তা মনিটরিং করা;
* নিরাপদ বাসস্থান ও উন্নতমানের খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, প্রয়োজনে বৃত্তি ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা;
* শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সম্মান ও আস্থার সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করানো;
* মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা;
* সেমিনার ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা; এসব সেশনে বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান নিয়ে লেকচার দেওয়ার জন্য বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানো;
* দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, এডুকেশনাল কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ডিপার্টমেন্ট অব সোশাল সায়েন্সেস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজের সিনিয়র লেকচারার ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক, এডিডি ইন্টারন্যাশনালের কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল হারুন, আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।